‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ নিয়ে আলোচনায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে বিএনপি-র নাম উচ্চারণ করেছেন। ঢাকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগির এতে উত্মা প্রকাশ করেছেন। প্রত্যুত্তরে অমিত শাহ বলেছেন, ‘চাইলে প্রমাণ পাঠিয়ে দিতে পারি। অন্য এক প্রসঙ্গে মির্জা ফখর বলেছেন, বিএনপি আমলে সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত ছিলেন। একথা শুনে আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমি হাঁসবোনা কাদবো ঠিক বুঝতে পারছি না। সঙ্গে তিনি যোগ দেন, আওয়ামি লিগ আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকেন। বিদেশমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কোনো দৃষ্টান্ত নেই’! এই তিন নেতার কথা শুনে আমার ত্রিশঙ্কু অবস্থা, আমি হাসবো না কাদবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
ভারতের লোকসভায় শিলচরের এমপি ড. রাজদীপ বেশ জোরালো কণ্ঠে বলেছেন, জীবন বাঁচাতে আমার বাবা সব ছেড়ে-ছুড়ে রাতের অন্ধকারে সিলেট থেকে পালিয়ে শিলচর চলে আসেন। অভিনেত্রী ও বিজেপি নেত্রী রুপা গাঙ্গুলি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে বোরখা পরে পালাতে হয়েছিল। ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা উঠছে। হয়তো আরও উঠবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এবং বাংলাদেশের সংসদে এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয় না। পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরা বিধানসভার অধিকাংশ এমএলএ-র পূর্ব-পুরুষ রাতের অন্ধকারে পূর্ব-পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন, কিন্তু কেন এসেছেন, তা বেমালুম ভুলে গেছেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব’নিজেই একটি দৃষ্টান্ত; তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী তো এখনো চাদপুরে। নারায়ণগঞ্জের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ড. অমর্ত্য সেন বা গায়ক নচিকেতা, সবাই পালিয়ে এসেছেন, কিন্তু এরা কখনো মুখ খুলেননি। গত বাহাত্তর বছরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের জন্যে একটি শব্দও ব্যয় করেনি!
বাংলাদেশের সংসদে এখন ১৮ জনের বেশি সংখ্যালঘু এমপি আছেন। কমবেশি আগেও ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ব্যতীত এদের কারো মুখে কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা শোনা যায়নি। ক্যাব বা এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশে এ নিয়ে শঙ্কা থাকা স্বাভাবিক। শঙ্কার স্পষ্ট কারণ হচ্ছে, একটি বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারত গেছে বা এখানো যাচ্ছে, এটি অস্বীকার করা মুখত। আমরাই তো প্রায়শ বলি, ‘আমাদের গ্রামে পঞ্চাশ ঘর হিন্দু ছিল, এখন আছে পাঁচ ঘর। সর্বত্র একই চিত্র। ক্যাব হয়ে যাওয়ার পর ছিন্নমূল, রাষ্ট্রহীন শরণার্থী যাঁরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা একটি রাষ্ট্র পাবেন, হয়তো তারা তখন নির্ভয়ে মুখ খুলবেন। অথচ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী কারো ভারত যাওয়ার কথা ছিল না। ক্যাব নিয়ে এখন বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে, এমনকী পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ক্যাব করে ভারত হিন্দুত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসী দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী অন্যকে ‘সবক’ দিচ্ছেন!
মাত্র ক’দিন আগে বিজিবি সীমান্তে বেশ কিছু মানুষ আটক করে। বিজিবি বলেছে, এরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। পুলিশ তদন্ত করে বলেছে, এঁরা বাংলাদেশের নাগরিক। কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। এটাই বাস্তবতা। এখানে বিজিবি ও পুলিশ উভয়ই সঠিক। বিজিবি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করাকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলবে। তদন্ত বিজিবি’র কাজ নয়, পুলিশের কাজ। পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, ওঁরা বাংলাদেশি। সংখ্যালঘু হিন্দুরা কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে ভারত যায়নি, গেছে অত্যাচার এবং নিরাপত্তাহীনতার জন্যে। এদিকে ক্যাব নিয়ে টানাপোড়েনে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী ড. মোমেন’র ভারত সফর বাতিল হয়েছে। অমিত শাহের বক্তব্য, “বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে’ জবাবে তিনি বলেছেন, ক্যাব ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে দুর্বল করবে। হায়রে হায়, নিজের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো খবর নেই, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর ঘুম নেই?ভারত নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ অনেক সময় নষ্ট করেছেন, গত ছয় দশক তাই দেখছি। আসলে ভারতের চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের উচিত বাংলাদেশকে কীভাবে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, মানবকল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া।
সিতাংশু গুহ
(লেখক আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি)
2019-12-27