সিরাজ-উদ-দৌলা কি প্রকৃতই বাঙ্গলার শেষ স্বাধীন নবাব এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন

বাঙ্গলা, বিহার, ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব বলে কথিত সিরাজউদ-দৌলাকে কেন্দ্র করে আবার মধ্যবাঙ্গলায় একটা অন্য ধরনের ভাবাবেগ তৈরি করার চেষ্টা শুরু হয়েছে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও আরও কয়েকটি জেলায়। বাংলাদেশের কিছু লোকজনও এই প্রচেষ্টায় শামিল। সিরাজকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনাচক্র ইত্যাদিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর ও লালবাগে। বাংলাপক্ষ নামে এক স্বয়ম্ভু ফেসবুককেন্দ্রিক সংস্থাও এতে শামিল। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশকে নিয়ে পুরনো বাংলা সুবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কিছু মানুষ। এক সময়ে সিরাজকে কেন্দ্র করে পরাধীন যুগে একটা দেশপ্রেমের হাওয়া তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল কিছু আবেগনির্ভর নাটক ইত্যাদি।শচীন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, অক্ষয়কুমার মৈত্র, নবীনচন্দ্র সেন এঁরা সিরাজকে নিয়ে পুস্তক, নাটক, কাব্য ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। এসব ক্ষেত্রে তথ্যের চেয়ে ভাবাবেগের প্রাধান্য ছিল বেশি। আমাদের বালকবেলায় সিরাজ ছিল ‘নায়ক’-এর আসনে। নাটকের সিরাজের সংলাপ ছিল কণ্ঠস্থ। বিদ্যালয়বেলায় তাই পলাশী এবং সিরাজের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম স্বাভাবিকভাবেই। পরে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে মুর্শিদাবাদ তথা বাঙ্গলার নবাবি আমলের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পাঠ করেছি। বালকবেলার সেই আবেগের সঙ্গে যুক্তি আর তথ্যনিষ্ঠা যুক্ত হয়েছে। যাইহোক, সিরাজ-উদ-দৌলা উপাখ্যান ইতিহাসে গুরুত্ব পেয়েছে তার রাজত্বকৃতির জন্য নয়; পরন্তু তাকে হারিয়ে ইংরেজরা তাঁদের রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য। ইদানীং সিরাজের এক বছর কয়েকমাসের রাজত্ব এবং পলাশীর যুদ্ধের পরে প্রায় ২৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এই ঘটনা আজও বাঙ্গালি জীবনকে আলোড়িত করে। যদিও সেই সময় সমকালীন পদস্থ রাজকর্মচারী এবং স্বয়ং নবাবরা সকলেই নিজে ক্ষমতা দখলের জন্য একে অপরের বিরোধিতা করতে পিছপা হতো না। তাদের এই আচরণে দেশপ্রেমের ছিটেফোটাও থাকত না। ব্যক্তি স্বার্থের জন্য তারা এমনকী নিজের প্রভু বানবাবের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করত। মুর্শিদাবাদের প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এভাবেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
২৩ জুন ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধ বাঙ্গলা তথা ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। আর জড়িয়ে গেছে বাঙ্গলার তৎকালীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নাম। ইংরেজদের হাতে ভারতের স্বাধীনতা হারানোর শুরুর ইতিহাসেও পলাশী এবং সিরাজের নাম যুক্ত হয়েছে। সিরাজ এবং পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে অনেক ইতিহাস যেমন লেখা হয়েছে তেমনই লেখা হয়েছে কাব্য, নাটক, যাত্রাপালা।ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই আবহে সিরাজ পেয়েছে স্বাধীনতাযোদ্ধার মর্যাদা। ইংরেজ বিরোধী জাতীয়তাবোধের আবহে অক্ষয়কুমার মৈত্র। লিখেছিলেন সিরাজদৌলা। শচীন সেনগুপ্তও লিখেছিলেন। আবার। মুর্শিদাবাদ জেলা এবং তার লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় সিরাজকে নায়ক বানিয়ে সিরাজের সময়কার ‘বাংলা সুবে’বানানোর একটা বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ। এতে দু’দেশের কিছু শিক্ষিত মানুষও শামিল হচ্ছেন। তারা লালবাগ-মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুরে সিরাজকে কেন্দ্র করে কিছু সভা-সমিতি এবং বার্ষিক সেমিনারও শুরু করেছে। মূলত এই প্রকল্প বাংলাদেশের হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং অন্য জেলার কিছু মানুষ এতেশামিল। কখনো কখনো এঁরা ‘বাংলাপক্ষ’ নামে ফেসবুক নির্ভর একটি ভারতবিরোধী। সংস্থারও মদত পাচ্ছে। এমত অবস্থায় সিরাজ-উদ-দৌলা ও তৎকালীন বাঙ্গলার বিষয়ে কিছু আলোচনা ও লেখালেখির প্রয়োজন আছে।
মুর্শিদকুলি খাঁ (তখন দেওয়ান) ঢাকায় অবস্থান কালে স্বয়ং বাঙ্গলার তৎকালীন নবাব তথা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের নাতি আযিমুশ্বানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আবার মুর্শিদকুলির পরে তার নাতি সরফরাজ খাঁ তাঁর নিজের পিতা সুজাউদ্দিন খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। আর আলিবর্দি তো স্বয়ং তার প্রভু সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁকে নিহত করেই নবাব হন। তিনি বাদশাহ-স্বীকৃত নবাব ছিলেন না। দিল্লির দরবারে নানা উপটৌকন এবং অর্থ পাঠিয়ে তার বিনিময়ে নবাবি সনদপ্রাপ্ত হন। আলিবর্দি খাঁ তো নানা সময়ে কথার খেলাপ এবং বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তার মসনদ টিকিয়ে রাখেন। দিল্লির বাদশাহ আগেই বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশার ‘চৌথ’ আদায়ের অধিকার মারাঠা রঘুজী ভোঁসলেকে এক চুক্তির মাধ্যমে দিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরেও কী করে বাদশাহ আলিবর্দিকে বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশার নবাবি ‘সনদ প্রদান করলেন তাও এক প্রহেলিকা! এছাড়াও আলিবর্দি খাঁ মারাঠাদের ওড়িশার চৌথ আদায়ের অধিকার দান এবং বিহারের জন্য বারো লক্ষ টাকা মারাঠাদের দেবার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির কোনোটিই তিনি পালন করেননি। সব ক্ষেত্রেই তিনি চুক্তির শর্ত খেলাপ করেছিলেন। আবার মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে চুক্তি করবেন বলে আমন্ত্রণ করে এনে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেন। ঐতিহাসিক এইচ বেভারিজের সূত্রে জানা যায়, সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ শ্বশুর আলিবর্দিকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। তো, এই ধরনের পরিবেশের মধ্যেই বড়ো হয়েছিলেন তরুণ সিরাজ। আবার নবাব হবার আগেই একবার সিরাজ তার দাদু, নবাব আলিবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। অর্থাৎ বাঙ্গলার নবাবি ‘সিস্টেম’বা পদ্ধতির মধ্যেই সে স্কুরিত হচ্ছিল বাল্যবয়স থেকেই। ১৭৫৬ সালে দাদু আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পরে দাদুর মনোনীত প্রার্থী সিরাজ-উদ-দৌলা নবাব হলেন অনেকের আপত্তি ও বিরোধিতা সত্ত্বেও। আর সিরাজ-উদ-দৌলা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত এবং নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে বাঙ্গলার অমাত্যবর্গই শুধু নয়, সাধারণ প্রজারাও তার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া এই রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটও দেখা যাচ্ছিল। আর ছিল মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মুসলমান নবাবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এক তীব্র আকুতি।
এই প্রসঙ্গে সিরাজদৌলার চরিত্রকথা একটু সংক্ষেপে আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। দাদু আলিবর্দি খাঁ বিহারের শাসনকর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হবার সময়েই ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে বিহারে সিরাজের জন্ম হয়। তার পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ ও মাতা আমিনা বেগম। আমিনা আলিবর্দি খার কনিষ্ঠা কন্যা। সিরাজের জন্মের সময় থেকেই আলিবর্দির সৌভাগ্যের শুরু হয় বলে আলিবর্দিতাকে পালিতপুত্র রূপে গ্রহণ করে তাকে অন্ধস্নেহে মানুষ করেন। ফলে খুব কম বয়সেই তার চারিত্রিক স্খলন ঘটে। সিয়ার-উল-মুতাখেরিনের লেখক গোলাম হোসেন খাঁ সিরাজ সম্পর্কে নানান কটুক্তি করেছেন। তাকে ‘অজ্ঞ অর্বাচীন যুবক’, যে ন্যায়-অন্যায়ের তফাত বোঝে না, রূঢ়ভাষী ও হৃদয়হীন, দয়ামায়াহীন, উদ্ধত ব্যবহার, অহংকার ও অজ্ঞতায় যার মাথা খারাপ হয়েছে, যে যৌবন, ক্ষমতা এবং আধিপত্যের নেশায় বুদ ইত্যাদি নানা কটুক্তিতে বিদ্ধ করেছেন। আবার রিয়াজুস-সালাতিনের গ্রন্থকার গোলাম হোসেন সেলিমও সিরাজকে বদমেজাজি ও রূঢ়ভাষী বলে সমালোচনা করেছেন। সিরাজ তার দরবারের সমস্ত অভিজাত ব্যক্তিবর্গ এবং সেনাপতিদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেন। ওই সময়ের সমস্ত ইউরোপীয় লেখকেরা তার চরিত্রের বিরোধিতা করেছেন। এমনকী তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু, কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ জা লও তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, সিরাজের চরিত্র ছিল জঘন্যতম আর লাম্পট্য ও নিষ্ঠুরতায় ভরপুর। লিউক স্ক্র্যাফটন তার সম্পর্কে বলেছেন, সিরাজ সর্বদাই লাম্পট্য ও অতিরিক্ত মদ্যপানে ডুবে থাকতেন। তিনি আরও বলেছেন যে তার বন্ধুবান্ধবরাও ছিল খুব নিকৃষ্ট। সিরাজ আরও ছিল নির্দয়, লোভী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সুতরাং সিরাজ যে তরুণ বয়সে নিষ্ঠুর, নির্দয়, লোভী ও অসৎ চরিত্রের যুবক ছিলেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।নবাব আলিবর্দিতাকে আদরযত্ন, স্নেহ ও নানা প্রশ্রয় দিয়ে মানুষ করেন। ফলে নানান স্বেচ্ছারিতা করেও বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দির সমর্থন ও স্নেহ বঞ্চিত তো হনইনি, পরন্তু আলিবর্দি তাঁকে নানাভাবে তোষণ করে চলতেন।
আলিবর্দি তাকে খুব কম বয়স থেকেই শাসনকাজে পারদর্শী করে তোলারও চেষ্টা করেন। তাঁকে অল্প বয়সেই ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৭৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশা অভিযানের সময় আলিবর্দি তাকে সঙ্গে নেন। আবার ১৭৪৮ সালে সিরাজের বাবা জৈনুদ্দিন আহমেদ নিহত হলে আলিবর্দি তাকে বিহারের নায়িব নাজিম। হিসেবে নিযুক্ত করেন আর রাজা জানকীরামকে তার সহকারী নিযুক্ত করেন। ১৭৪৯ সালে আলিবর্দি তাকে বালেশ্বরে মারাঠাদের বিতাড়ন করতে পাঠান। কিন্তু ইতিমধ্যে নবাবের এক বিতাড়িত ও বিক্ষুব্ধ সেনাপতি মেহদি নিসারের উস্কানিতে সিরাজ রাজা জানকীরামকে বিতাড়িত করে নিজ বিহারের স্বাধীন নবাব হবার চেষ্টা করেন। সিরাজ পাটনায় পৌঁছে রাজা জানকীরামকে পাটনার দুর্গ সমর্পণ করতে আদেশ করেন। কিন্তু নবাবের বিনা অনুমতিতে সিরাজকে এভাবে পাটনায় প্রবেশ করতে দেওয়া অনুচিত ভেবে জানকীরাম দুর্গার বন্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করে তাই করলেন। ফলে সিরাজের দল গোলাগুলি ছুড়তে শুর করে। পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়। এর ফলে বন্ধু মেহেদি নিসার খাঁ গোলাতে মারা যায়; সিরাজের যুদ্ধলিপ্সারও সাধ মিটে যায়। কিন্তু এবারও সিরাজ বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দির ক্ষমা পেয়ে যান। মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে সিরাজের শৃঙ্খলাহীনতা আরও বেড়ে যায়। মুতাক্ষরিন প্রণেতা গোলাম হোসেন লিখেছেন, অসঙ্গত কামাসক্তিই সিরাজ চরিত্রের সর্বপ্রধান কলঙ্ক। গোলাম হোসেন আরও বলেছেন, “মহাত্মা আলিবর্দি খাঁর শ্রীবৃদ্ধির দশায় তাহার পরিবারবর্গ যেরূপ লাম্পট্য ও অনাচার আরম্ভ করিয়াছিল, তাহা ভদ্র ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। সিরাজদ্দৌল্লা নগরের রাজপথে ছুটোছুটি করিয়া এরূপ ঘৃণিত ও অকথ্য আচরণ করিতেন যে, লোকে দেখিলে অবাক হইত। তাহারা বয়স বা স্ত্রী-পুরুষ কিছুই গ্রাহ্য করিত না।” সিরাজের ব্যাভিচারের বিস্তারিত বিবরণ দেবার স্থান বা পরিসর এখানে নেই। কিন্তু তার নিষ্ঠুরতা ও নরহত্যার অপবাদের বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। সিরাজের জ্যেষ্ঠতাত নোয়াজিস মহম্মদ ঢাকার নায়েব-নাজিব হলেও মারাঠা আক্রমণের সময় থেকেই তিনি ঢাকায় যাননি; মুর্শিদাবাদেই থাকতেন। তার পক্ষে তার দেওয়ান হোসেন কুলি খাঁ ঢাকায় শাসন করতেন আর রাজা রাজবল্লভ ছিলেন তার পেশকার। কিন্তু ক্রমে হোসেন কুলি খাঁ শুধু নোয়াজিশের পক্ষে ঢাকার শাসনকর্তাই নয়, তাঁর গৃহেরও সর্বময় কর্তা হয়ে বসলেন। একই সঙ্গে নোয়াজিশ-পত্নী ঘসেটি বেগম এবং সিরাজের মাতা আমিনা বেগমের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমের নামে কলঙ্ক রটে যায়। সিরাজ অন্যায়ভাবে হোসেন কুলি খাঁকে হত্যা করে এই কলঙ্কমোচনের প্রতিজ্ঞা করেন। সিরাজ আলিবর্দির বেগম এবং আলিবর্দির অনুমতি নিয়ে দিনের বেলায়, প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করে, খণ্ড খণ্ড করে রাজপথে ফেলে দেয়। এমনকী, হোসেন কুলির অন্ধ ভাই, হায়দার কুলিকেও বিনা দোষে হত্যা করে। এছাড়া হোসেন কুলির ভাইপো হোসেন উদ্দিন খাঁকেও সিরাজের পরামর্শে হত্যা করা হয়েছিল। আবার সিরাজের জন্য মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ তৈরি হলে এর ব্যয়ভার বহন এবং সিরাজের আমোদপ্রমোদের ব্যয়ের জন্য নজরানা মনসুরগঞ্জ নামে এক নতুন আবওয়াব বা অতিরিক্ত সেস বসানো হলো জমিদার তথা প্রজাদের উপর। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দি সিরাজকে রাজ্য পরিদর্শনের জন্য হুগলী পাঠালে হুগলীর ফরাসি ও ওলন্দাজ কুঠির প্রধানেরা যুবরাজ সিরাজকে নানান উপটৌকন দ্বারা তাকে সংবর্ধনা জানান। আবার কলকাতার ইংরেজরাও এ খবর শুনে নানা উপহার নিয়ে হুগলিতে উপস্থিত হয়ে সিরাজকে দান করেন। এজন্য তাদের খরচ হয় ১৫৫৬০ টাকা। সিরাজও ইংরেজদের শিরোপা হিসেবে হাতি দান করেন। এসব খবর জেনে নবাব আলিবর্দিও খুশি হন। সুতরাং, উপরের বিষয়গুলি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, বয়সে নবীন হলেও সিরাজ রাজকাজে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ ছিলেন না, যুদ্ধবিদ্যাও তার কিছুটা জানা ছিল।
সুতরাং এহেন সিরাজ যখন আলিবর্দির উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব হলেন তখন তার পূর্বকৃত বিভিন্ন দুষ্কর্মের জন্য শত্রু পরিবেষ্টিত হয়েই মসনদে আরোহণ করলেন। বিভিন্ন হিন্দুগোষ্ঠী নবাবদের নানান অত্যাচার, ধর্মীয় বিধিনিষেধ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি কারণে এই বিদেশাগত নবাবদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েই ছিল; এর সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন নবাব সিরাজের নানা খামখেয়ালি কাজকর্ম। বিদেশি মুসলমান নবাবদের অত্যাচারে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমান শাসকদের হাত থেকে মুক্তি চাইছিল। তাই তারা এঁদের হাত থেকে মুক্ত হতে যে কোনো শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করতে তৈরি ছিল। নাটোরের রানি ভবানির কন্যা তারাসুন্দরী রাজশাহী-বাজুরাগ্রাম। নিবাসী রঘুনাথ লাহিড়ীর পত্নী ছিলেন। তিনি অপূর্বসুন্দরী ছিলেন; কিন্তু বালবিধবা। তার দিকে সিরাজের লোভ ছিল। সিরাজ হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন রানি ভবানির অপূর্বসুন্দরী বালবিধবা কন্যা তারাসুন্দরীকে হস্তগত করার অন্যায় প্রয়াসে। যদিও সিরাজ এতে সফল হতে পারেননি। সিরাজের দাদু আলিবর্দি খাঁ কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে একবার বন্দি করে রেখেছিলেন; তাই তিনিও ক্ষুব্ধ ছিলেন। সুতরাং, সিরাজ চারিদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়েই সিংহাসনে বসেছিলেন।
অনেক ঐতিহাসিক বলার চেষ্টা করেছেন যে সিরাজ সিংহাসনে বসার পরে নিজেকে পাল্টে নিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে তাদের বক্তব্য, সিরাজ তার মাসি যে কিনা তার সিংহাসনে বসার বিরোধী ছিলেন সেই ঘসেটি বেগমকে বুঝিয়েসুঝিয়েই বাগে আনেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, তাঁর অপর মাসি শওকত জঙ্গের সঙ্গে তার আচরণ। আগে কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজদের সঙ্গে আপোশমূলক নীতি গ্রহণ করলেও সিংহাসনে বসার পরে তাদের সঙ্গে সংঘাতের নীতিই গ্রহণ করেন; আরেকবিদেশি শক্তি ফরাসিদের সঙ্গে কিন্তু তিনি মিত্রতার নীতিই অবলম্বন করেন। তিনি ঔদ্ধত্য নিয়েই নবাবি চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর নবাব হওয়ার পরেও যে তিনি উগ্র মেজাজ বা নির্মম নিষ্ঠুরতা ত্যাগ করেননি তারও প্রমাণ আছে। তুলনায় স্বল্পজ্ঞাত এক কাহিনিতে। খুব সংক্ষেপে সেই কাহিনি ব্যক্ত করছি। সিরাজ-উদ-দৌলা নবাব হবার পরে প্রথমদিন দরবারে সিংহাসনে আসীন হয়েছেন। কোরাণ পাঠ অন্তে সকলে তাকে দোয়া করলেন, আক্রোবা বা জ্ঞাতিকুটুম্বগণ তাঁকে নজরানা দিলেন। এর পরে যাঁদের সম্মানিত করা আবশ্যক তাদের ‘খেলাত’ দেবার কথা। কিন্তু এসব হবার আগেই হঠাৎ সিরাজদৌলা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “এইক্ষণে আমি নবাব হইয়াছি কিনা?” সিরাজের প্রশ্ন শুনে রাজা রাজবল্লভ উত্তর দিলেন, “অবশ্যই হইয়াছেন এবং তাহা কেবল এখন নহে, আপনার মাতামহের জীবদ্দশাতেই আমরা সকলে আপনাকে নবাব বলিয়া বিবেচনা করিয়া আসিয়াছি।”
নবাব : আচ্ছা, তবে আমি এখন হুকুম প্রচার করিতে পারি?
দেওয়ান : তৎসম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। আপনি যাহাইচ্ছা হুকুম প্রচার করিতে পারেন।
নবাব : তবে আমার সম্মুখে আমার আতালিক (শিক্ষক) কুলি খাঁকে হাজির কর।
এর আগে সিরাজ যখন দাদু আলিবর্দির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল তখন সবাই তার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু যখন তারা শুনল যে, “তক্তে বসিবামাত্র, সকল কাজের পূর্বে সিরাজউদৌলা তাহার বাল্যকালের শিক্ষককে স্মরণ করিয়াছে” তখন ইহার প্রতি তাহাদের পূর্বর্সঞ্চিত কুসংস্কারগুলি দ্রবীভূত হইয়া দ্বিগুণভাবে ভক্তির উদয় হইল। সুতরাং, কুলি খাঁকে যখন ধরে আনা হলো, ফকিরেরা তাকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ভালো হোয়’ বলে দোয়া করতে লাগল। কুলি খাঁ এসে সিংহাসনের সামনে সেলাম করে দাঁড়াল। তাকে দেখেই সিরাজউদৌলা চোখ লাল করে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কে’ও হারামজাদা! তব তুঝে ইয়াদ নেহি থা কি হাম এক রোজ ইয়ে তকতপর বৈঠেঙ্গে!’ সবাই অবাক হলো, কেউ কিছুই বুঝল না। কেবল কুলি খাঁ সব বুঝল। তার অন্তর কাপতে লাগল। মূল কথা হলো, ছাত্রাবস্থায় কুলি খাঁ ছাত্র সিরাজকে পাত্রভেদ না করে প্রচণ্ড বেত্রাঘাত করেছিল। অন্য ছাত্র গুরুর বেত্রাঘাত সময়ে ভুলে যায় কিন্তু সিরাজ অন্য ধাতুতে গড়া। সে ভোলেনি। তাই কুলি খাঁ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সিরাজ জল্লাদ ডাকতে আদেশ করল। তবুও সকলে ভাবল, সিরাজ বুঝি খাঁকে বেত্রাঘাতের জন্য ডেকেছে। কিন্তু তাদের ঘোর ভাঙল যখন সিরাজচিৎকার করে জল্লাদকে বলল, “ইস বজ্জাতকো কতল করো।’ বেগতিক দেখে মিরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ প্রভৃতি কয়েকজন হাঁটু গেঁড়ে সিরাজকে তার হুকুম প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করলেন। এর পরের বর্ণনা আমার সাধ্যের বাইরে। খোলা দরবারে কুলি খাঁকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো সভাসদদের সামনে। সুতরাং যে সমস্ত ঐতিহাসিকের মতে সিরাজসিংহাসনে বসে পাল্টে যাবে তারা খুব সহজেই ওই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। মাত্রই চোদ্দ বা পনেরো মাসেই সিরাজ পাল্টে গেল। এট ভাবা বাতুলতা।
বলা হয়, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ হেরেছিল বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে। কিন্তু যে সমস্ত সভাসদ তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল তাদের মধ্যে যারা হিন্দু তারা তো বিদেশি নবাবদের রাজত্বে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যাচারিত হচ্ছিল তাদের নিজেদের দেশেই।তারা তাই স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি, অত্যাচারী নবাবদের শাসনমুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নিজে তো বিদেশি আফসার বংশসস্তৃত, বহিরাগত নবাব।তিনি নিজে একদিকে তার স্বার্থবিরোধী বলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হয়েছিলেন অন্যদিকে আবার অন্য বিদেশি ফরাসিদের সাহায্য নিয়েছিলেন। সুতরাং পলাশীর লড়াইটা স্বাধীনতার জন্য নয়; দুটি বিদেশি শক্তির আধিপত্যের লড়াই। একদল আগে এসেছিল; আর অন্যদল সাম্প্রতিক। আবার নবাব সিরাজ মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক জেনেও বারবার তাকে অব্যাহতি দিয়েছে। তার বাড়ি অবরোধ করেও আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে আনুগত্যের চুক্তি করেছে। পলাশীর যুদ্ধে মিরজাফর অংশগ্রহণ করবে না জেনেও তার অধীনে বিশাল সৈন্যবাহিনী এগিয়ে চলেছে তখন দেশপ্রেমিক মোহনলালের অনুরোধ না মেনে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের কথা শুনে যুদ্ধ বন্ধ করা এসবই সিরাজের দুর্বলচিত্ততার লক্ষণ। এই সব কারণেই ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধ জিততে পেরেছিল। এই যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য সিরাজ নিজেও বহুলাংশে দায়ী। আবার এই যুদ্ধে জিতলেও ফরাসি বণিকেরা প্রাধান্য পেত; ইংরেজদের বদলে ফরাসি প্রাধান্য স্থাপিত হতো। কেন জানি না, ঐতিহাসিকেরা এই দিকটি কেন এড়িয়ে যান।
সিরাজ-উদ-দৌলা স্বাধীনতা যোদ্ধা ছিলেন না কোনো ভাবেই। তিনি নিজেই ছিলেন বিদেশি; আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নির্ভর করেছিলেন আরেক বিদেশি শক্তি ফরাসিদের উপর।
বিনয়ভূষণ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.