মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তার কাছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রধানত দুটি প্রত্যাশা ছিল। এক, চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গ যে রাহুগ্রাসে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল তিনি তার থেকে রাজ্যবাসীকে মুক্ত করবেন। দুই, তার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ আবার শিল্পে, বাণিজ্যে, শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের একটি অগ্রগণ্য রাজ্যে পরিণত হবে। বলাবাহুল্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাম জমানাতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতি-সর্বস্ব একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। বাঙ্গালি সমাজের মাথা হয়ে উঠেছিল সমাজবিরোধীরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র চুরি, দুর্নীতি ও অপরাধমনস্কতার কারণে খবরের শিরোনাম হয়েছে। অযোগ্য ও অশিক্ষিত প্রশাসন এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধে দলদাস রাজনীতির অনুপ্রবেশ এই রাজ্যের আইডেন্টিটি হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আরও ভালো ভাবে বোঝা যাবে যদি আমরা করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বিচার করি। বস্তুত, করোনা ভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবীর বহু দেশ কম-বেশি বিপর্যস্ত। ভারতও মহামারী থেকে বাঁচতে পারেনি। রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ। প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষ। সংক্রামিত। সুস্থ হয়ে ওঠার হার প্রায় সত্তর শতাংশ এবং মৃত্যুর হার তিন শতাংশের কম হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হাল সাঙ্ঘাতিক। কারণ এখানে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে জায়গা নেই, কোনও অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র নেই, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলির অবস্থা খুব খারাপ। এই অবস্থায় মানুষের প্রশ্ন, আমরা তা হলে কোথায় যাব?
সম্প্রতি বেলঘরিয়ার শুভ্রজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতা আরও নগ্ন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে থাকা শুভ্রজ্যোতিকে নিয়ে ওর বাবা-মা চারটি হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন কিন্তু কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। কারণ হাসপাতালে জায়গা নেই। শেষে কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে শুভ্রজ্যোতির মা সুইসাইড করার হুমকি দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ ভর্তি নিতে বাধ্য হন। এবং তখন জানা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলেছিলেন। সেই সময় অন্তত তিনটি বেড খালি ছিল।চিকিৎসা শুরু করেও অবশ্য কোনও লাভ হয়নি। চোদ্দ ঘন্টা বিনা চিকিৎসায় থাকার ফলে শুভ্রজ্যোতিমারা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই ওর বাবা এই মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলেছেন এবং অভিযোগের আঙুল তুলেছেন প্রশাসনের দিকে। আশার কথা, একমাত্র সন্তানের এহেন মর্মান্তিক ‘হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে দাবি তিনি পেশ করেছিলেন আদালত তা অস্বীকার করেনি। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ, শুভ্রজ্যোতির দেহ রাজ্য সরকার পোস্টমর্টেম করে আদালতকে তার রিপোর্ট দেবে। এই নির্দেশ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, শুভ্রজ্যোতির কোভিড-১৯ ছিল বলে যে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেছেন আদালত তাতে ক্লিনচিট দেয়নি।
এখানে আরও একটি প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে বিনা চিকিৎসায় কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুর উদাহরণ কি শুধু শুভ্রজ্যোতি? নাকি, অনেকেই এভাবে মারা যাচ্ছেন কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অঙ্গুলিহেলনে চলা এ রাজ্যের মিডিয়া সেসব খবর বেমালুম চেপে দিচ্ছে? কারণ প্রশ্ন উঠেছে চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের মৃত্যু নিয়েও। একজন আটত্রিশ বছর বয়সি মহিলা শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়ার মাত্র আড়াই দিনের মধ্যে মারা গেলেন? বিশেষ করে তিনি অন্য কোনও অসুখে ভুগছিলেন কী না সেটা যেখানে স্পষ্ট নয়। কিংবা, প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে চন্দননগরেরই প্রাথমিক শিক্ষিকা সৌমী সাহার কথা। সৌমীর বয়সও বেশি নয়, মাত্র চৌত্রিশ। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বেশিদিন যুঝতে পারেননি। প্রশ্ন হলো, এরা যেসব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য ন্যূনতম যে ব্যবস্থা থাকা দরকার তা ছিল তো? এ কথা সর্বজনবিদিত পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসোলেশন ওয়ার্ড নেই, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই, তার থেকেও বড়ো কথা যথেষ্ট ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই। অন্যদিকে এসব নিয়ে সরকারি তরফে মিথ্যে তথ্যের অপর্যাপ্ত জোগান আছে। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত, অসহায়।
চাপ যত বাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ততই বালখিল্যের মতো আচরণ করছে। বস্তুত, করোনা ভাইরাসের ফাস গলায় চেপে বসা শুরু হওয়ার সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং একটার পর একটা দিশাহীন মন্তব্য করে গেছেন। তিনি কখনও বলেছেন লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন উঠেছে, এত মানুষ কীভাবে সংক্রামিত। হলেন? তিনি তার কোনও সদুত্তর দেননি। কখনও আবার হাসপাতালগুলিতে নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে উম্মা প্রকাশ করেছেন। অত্যন্ত হাস্যকর ভাবে বলেছেন যে একটি সাধারণ মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে নার্স তৈরি করতে মাত্র তেরোদিন লাগে। তাহলে কেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নার্স তৈরি করে নিচ্ছেন না? এর পাশাপাশি তিনি বলেছেন করোনা ভাইরাসকে পুরোপুরি বিদায় করা সম্ভব নয়। একে পাশবালিশের মতো মেনে নিতে হবে। আবার এই মূল্যবান পরামর্শ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি রাজ্যে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কোনও দায়িত্বশীল মুখ্যমন্ত্রী কি এই ধরনের বেলাগাম কথাবার্তা বলতে পারেন? অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও উদ্ধব ঠাকরে বাদে দেশের অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের কথা বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে না, পারেন না। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ, বিহারের নীতীশ কুমার ও ওড়িশার নবীন পট্টনায়কের মতো সদর্থক ভূমিকা নিতে পারতেন। তার জন্য তিনি সময়ও পেয়েছিলেন প্রচুর। তিনি চাইলে পাঁচতারা হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হল। ভাড়া নিয়ে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের সংখ্যা বাড়াতে পারতেন। হাওড়া, বারাসাত, কল্যাণী, দুর্গাপুর ও শিলিগুড়ির স্টেডিয়ামগুলিকে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপ দেওয়া যেতে পারত। এমনকী ভাড়া নেওয়া যেতে পারত ইডেন গার্ডেন্সও। লকডাউনে বন্ধ থাকা স্কুল- কলেজগুলিও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারত। কিন্তু এসব কিছুই হলো না। পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত অ্যান্টিজেন টেস্টই চালু হলো না। পর্যাপ্ত প্লাজমা ব্যাঙ্ক তৈরি হলো না, ল্যাব তৈরি হলো না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু পেটোয়া সাংবাদিকদের ডেকে নরেন্দ্র মোদীর নামে শাপশাপান্ত করে গেলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিশীহীনতা শুধু একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। পাশবালিশের যুগান্তকারী তত্ত্ব প্রচারের দিন তিনি অফিস-কাছারি খোলার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সব সরকারি অফিস এবং কিছু বেসরকারি অফিস খুলেও গিয়েছিল। কিন্তু এইসব অফিসের কর্মীরা কীভাবে যাতায়াত করবেন তার কোনও ব্যবস্থা মুখ্যমন্ত্রী করেননি। রাস্তায় বেশি বাস ছিল না। ট্যাক্সিওয়ালারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যে যেমন পেরেছেন দর হেকেছেন। সেই সময় থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত মানুষ বাধ্য হচ্ছেন বাসের গাদাগাদি ভিড়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে। বাসমালিকদের অভিযোগ, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মাত্র ২০ জন যাত্রী নিয়ে বাস চালালে তাদের লোকসান হবে। ভাড়া না বাড়ালে তাদের পক্ষে এই নিয়ম মানা সম্ভব নয়। বর্ধিত ভাড়া কত হতে পারে তাও তারা সরকারকে জানিয়েছিলেন। প্রস্তাবিত ন্যূনতম ভাড়া ছিল কুড়ি টাকা। বলাবাহুল্য, এই প্রস্তাব মানা কোনও সরকারের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি এবং ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বাসমালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ছিল। অথচ মমতা জিদ ধরে বসে আছেন। ভাড়া বাড়াবেন না। ফলে যথেষ্ট সংখ্যায় বাস রাস্তায় নামছে না এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানার জন্য সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বেসরকারি স্কুলগুলির ফিজের ব্যাপারেও চূড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছে। লকডাউনের সময় অনেক পড়ুয়ার বাবা-মা’র যেখানে চাকরি নেই অথবা থাকলেও তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না, সেখানে কেন বেসরকারি স্কুলগুলি ‘এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি’র মতো অদরকারি বিষয়কে বাধ্যতামূলক করবে তার কোনও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা সরকার বা স্কুল—কেউই দিতে পারেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতার বিখ্যাত জিডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশন স্কুলে এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি ফিজ বাবদ ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১২০০০ টাকা করে নেওয়া হয়। আর সেশন ফি বাবদ ৮৫০০ টাকা। অভিভাবকেরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। আপাতত এই ফি দুটি বন্ধ রাখা হোক। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার চালু করা যাবে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের কথায় কর্ণপাত করেননি। এমনকী, অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায় বসার সৌজন্যটু কু ও দেখাননি। বাধ্য হয়ে অভিভাবকেরা স্কুলের গেটের সামনে বিক্ষোভ দেখান। সরকারের ভূমিকা এক্ষেত্রে ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ গোছের। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেন যেন অযৌক্তিক ভাবে ফিজ না বাড়ানো হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপর। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের এহেন উদাসীনতায় অভিভাবকদের ক্ষোভের পারদ চড়েছে। ব্যাপারটা আন্দাজ করে সরকার আরেকবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে। সিবিএসই এবং সিআইএসসিই-কে (এইসব বেসরকারি স্কুলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) অনুরোধ করেছে হস্তক্ষেপ করার জন্য। কিন্তু এই দুটি সংস্থা শুধু টিউশন ফি’র ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। স্কুল অন্য কোনও ফি বাড়ালে বা পরিস্থিতির সাপেক্ষে বন্ধ না করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এদের নেই। এসব পার্থবাবুরা জানেন না, তা নয়। তবুও মানুষকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ফিজ না দিতে পারার জন্য বহু ছাত্র-ছাত্রীর অনলাইন ক্লাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকেরা অথৈ জলে পড়ছেন। কী করবেন জানেন না, কাকে বলবেন তাও ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। গত এক দশকে পরিবর্তনশব্দটি পশ্চিমবঙ্গে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় বেরোলেই চোখে পড়ে একের পর এক বিলবোর্ড। সেখানে তার হাসিমুখ। পাশে লেখা ‘বাংলার গর্ব মমতা। অন্তত কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়ে গেল বাঙ্গলার গর্বের বাঙ্গলার লজ্জায় পরিণত হতে আর বেশি দেরি নেই।
সন্দীপ চক্রবর্তী