প্রথমেই বলে রাখা ভালো কর্ণাটক এমন একটি রাজ্য যেখানে বাংলাভাষা হচ্ছে দ্বিতীয় অফিসিয়েল ল্যাঙ্গুয়েজ, যদিও মাত্র ০.০৩ শতাংশ লোক বাঙ্গালি। কর্ণাটক রাজ্য যখন গঠন হয় অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর তখন রাজ্যটির নাম ছিল মহীশূর এবং পরে ১৯৭৩ সালে রাজ্যটির নাম হয় কর্ণাটক। রাজ্যটির রাজধানী ব্যাঙ্গালুরু এবং ওই রাজধানীতেই অবস্থিত কর্ণাটক হাইকোর্ট। এই কর্ণাটক হাইকোর্ট সমগ্র দেশের মধ্যে প্রথম ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের আওতায় জামিন মঞ্জুর করে অর্চনা পূর্ণিমা প্রামাণিককে। তার পুর্বপুরুষেরা ছিলেন হিন্দু বাঙ্গালি। বর্তমানে তার বয়স হবে আনুমানিক ৩৭ বছর। তার বাল্যকাল কাটে বাংলাদেশের রাজশাহি এলাকায়। বাবার নাম অনিল চন্দ্র প্রামাণিক। অর্চনা ১৯৯৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের অ্যাডভেন্টিস্ট সেমিনারি অ্যান্ড কলেজ চার্চ থেকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন। সেখানে খ্রিস্টধর্ম নেওয়ার পরেও রেহাই হয়নি। শুরু হয় পার্শ্ববর্তী এলাকার যুবকদের অত্যাচার, নির্যাতন ও অপহরণের হুমকি। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের দ্বারস্থ হন অর্চনা। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। অন্যদিকে অর্চনার মনে ‘নার্স’ হওয়ার স্বপ্ন। তাই অর্চনার বাবা তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেন নার্সিং কোর্স পড়ার জন্য। ২০০৩ সালে রাঁচির Seventh day Adventist Hospital-4 osó gal অর্চনা এবং ২০০৬ সালে ওই হাসপাতাল 6267 General Nursing and Midwifery-র ডিপ্লোমা পান।
তারপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন নামিদামি হাসপাতালে অর্চনা নার্স হিসেবে কাজ করেন, যেমন— Wockhardt Hospital and Kidney Institute (Fortis Hospital), Manipal Hospital, Vikram Hospital, Cloud Nine Hospital। সেইসময় তার সাক্ষাৎ হয় কর্ণাটকের কোনো রাজশেখরণ কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে এবং ১২ মার্চ ২০১০ ওই কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে অর্চনার রেজিস্টার্ড ম্যারেজ হয় রাঁচি শহরে। বিয়ের পর উভয়ই চলে যান ব্যাঙ্গালুরু। আর সেখানেই অর্চনা পান ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড ও পাসপোর্ট। কিন্তু আবার বিড়ম্বনা দেখা দেয় ২০১৯ সালের ২০ মে। বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য কলকাতা আসেন। অৰ্চনা ও তার চার বছরের পুত্র। সেইসময় কলকাতা ইমিগ্রেসন অফিসার তাদের আটক করে। কিছু সময় পর কলকাতা ইমিগ্রেসন অফিস থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে পাসপোর্ট অফিস থেকে তাদের পাসপোর্ট প্রত্যাহারের নোটিস আসে।
২০১৯ সালের ২১ আগস্টে ব্যাঙ্গালুরুর আর. টি. নগর থানায় অর্চনার বিরুদ্ধে একটি মামলা দাখিল করে সহকারী অফিসার। ওই মামলাটি ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর রেজিস্টার্ডহয়। মামলার নম্বর ২৬৩/২০১৯ এবং নথিভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনের ৫,১২,১৪ নম্বর ধারায়, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৩ (১) (সি) ধারায় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১ ধারায়। অভিযোগ ছিল উপরে উল্লেখিত আধার কার্ড, প্যান কার্ড প্রতারণা করার জন্য জাল করে তৈরি করা হয়েছিল। ওই জাল নথি দিয়ে পাসপোর্ট পান। জাল নথির উপর ভিত্তি করেই অর্চনা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। ওই মামলার সূত্র ধরেই ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর সকালে অর্চনার ব্যাঙ্গলুরু আর টি নগর মন্দির রোডের বাড়িতে এসে হাজির হয় আর টি নগর থানার পুলিশ এবং সকাল প্রায় ৭-৩০ মিনিটের সময় গ্রেপ্তার করে অর্চনা পূর্ণিমা প্রামাণিককে। নিম্ন আদালত জামিন নাকচ করে চারদিনের রিমান্ডে নেয়। অৰ্চনা আবার জামিন আবেদন করে সেসন জজ আদালতে। সেখানেও জামিন আবেদন নাকচ হয় গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। জামিন আবেদন নম্বর ছিল— CRL, MISC, 10545/2019। পরে অর্চনা দ্বারস্থ হন কর্ণাটক হাইকোর্টের।
কর্ণাটক হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি শর্তসাপেক্ষে অর্চনা পূর্ণিমা প্রামাণিকের জামিন মঞ্জুর করে। ওই নির্দেশে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের নতুন সংশোধনীর ২ নম্বর ধারা মতে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পারসি ও শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু মানুষ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন ১৯২০ এবং ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনে রেহাই দেওয়া হয়েছে বা প্রযোজ্য হবে না বলা হয়েছে। মানবিক কারণেই তাদের ভারতে থাকতে দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় বৈধ নথিপত্র ছাড়াই। এইসব ধর্মাবলম্বী মানুষ ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’নন। তাই এই ধারার যে সুফল পান অর্চনা সেক্ষেত্রে কর্ণাটক রাজ্য সরকারের আইনজীবীর কোনো আপত্তি নেই বলে জানান। জামিনের নির্দেশের ৬ নম্বর প্যারাগ্রাফে স্পষ্ট বলা হয়েছে—
The records produced by learned HCGP indicate that investigation is still in progress. He does not dispute the fact that the petitioner is entitled to the benefit of amended section 2 of Citizenship Act, 1955.
অর্চনার আইনজীবী শ্রীমতী আয়ন্তিকা মণ্ডল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের নতুন সংশোধনীর ২ নম্বর ধারার পক্ষে সাওয়াল করতে গিয়ে আদালতকে অত্যন্ত। সুন্দর যুক্তি তুলে বলেন—নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন মতে মামলা থেকে একজন রেহাই পাবেন তখনই যখন তিনি দেশীয়করণ বা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু সেটা পাওয়ার জন্য কেন্দ্র সরকার এখনো কোনো রুলস তৈরি করেনি। তবে এই অনলাইন নাগরিকত্ব পেতে হলে অর্চনা পূর্ণিমা প্রামাণিকের সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। সেই উপস্থিতির জন্য এবং নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সুফল পাওয়ার জন্য তাকে জামিনে মঞ্জুর করার আবদার জানান। কর্ণাটক হাইকোর্টের বিচারপতি জন মাইকেল সরকার পক্ষ ও অর্চনার আইনজীবীর সওয়াল জবাব শুনে শর্ত সাপেক্ষে দু লক্ষ টাকার বন্ড ও দু’জন জামিনদার সহযোগে জামিন মঞ্জুর করেন। শর্ত গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্ত হচ্ছে প্রতি মাসের দু’দিন (প্রথম/পঞ্চদশ দিনে) তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও বেশিরভাগ বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং তাদের মদতপুষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিরা সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধাচরণ করে। হাতে থাকা তথ্য বলছে এখন অবধি নয়া নাগরিকত্ব আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে সর্বমোট পিটিশন দাখিল হয়েছে ১৪৪টিরও বেশি। তার মধ্যে রয়েছে অসম প্রদেশ কংগ্রেস (রিট পিটিশন নম্বর ১৫১১/২০১৯), সিপিআই (রিট পিটিশন নম্বর ০২/২০২০), দেবব্রত শইকিয়া (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৮২/২০১৯), অজন্তা নেওগ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৮৪/ ২০১৯), জয়রাম রমেশ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৭৩/২০১৯), আসাদুদ্দিন ওবেসি (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৮৫/২০১৯), প্রদ্যুত দেববর্মণ (রিট পিটিশন নম্বর ১৫১১/২০১৯), হর্ষ মান্দার (রিট পিটিশন নম্বর ১৫০০/ ২০১৯), মুসলিম অ্যাডভোকেটস অ্যাসোসিয়েশন (রিট পিটিশন নম্বর ১৫০৩/২০১৯), মহুয়া মৈত্র (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৬৬/২০১৯), সৈয়দ ফারুক, জমিয়ত উলেমা হিন্দ, কেরল জমিয়ত উলেমা হিন্দ, অসম জমিয়ত উলেমা হিন্দ, ইন্তিকাব আলম, আবু সুয়েল, মতিয়ুর রহমান, পিস পার্টি, লোকতান্ত্রিক যুব জনতা দল, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৭০/২০১৯)-এর মতো দল ও ব্যক্তিরাও।
ওই মামলাগুলির প্রথম শুনানি হয়। বিগত ২২ জানুয়ারি এবং ওইদিনের কোর্টরুমের কথাবার্তা শুনে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে মামলাগুলি চলে যেতে পারে সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে। এছাড়াও ইতিমধ্যে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬ (ক) ধারা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচারাধীন। এমনকী কেন্দ্র সরকারের জারি করা দুটি। নোটিফিকেশন যা ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মূল ভিত্তি— এই দুই নোটিফিকেশন নিয়েও অনেক আগে সুপ্রিমকোর্টে মামলা হয়েছে এবং এটি সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচারাধীন। তাই বর্তমান ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে হওয়া সবকটি মামলা সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে বা পাঁচ বা তার অধিক বিচারপতির বেঞ্চে মামলাটি যাওয়ার সম্ভাবনাই রয়েছে। আর তখন যদি সুপ্রিমকোর্টসিএএ-র বিরুদ্ধে সবকটি মামলা খারিজ করে দেয়, তাহলে দেশ জুড়ে আন্দোলনকারীদের মুখ রক্ষার কোনো পথ থাকবে না। রাফাল-চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ রাহুল গান্ধী যখন নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছিলেন, তখন সুপ্রিমকোর্টের উল্টো রায়ে রাহুল গান্ধী ভৎসিত হয়েছিলেন তা মনে আছে কি বর্তমান আন্দোলনকারীদের ? পরিশেষে অবরোধ-বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বলব, যেহেতু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রধান ধর্মাধিকরণের কাছে বিচারাধীন, তাহলে কেন সেই ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে না? অন্যদিকে এই মুহূর্তে সুপ্রিমকোর্ট যেহেতু নাগরিকত্ব আইনের উপর কোনো স্থগিতাদেশ জারি করেনি, মামলাটি আগামীদিনে সাংবিধানিক বেঞ্চে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত হতে পারে আগামী শুনানিতে। তাই বর্তমানে ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র প্রদানে কোনো বাধা নেই। যেমন ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬ (ক) ধারা সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচারাধীন তবুও ওই ধারার উপর ভিত্তি করেই অসমে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জী নবায়ন হয়েছে এবং একইভাবে কর্ণাটক হাইকোর্টের এই মামলাটিও একটি উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। তাই বন্ধ হোক ‘ক্যা’ নিয়ে এখন ক্যাউ ক্যাউ।
ধর্মানন্দ দেব
2020-02-12