নির্বাচনী সাফল্য কি বদলে যাওয়া আপকে দীর্ঘমেয়াদি শক্তি জোগাবে?

এনডিএ শাসনের যাবতীয় দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান ও সমস্ত কর্মকাণ্ডকেই অপছন্দ করা যে বিরোধীরা হাঁসফাস করছিলেন, ছোটো কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বের ভারতের রাজধানী শহরে কেজরিওয়ালের জয়ে তারা কিছুটা অক্সিজেন পেলেন। এঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হতে পারেন এমন কোনো নেতার সন্ধানে সদা নিমগ্ন। ভোটের প্রচার চলাকালীন সংসদ চ্যানেলগুলিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কেজরিওয়ালকে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছিল—দিল্লিতে জয় পেলে তার পুরনো সর্বভারতীয় নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে? যার সম্ভবনা কি থেকে যায় না? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর এই চতুর রাজনীতিবিদ কায়দা করে মোকাবিলা করেন। কেজরিওয়ালের উত্তর হ্যা কিংবা না ছিল না। যা তার অধুনা পরিবর্তিত আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে রাখার কৌশলেরই কারণে। মাত্র ৭০ আসনের আইনসভার এই নির্বাচনটি অবশ্যই রাজধানী শহর সংক্রান্ত হওয়ায় আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। সেই গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে বিজেপিই কিছুটা যেন মোদীর ও এনডিএ সরকারের ওপর। আধা গণভোটের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো প্রচার করে। যার ফলে মনে হতে থাকে দেশের অন্যান্য বহু রাজ্যের সঙ্গে দিল্লি অসঙ্গতিপূর্ণ।

অথচ ভারতের জাতীয় স্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমকক্ষ কোনো নেতা নেই। একথাটা বারবার আমাদের স্মরণ করানো হয়। কথাটি ষোলআনা সত্যি। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির এই ৭০ আসনের নির্বাচন হয়েছে। জায়েন্ট কিলারের স্তরে তুলে নিয়ে গিয়ে কেজরিওয়ালের দলের সারা ভারতে প্রভাব বিস্তার করে তাকে ভারত-পরিচালক বানানোর কথা যে কোনো কোনো মহলে উঠছে তা নিতান্তই বাতুলতা শুধু নয় নির্বুদ্ধিতা।‘আপ’ প্রকৃতিগতভাবেই একটি আঞ্চলিক স্তরে পরিকল্পনা তৈরি ও তার সফল রূপায়ণে সক্ষম একটি সংস্থা মাত্র। এই বিষয়টা তারা। নিশ্চয় বোঝে যার ফলে এই শহরে আধা পঞ্চায়েতি প্রথার পরিচালিত আধা রাজ্যে তারা সফল হচ্ছে। ফাটকা জয় পাওয়া মাত্র এই পরিকল্পনা ও রূপায়ণ পদ্ধতির মডেল দিল্লির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সারা দেশের ওপর প্রয়োগ করার প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অসার কল্পনা যার বিদেশি নাম ফ্যান্টাসি। কোনো একটা রাজ্যে জয় পেলেই কংগ্রেস সমর্থকরা যেমন সেই সাফল্য রাতারাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে— আজকাল এমন অলীক স্বপ্ন দেখেন এই ভাবনাও হবে সেই ঘরানার। যদিও বাস্তবে সেই কংগ্রেসি কল্পনা অচিরেই বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে।তবুও বিজেপি’র দিক থেকে দিল্লিতে আপের কাছে এই পরাজয়ে পর্যালোচনার এক বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি করছে। ভারতবর্ষের মূল শাসনভার দলের থেকে আরও দীর্ঘ সময় থাকায় নিশ্চয়তা থাকলেও ক্রমাগত দেশের নানান রাজ্যে নিয়ত্রণ হারানো পক্ষান্তরে নির্বাচকমণ্ডলীর বিশ্বাস হারানোর শামিল তা কালের আত্মবিশ্বাসে টান ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ কঠিন করে তুলবে।

বিজেপির সদ্য সরে আসা সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের যে বিরল বৈশিষ্ট্য তা হলো কোনোকিছুকেই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে না দেওয়া। একেবারে বুথ স্তর পর্যন্ত সংগঠনকে তত্ত্ববধানের মাধ্যমে চাঙ্গা করে দেশ ও দলের সর্ববৃহৎ নেতা নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে যথাযথ প্রয়োগ করার মাধ্যমে সাফল্য নিয়ে আসা।

শুধু তাই নয়, পরাজয়ের ক্ষেত্রে নিরীক্ষণ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে ফঁাকগুলি খুঁজে বার করে দ্রুত তা ভরিয়ে ফেলে যাতে হারানো জমি পুরুদ্ধার করা যায় সেই রাস্তা ধরাই বিজেপি’র বরাবরের পদ্ধতি। কিছুদিন ধরে ফাঁকগুলিকে বিন্দুর মাধ্যমে প্রকাশ করে লাইন টেনে চটজলদি বুজিয়ে ফেলে সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না।

এইসূত্রে দিল্লির জনাদেশ কিন্তু নাগরিক সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে মোটেই নয়। শাহিনবাগে অবস্থান চলাকালীন সরকারের তরফে বিশাল ঘুর পথে পরিবহণ পথ পরিবর্তনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও নয়। কিন্তু এই ক্ষোভ, অবস্থান নিয়ে যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে গত দু’মাস ধরে জায়গায় জায়গায় পুলিশের গার্ডরেল দিয়ে নিত্যদিন ব্যারিয়ার তৈরির যে প্রক্রিয়া চলছে পর্যাপ্ত ও সুস্থিতিতে জীবন কাটাতে আগ্রহী দিল্লিবাসীর কাছে তা এক বিসদৃশ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির দৃশ্য তৈরি করছে। এর বিপরীতে কেজরিওয়ালের তুলনামূলকভাবে দিল্লিবাসীর জীবনযাত্রা সহজ ও সুখপ্রদ করতে চটজলদি প্রক্রিয়াগুলি নগরবাসীকে আকৃষ্ট করেছে। বেশি। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো গুলি চালিয়ে দেওয়ার প্ররোচনামূলক বক্তব্যের পরও কেজারিওয়াল শাহিনবাগে যাননি। মিডিয়ার লোকজন তাজ্জব বনে গিয়ে লক্ষ্য করেছেন যেখানে কেজরি ব্যাপক হাততালি ও গুণ্ডাগিরি করার হাতেগরম সুযোগ পেয়েছিলেন তাও তিনি কৌশলে পরিহার করেছেন। প্রতিবাদীদের দাবির ভিড়ে মিশে গিয়ে তিনি নিজের ‘বিজলি, সড়ক, পানির স্লোগান থেকে হটেননি। ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার ডাক দেওয়াদের সঙ্গে ভিড়লেই তার ফোকাসটা সরিয়ে নেওয়ার অস্ত্র বিজেপি’র হাত শক্ত করত। দেশের তুলনামূলকভাবে বড়ো অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির আঁচ রাজধানী অঞ্চল হওয়ায় না পড়ার কারণে তিনি নির্বাচনের অ্যাজেন্ডাকে নিতান্তই স্থানিক রেখে CAA -এর সমস্যা কেন্দ্রে এই সফল বিভাজন করতে পেরেছিলেন।

কিন্তু ফলাফল বেরোবার পরই তার ঘোষণায় সর্বভারতীয় আকাঙ্ক্ষার ছায়া পড়ে গেল। কেজরিওয়াল তার জয় ‘ভারতমাতা’ ও ‘প্রভু হনুমান’কে উৎসর্গ করলেন। একই সঙ্গে সশক্ত জাতি তৈরি করতে তিনি সকলকে আপ দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাখলেন। এই জাতি নির্মাণের আহবান একেবারেই বিজেপি’র বই থেকে টোকা। এই অবস্থান তার এত দিনের কেন্দ্র বিরোধী বাম অবস্থান থেকে বিপরীত নিতান্তই Centre right অবস্থান। বিজেপি’র অবস্থানের প্রতিরূপ।

দিল্লির নির্বাচনের জয় আগে বলা পরিকল্পনা তৈরি ও রূপায়ণে সাফল্য আনা হিসেবে দেখার যে প্রসঙ্গ আনা হয়েছিল তারই পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে কেজরিওয়ালের পূর্বতন আমলাতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ও ৫ বছরের সরকার চালানোর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা কাজ দিয়েছে। তার দলের অনেক মন্ত্রী ও সদস্যেরই সংস্থা চালানোর পেশাগত দক্ষতাও ছিল, যে কারণে তাকে বা সদস্যদের কমজোরি টিউব লাইটের সঙ্গে তুলনা করাও ছিল শক্ত। তার সঙ্গে মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করার মতো বড়োসড়ো ২০০ ইউনিটের বিজলি ছাড় এবং বিনি পয়সার জলই যে বাজিমাত করেছে সে। বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে শ্রেণী, জাত, ধর্ম সবই মিশে গেছে। জয়ের আঞ্চলিক পরিসংখ্যানগুলি নজর করলেই দেখা যাচ্ছে আপ এই রাজধানী শহরের সমস্ত অঞ্চল জুড়েই সার্বিক জয় পেয়েছে।

২০১৫ সালের আপ ৪৯ লক্ষ ভোট পেয়ে গোটা দিল্লি জয় করেছিল। কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এই ভোটের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ দল বিজেপি ও কংগ্রেসের কাছে। খুইয়ে ফেলে। বিজেপি’র পক্ষে মনে রাখা দরকার, আপ ব্যাপক সংখ্যার এই হিন্দু ভোট আবার নিজের দিকে নিয়ে গেছে।

তবে উল্লেখিত নানান নির্বাচনী কৌশল, বিনামূল্যের বিতরণের মতো আকর্ষণীয় টোপ ব্যতিরেকে ও কেজরিওয়াল দলটিকে ইত্যবসরে নতুন করে নির্মাণ করেছেন। এরা এখন আর কোনো সাড়া জাগানো আন্দোলনে লিপ্ত থেকে নিজেদের নৈরাজ্যবাদী প্রমাণ করতে তৎপর নয়। আজকের আপ পুরোদস্তুর রাজনৈতিক মঞ্চ, অন্য দলগুলির থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা নয়। বিগত তিন বছরে কেজরিওয়াল ৭ বছর আগে তার দলটির জন্মের সময় অন্য সকলের থেকে আলাদা অনেকটা আকাশ থেকে পড়ার যে দাবি জানিয়েছিলেন সেই সমস্ত বিবাদাত্মক বিষয়গুলির সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ আপোশ করে নিয়েছেন।

ইন্দ্রজিৎ হাজরা ও রাহুল শিবশঙ্কর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.