বোমা শিল্পেও এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ

১৯৪৫ সালের জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকির পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের মিনি ট্রেলার দেখার সুযোগ পেল মমতা ব্যানার্জির ‘সোনার বাংলা। ব্যান্ডেল নিবাসী হওয়ার দরুন ঘরে বসে কেঁপে উঠলাম কান ফাটানো বিকট শব্দ ও তীব্র কম্পনে। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মনে হলো আশেপাশে কোনো বোমা ফেটেছে। ঘরে একটু কম্পন অনুভূত হলো। কিছুক্ষণ পর নিউজ চ্যানেলে খবরটি সম্প্রচারিত হলো।
মালদার কালিয়াচক, বর্ধমানের খাগড়াগড়ের যোগ্য উত্তরসূরী নৈহাটির দেবকগ্রাম। বারুদের আঁতুরঘর আজ শুধু এই স্থানগুলি নয়, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে আজ প্রসিদ্ধ এই কুটিরশিল্প। গত জানুয়ারিতে অগ্নিসংযোগ হয় নৈহাটির দেবকগ্রামের বাজি কারখানায়। ঘটনাস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয় পরে আরও একজনের। আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি ভেঙে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ তখন থেকেই বাজি তৈরির মশলা বারুদ বাজেয়াপ্ত করে সেগুলিকে ৩/৪ দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে নিস্ক্রিয় করার প্রক্রিয়া চালায়।
স্থানীয় মানুষজনের আপত্তি সত্ত্বেও যথাযথ নিয়ম পালন না করেই তারা এই প্রক্রিয়া চালায়। ৯ জানুয়ারি ছিল শেষদিন, ফলে জমে থাকা সমস্ত বারুদ মশলার যথাযথ পরীক্ষা না করেই এবং তাদের তীব্রতা না বুঝেই নৈহাটি পুরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের গঙ্গার পাড়ের সংলগ্ন ছাইঘাটে বোম্ব স্কোয়ার্ড নিষ্ক্রিয় করার কাজটি করে, আর তাতেই স্থানীয় অঞ্চল তো বটেইবিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেশ্যামনগর থেকে নৈহাটি, কাচড়াপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই প্রকট রূপ নেয়। সাড়ে চার কিলোমিটার গঙ্গার ওপারে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড কম্পনের জেরে বাবুগঞ্জ ঘাট, জোড়াঘাটসহ এলাকার ঘরবাড়ির কাচের জানলা ভেঙে পড়ে, ঘরের পুরু দেওয়ালে ফাটল দেখা যায়, এমনকী হুগলী-চুচুড়া পৌরসভার কয়েকটি দপ্তরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাইঘাটের ৫০ মিটারের অনতিদূরে জুটমিলের শ্রমিকদের আবাসনের প্রায় আটটি বাড়ির অ্যাজবেস্টারের ছাউনি ভেঙে পড়ে। অ্যাজবেস্টর ভেঙে পড়ে এক পাঁচ বছরের শিশু গুরুতর আহত হয়। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ বাজি নয়, বাজির সঙ্গে শক্তিশালী বোমাও ছিল।
ওই বাজি কারখানার মালিক নুর হুসেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও বিধায়কের ঘনিষ্ঠ। সরকারের লোকের পরোক্ষ মদত ছাড়া এই কাজ যে অসম্ভব তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। খাগড়াগর বিস্ফোরণের পর এন। আই এ-র তদন্ত সাপেক্ষে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাতে তল্লাশি চালানো হয়েছিল এবং যার ফলে মাদ্রাসাগুলি থেকে অনেক নথি উদ্ধার হয়েছিল। তাহলে কী বলা যায় এটি শুধুমাত্র ঘটনার পুনরাবৃত্তি ? রাজ্য সরকারের পরোক্ষ মদতে রাজ্যজুড়ে এইসব বাজি কারখানার নামে জেহাদিরা শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং অবশ্যই স্থান কাল ও পাত্র পরিবর্তনশীল, তবে প্রেক্ষাপট অপরিবর্তনীয়। প্রেক্ষাপটটি এক। চিন্তাশীল। বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি একটু চিন্তনশক্তি তীক্ষ্ণ করলেই বাস্তব রূঢ় সত্যিটি উপলব্ধি করতে পারবেন। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের জামাত-উলমুজাহিদিনের কম্যান্ডার ও তার স্ত্রী ফতিমা এন আই এর কাছে স্বীকার করে তারা সিমুলিয়া ও লালগোলা মাদ্রাসা থেকে মুসলমান যুবকদের জেহাদের ট্রেনিং দিত ও কার্যকলাপ সংগঠিত করত এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যে মুসলমান তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করত। শেখ রহমাতুল্লাহ নামে আরেক বাংলাদেশী জঙ্গি তদন্তে স্বীকার করে সে মজলিস-ই-সুরার কম্যান্ডার। বিস্ফোরণের বীভৎসতা দেখে অনুমান করাই যাচ্ছে নৈহাটি আর কিছুই না, খাগড়াগড়ের উত্তরসূরী। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বুকে এভাবেই বাজি কারখানা বা বলা যায় কুটিরশিল্পের নামে জেহাদি শক্তিবৃদ্ধি করবে আর সরকার চোখ বন্ধ করে থেকে যাবে–এরপর আর কি বলা যাবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’? সোনার বাংলায় আজ আর সোদা মাটির গন্ধ নেই, আছে বোমা বারুদের ঝাঝালো গন্ধ। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে এই জেহাদিদের প্রশাসন খিদমতগারি করবে, বাজির আড়ালে অন্য নাশকতামূলক কারবার তারা রমরমিয়ে করে যাবে। একটি বিস্ফোরণ হবে, প্রশাসনের ঘুম ভাঙবে, মানুষজন জোগে উঠবে, দু’চারদিন পর আবার সেই। এই নিয়ম চলছে চলবে। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের দাবি, বাজির মধ্যে মাইন জাতীয় কিছু ছিল। তা না হলে গঙ্গা পেরিয়ে চুঁচুড়ায় বিস্ফোরণের শব্দ যেত না। কিন্তু সরকার, সিআইডি এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। স্থানীয় বিধায়ক পার্থ ভৌমিক একদিন আগে একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের প্যানেলে গিয়ে একটি অন্য ইস্যুতে সরকারের হয়ে গলা ফাটাচ্ছিলেন, নিজস্ব এলাকায় এই বীভৎসতা নিয়ে তাঁর কোনো বিবৃতি নেই। আর মাননীয়ার সেই ক্ষতিপূরণ সিস্টেম আজও দীর্ঘজীবী ! বিষমদ খেলে ক্ষতিপূরণ, বিস্ফোরণে ক্ষতিপূরণ। মানুষকে টাকা দিয়ে আর কত মুখ বন্ধ করে রাখবেন? যে বাচ্চা দুটো গুরুতর আহত হলো তাদের কী কোনো ক্ষতিপূরণ হবে ?টাকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘর পুনরুদ্ধার করে দেওয়া যাবে অথচ বোমা শিল্পগুলিকে মান্যতা দেওয়া বন্ধ করা যাবে না।
তদন্তের ভিত্তিতে জানা গেছে, রাতের অন্ধকারে দেবগ্রাম থেকে লরি ভর্তি করে। আতসবাজির ভেতরে মাইন বাইরে পাচার হতো। একটি করে বিস্ফোরণ হবে, আমাদের সামনে এইসব তত্ত্ব আসবে, আবার আমরা সব ভুলে রোজনামচায় ডুব দেব, আর সুযোগ করে দেব এই জেহাদিগুলোকে। বিস্ফোরণের জেরে ১০ ফুট গর্ত তৈরি হয়েছে, চায়না বারুদের সঙ্গে পটাসিয়াম ক্লোরাইড, অ্যালুমিনিয়াম ডাস্ট পাওয়া গেছে। সামনে কালীপূজোও ছিল না বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানও নয়, তবে এত বারুদ একসঙ্গে একটি বাজি কারখানায় মজুত ছিল। কেন? এই কিছু সাধারণ প্রশ্ন সকলের মনেই উঠছে, কিন্তু তৃণমূলের মহাসচিব থেকে মাননীয়া কারোর কাছে কোনো সদুত্তর নেই। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব আই এন এ-র তদন্ত দাবি করেছে সিআইডি-র উপর ভরসা করা যাচ্ছে। না। তারা নিজেদের অপদার্থতা বারংবার প্রমাণ করেছে।
পুলিশ ও বোম স্কোয়াডের অপদার্থতা, প্রযুক্তিগত অশিক্ষা যথেষ্ট দায়ী। তাদের বারুদ নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়া যথার্থ ছিল না। অপারদর্শিতা, অপেশাদারিত্ব বহু অংশে দায়ী। যোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এত বড়ো মাপের বিস্ফোরণ হয়তো এড়ানো যেত, তবে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হতো না। আজ বোমা শিল্পে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, ধর্ষণে এগিয়ে রাজ্য, কাটমানিতে এগিয়ে রাজ্য। প্রশাসন কঠোর হাতে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল সংশোধন তো নয়ই, ওই বাজি কারখানার মালিক নিজে একজন সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। জেহাদিদের গায়ে রাজনীতির রং লাগিয়ে তাদের বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করা মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। স্থানীয় মাদ্রাসাগুলিও সন্দেহের বাইরে নয়। খাগড়াগড় কাণ্ড যার জ্বলন্ত উদাহরণ। নীরবে নিভৃতে গোপনে অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে এইসব জেহাদিরা তাদের সন্ত্রাসবাদী কাজ করে যাচ্ছে। মানবজাতির শত্রু জেহাদিদের নিষ্কাশন করার কাজ যদি প্রশাসন গ্রহণ না করে তবে জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেই।দিকে দিকে জেহাদিদের মডিউলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠার আগেই তাদের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করা দরকার। কথায়। বলে নিজের ঘরে আগুন না লাগলে তার ভয়াবহতা ঠাহর করা যায় না—আজ সেই বিপদ আসন্ন। সময় আছে সতর্ক হোক প্রশাসন না হলে তাদেরও অস্তিত্ব রক্ষা করা মুশকিল।
অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ হোক। প্রতিষ্ঠিত হোক সত্যের মর্যাদা। ঘৃণ্য জিহাদি তাণ্ডবের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জাগরিত হওয়ার সময় এসেছে। আর তাতেই এই ভয়ানক দুরভিসন্ধির রাজনৈতি-জেহাদিআঁতাত সমূলে বিনষ্ট হবে।
রণিতা সরকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.