জেলাটির নাম বর্ধমান হলেও, এই বর্ধমান নামটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে বিভিন্ন জনমত প্রচলিত আছে। কোনো কোনো মতে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান এই রাঢ় দেশে পরিভ্রমণে আসায় তাঁকে স্মরণে রাখতে তাঁর নামই এই জনপদের নাম হয় বর্ধমান। আবার অন্য মতে এই জনপদ ক্রমবর্ধমান ছিল বা দ্রুত বর্ধিষ্ণুতার কারণে এই জনপদটিকে বর্ধমান নামে অভিহিত করা হয়। তবে নাম নিয়ে বিতর্ক যাই থাক, একথা স্বীকার করতেই হবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় এই জেলায় শিক্ষা চেতনা সংস্কৃতির এক বর্ধমান প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়।
বর্ধমানবাসীদের বা বর্ধমান জেলার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যোগাযোগের কথা উঠলে সর্বপ্রথম এই যে জায়গাটার কথা মনে পড়ে সেটা হলো চকদিঘি। অধুনা পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার অন্তর্গত চকদিঘি গ্রামে বাস ছিল সিংহরায় পরিবারের। ইতিহাস থেকে জানা যায় আনুমানিক ৩০০ বছর পূর্বে উত্তরপ্রদেশ থেকে বঙ্গপ্রদেশে আসেন সিংহরায় পরিবার। এই চকদিঘি সিংহরায়। পরিবারের আদি পুরুষ এবং সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিংহ মোগল আমলে দশ হাজারি মানসবদার রূপে এই স্থানে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। সিংহরায় পরিবারের পূর্বসূরি বাবু সারদা প্রসাদ সিংহরায় মহাশয়ের সঙ্গে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিশেষ সখ্যের ইতিহাস চাকদিঘি অঞ্চলে সর্বজনবিদিত। বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণাতেই সারদা প্রসাদ। সিংহরায় বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক ও জনকল্যাণমূলক কাজ শুরু করেন— যেমন বহুবিবাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং স্ত্রী শিক্ষার প্রসার। চকদিঘিতে যে উচ্চবিদ্যালয় আছে তা বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা বর্তমানে সারদাপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন নামে খ্যাত। চকদিঘির জমিদার পরিবারের বসতবাটীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহুবার এসেছেন। তার জন্য জলমহলে একটি ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল। শোনা যায় একবার বিদ্যাসাগর মহাশয় অসুস্থ হলে চকদিঘির এই সিংহরায় পরিবারের বাগানবাড়িতে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম যাপন করেন। এখানে উল্লেখ্য শুধু বিদ্যাসাগরের নয় , সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমার শু্যটিং করার সময় বেশ কিছুদিন এই বাড়িতে ছিলেন। বড়লাট কার্জন মাঝেমধ্যেই এই বাড়িতে এসে থাকতেন। এছাড়াও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-সহ বহু গুণীজনের পদার্পণ ঘটেছিল এই বাড়িতে।
বর্ধমানের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের যোগাযোগের আরও একটা ইতিহাস পাওয়া যায়, সেটা হলো প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের সঙ্গে যোগাযোগ। ঈশ্বরচন্দ্র সস্কৃত কলেজে পড়ার সময় প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের কাছ থেকে সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ ও অলংকার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তাঁর পূর্ব পাঠের সামগ্রিক পর্যালোচনা করে দিতে, তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। ঈশ্বরচন্দ্রের মনন গঠনে তার স্বজনদের প্রভাব যেমন লক্ষ্য করা যায় , ঠিক তেমনই শিক্ষকদের বিশেষত প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের অসীম প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন বর্ধমানের শাকনাড়া গ্রামে।
প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ ছিলেন পালি ভাষায় দক্ষ। জেমস প্রিন্সেপের অনুরোধে অশোকের শিলালিপি পাঠোদ্ধারে সক্ষম হন প্রেমচন্দ্র। তার ফলে এ দেশে লুপ্ত বুদ্ধচেতনা জাগ্রত হয়। প্রেমচন্দ্রের ছাত্র থাকা কালে ঈশ্বরচন্দ্র তার মাতামহীকে দিয়ে বীরসিংহে একটি বোধিবৃক্ষ চারা রোপণ করে আজীবন সেটি সযত্নে রক্ষা করেন। ভারতে আধুনিক শিক্ষার দিশারি ডেভিড হেয়ার এবং প্রাচীন ঐতিহ্য সন্ধানী জেমস প্রিন্সেপ ১৮৪২ সালে মারা যাবার পর প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রিয় দুই ছাত্র ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের উত্তরসূরি হন।
১৮৬৭ সালে বর্ধমানে জ্বর মহামারী আকার নিলে বর্ধমান শহরের মুক্তমনা শিক্ষাবিদ গোলাম জাহেদির বাড়িতে স্বাস্থ্য শিবির স্থাপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর জনস্বাস্থ্য আন্দোলন সূচনা করেন। সেই সময়। বিদ্যাসাগর স্বয়ং গুরুতর অসুস্থ হলে তিনি স্বাস্থ্যচেতনা এবং চিকিৎসা ভাবনায় মগ্ন হন। তিনি ডাঃ দুর্গাচরণ ব্যানার্জি, ডাঃ তামিজ খান, ডাঃ গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখের সঙ্গে অ্যালোপাথি নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, ঠিক তেমনই বন্ধু রাজেন্দ্রলাল দত্তকে নিয়ে ডাঃ বেরিনীর কাছে হোমিওপ্যাথিও শিখছেন। বিদেশ থেকে হোমিওপ্যাথি বই আনিয়ে দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করছেন। এদিকে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার (এমডি) ছিলেন ঘোর হোমিওপ্যাথি বিরোধী। তুমুল যুক্তি তর্কের মধ্যে দিয়ে বিদ্যাসাগর ডাঃ সরকারকে হোমিও অনুরাগী করে তোলেন। সে সময়েই চিকিৎসা প্রচলনের অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয়।
পরবর্তীকালে বর্ধমানের যোগসূত্রে সাঁওতাল পরগনার তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল জব্বারের কাছ থেকে সাঁওতালদের ওপর ব্রিটিশ অত্যাচারের কথা সবিস্তারে জানার পর সেখানে একটি বাড়ির সন্ধান করতে বললে বর্ধমান নিবাসী আব্দুল জব্বারের প্রচেষ্টায় কাৰ্মার্টাড়ে একটি বাড়ি কেনা হয় এবং সেটির নামকরণ করা হয় নন্দনকানন। বিদ্যাসাগর এই বাড়িতে থেকেই নিজের ভগ্নস্বাস্থ্য উপেক্ষা করে সাঁওতালদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবিকার জন্য বাকি জীবন উৎসর্গ করেন। উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগরের আলোয় আলোকিত বর্ধমানের আব্দুল জব্বার স্যার আশুতোষের সুপারিশে মুসলমান সমাজের শিক্ষা প্রসারে উজ্জ্বল ভূমিকার জন্য ১৯০৯ সালে নবাব উপাধি পান।
বর্ধমানের বিদ্যাসাগর যোগে আরেকটি নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি হলেন জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞান সাধক আচার্য গিরিশচন্দ্র বসু। আচার্য বসু ১৮৫৩ সালের ২৯ অক্টোবর বর্ধমান জেলার জামালপুর থানায় অবস্থিত বেরুগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন উদার প্রকৃতির বিদ্যানুরাগী। তাঁর প্রচেষ্টায় আচার্য গিরিশচন্দ্র ১৮৭৬ সালে হুগলি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাশ করেন। সে সময়ে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর উড্রো সাহেব তাকে কটকের রাভেনশ কলেজের বিজ্ঞান। বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি এমএ পাশ করেন, অবশ্য তার আগে ১৮৭৭ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বর্ধমান নিবাসী প্যারীচরণ মিত্রের কন্যা নীরদ মোহিনীর সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই বৈবাহিক সূত্রে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখমনীষীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য আচার্য গিরিশচন্দ্র ১৮৮১ সালে বিদেশ যাত্রা করেন এবং ১৮৮৪ সালে শিক্ষ সমাপন করে দেশে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি উচ্চ সরকারি চাকরির উপেক্ষা করে বাঙ্গলায় শিক্ষা বিস্তারের কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। ১৮৮৫ সালে সরকারের সাহায্য ছাড়াই তিনি বউবাজার স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে ৬ জন শিক্ষক এবং ১২ জন ছাত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবাসী স্কুল।
দু বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় ও পরামর্শে এই প্রতিষ্ঠান বঙ্গবাসী কলেজ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সালে এই কলেজ তার বর্তমান ঠিকানা ১৯ স্কট লেন (বর্তমান নাম, রাজকুমার চক্রবর্তী সরণি), শিয়ালদহে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গলায় কৃষি শিক্ষা প্রচার ও প্রসার। বঙ্গবাসী কলেজ সারা বাঙ্গলায় প্রথম স্বদেশি কলেজ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়।
ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গলার নবজাগরণের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ঈশ্বরচন্দ্রের বিপুল কর্মদ্যোগের আলোকে বাঙ্গলা তথা ভারতবর্ষের সমাজ যখন অলোকিত, বর্ধমান তার ব্যতিক্রম নয়। একই সঙ্গে ভারতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জনককে প্রতিনিয়ত পরিপূর্ণ করতে থাকা বর্ধমানের কৃতী সন্তানদের অবদানও স্মরণীয়।
ডাঃ বলরাম পাল