বসন্তের রোদ্দুরে বিকৃতির গ্লানি

এ কোন সকাল ? রাতের চেয়েও অন্ধকার?

সকাল মানেই তো রোদ। রোদ্দুর। কিন্তু রোদ্দুর রায় মানে? নিকষ কালো আঁধারের চাদর। যে চাদরের নীচে প্রতিদিন একটু একটু করে বিকৃত হচ্ছে বাঙ্গলার কৃষ্টি, বাঙ্গলার সংস্কৃতি, বাঙ্গলার ঐতিহ্য, বাঙ্গলার পরম্পরা। সে আঁধারের প্রভাব এতটাই যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট বসন্তোৎসবে খোদ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রামধনু রঙে রঙিন হয়ে লজ্জা-বিবর্জিত যৌবনবতীরা পিঠে বাঁ..উঁদ উঠেছিল গগনে’ লিখে ঘুরে বেড়ায় সপাটে রবীন্দ্রনাথের মুখেই থাপ্পড় মেরে। সে আঁধারের প্রভাব এতটাই যে চার নাবালিকা কিশোরী মালদার মতো মফস্‌সল শহরের খোলা রাস্তায় পাশের বাড়ির কাকুকে নিয়ে বানানো যৌনতার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয় নির্ভয়ে নির্দ্বিধায়। আর ভিজে কাকের মতো চেহারা নিয়ে যে লোকটি (তিনি অবশ্য নিজেকে তরুণভাবতেই বেশি আগ্রহী) নিজেই ভাইরাস হয়ে ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় বিষের আতর, সেই রোদ্দুর রায় ফেসবুকে নিজেকে জাহির করে ‘পরিবর্তনকামী সাংস্কৃতিক কর্মী’, ‘প্রতিবাদী সমাজ সংস্কারক’ বলে। ভগবানের মুখোশ পরে চোরের ধর্মকথা শোনানোর নাটক করে। সেই রোদ্দুর রায় হিংস্র দাঁতালের মতো ধবংস করে সংস্কৃতির সবুজতাকে, সারল্যকে, নমনীয়তাকে। এমনকী সামাজিকতাকেও – যে সামাজিকতা সেই সরস্বতী সভ্যতা বা তারও আগে থেকে ধরে রেখেছে ভারতীয় সভ্যতাকে।

কে এই রোদ্দুর রায়?

রোদ্দুর রায় কোনো বিশেষ বা বিশিষ্ট ব্যক্তি নন। রোদ্দুর রায় একটি নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক প্রতিষ্ঠান হয়তো বিদেশি মদতপুষ্ট।

যে প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো খেউড়কে অস্ত্র করে বাঙ্গলার অপুষ্ট তরুণ- তরুণীদের মানসিক এবং শারীরিক বিপর্যয়ের শিকার করে তোলা। মুঠো মুঠো টাকা রোজগারের ধান্দায় যে প্রতিষ্ঠানটি ইউটিউবকে বাহন করে এবং অবশ্যই এই প্রতিষ্ঠানটি হয় সরকার অথবা কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের বাহুবলে বলীয়ান। অনেকেই বলছেন– রোদ্দুর রায় একটা আস্ত পাগল। এদের মতো লোককে পাত্তা না দেওয়াই ভালো।

ভুল হচ্ছে। লোকটিকে পাগল ভাবলে ভুল হবে। ইনটেলেকচুয়াল ভাবলেও ভুল হবে। রোদ্দুর রায় একজন দক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি ধ্বংসকারী এজেন্ট বা দালাল। তা নাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছ্যাঃ ছ্যাঃ ধ্বনি উঠে যাওয়ার পরও, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক ঐক্য যুক্ত মঞ্চ বেলেঘাটা থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরেও, এমনকী যাদের ব্যবহার করে অসংস্কৃতির বীজ ছড়িয়ে দিয়েছেন রোদ্দুর, সেই সব তরুণ-তরুণী বা কিশোরীরা প্রকাশ্যে মুচলেখা দিয়ে ছাড়া পেলেও রোদ্দুর রায়ের গায়ে হাত পড়ে না প্রশাসনের। লজ্জায় ঘৃণায় রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য পদত্যাগ করলেও সরকার সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে না। রোদ্দুর রায়কে সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রেপ্তারের দাবির বিরুদ্ধে হুমকি দিলেও সরকার থাকে অবিচল।

মুশকিলের শেষ এখানেই নয়। মুশকিল হলো সমাজের চোখ বুজে থাকা কিছু সাধারণ মানুষ, অতি বোদ্ধা, কিছুই না বুঝে ওঠার মানসিকতা সম্পন্ন কিছু ব্যক্তি এবং সরাসরি রোদ্দুর রায়ের সমর্থকরা যখন বলে ফেলছেন— ছ্যাড়ান দ্যান, পোলাপানের কাণ্ড। এমনটা তো হইবই’, যখন কেউ কেউ বলছেন, গানের প্যারডি তো চিরকালই হয়ে এসেছে, রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা নিয়ে প্যারডির অভাব নেই, তাহলে রোদ্দুরের অপরাধ কোথায় ? তসলিমা নাসরিনের মতো ব্রান্ডেড লেখিকা যখন পরজীবী হয়েও দাবি তোলেন, কে বলেছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যরস করা যাবে না? কেউ বলছেন, সমাজ বদলে যাচ্ছে, তাহলে ভাষাই বা বদলাবে না কেন? তসলিমা তার মেয়েবেলা’-র স্বরেই খোলামেলা প্রশ্ন তুলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের যুগে ছোটরা বড়োদের চোখে তাকিয়ে কথা বলত না, এখন ছোটোরা বাপকেও বলে দেয়— ফাক, হোয়াট বা বুলশিট। এসবকে যদি আমরা আধুনিকতা, স্মার্টনেস বলি, তবে মেয়েদের পিঠে হাস্যরসের জন্য লেখা বাঁ…চাঁদ উঠেছে। গগনে দেখলে আমরা আঁতকে উঠি কেন? কে বলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যরস করা যাবে না? ভগবানকে নিয়ে করা যায়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করা যাবে না কেন?

না, আমরা কোনো যুক্তিকেই এড়িয়ে যেতে চাই না। বরং অন্ধত্বকে দূর করার জন্য দুটো কথা বলতে চাই। ওইসব অন্ধদের হাজার সমালোচনার ঝড়ের মুখেও যাঁরা বলছেন, ‘পোলাপানের কাণ্ড’ (অনেকটা ওই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন একটি ধর্ষণের ঘটনাকে ‘বাচ্চা ছেলের কাণ্ড’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন) তারা শুনে রাখুন— ওই পোলাপান একদিন আপনার ঘরেও বেড়ে উঠবে। আজ যে গান গাইছে, দুদিন পরে সে ধর্ষক হয়ে উঠবে। আজ সে পিঠে খিস্তি লিখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দুদিন বাদে সেই-ই আপনার বাড়ি ফিরবে মাঝরাতে। সহ্য করতে পারবেন তো?

যারা বলছেন, গানের প্যারডি তো হতেই পারে, তারা জেনে রাখুন রোদ্দুর রায় যা করেছেন তা প্যারডি নয়, বারলেস্ক। প্যারডি হলো নিছক মজা করার জন্য শুদ্ধ ভাষায় ব্যঙ্গ করা। আর বারলেস্ক হলো—…a literary, dramatic or musical work intended to cause langhter by caricatering the manner of sprit of serious works or by ludicrous treatment of their subjects. অর্থাৎ রোদ্দুর রায় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে প্যারডি রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি প্যারডি রচনা করতে গিয়ে যে ভাবে অপরিমিত আক্রমণ হেনেছেন খিস্তি এবং খেউড় দিয়ে তা হাংরি জেনারেশন বা অ্যাংরি জেনারেশনের সাহিত্যকেও হার মানায়।

কেউ কেউ বলেছেন, বাঙ্গালির সংস্কৃতি মানেই কি রবীন্দ্রনাথ ? নাকি রবীন্দ্রনাথকে গালাগাল দিলেই বাঙ্গলার সংস্কৃতি শেষ।

আমি বলব—হ্যাঁ ঠিক তাই। মহাত্মা গান্ধী যেমন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আইকন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি ভারতীয় সংস্কৃতির আইকন। রবীন্দ্রনাথকে ধুয়ে মুছে শেষ করার চেষ্টা করার মানে বাঙ্গলার সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেওয়া।

অস্বীকার করব না, রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকে ভালোবাসাটা বাঙ্গালি সমাজের একাংশের কাছে পণ্য। তাই আরও একটা রবীন্দ্রনাথ জন্ম নেন না। কিন্তু একথাও অস্বীকার করব না, ওই একাংশটা আয়তনে এতটাই ক্ষুদ্র যে তা মলিকিউলার ফার্মেই অবস্থান করে। চোখে। পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ মাখামাখি হয়ে আছেন বাঙ্গলার চিন্তায়, ভাবনায়। মননে, চিন্তনে। চরম গ্রীষ্মে, ভরা বর্ষায় অথবা গভীর শীতের আবেষ্টনেও।

রোদ্দুর রায়ও রবীন্দ্রনাথকে পণ্য হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর মননে চিন্তনে পরিশুদ্ধভাবে অবস্থান করছেন না রবীন্দ্রনাথ। সোজা কথা—এতকাল কিছু মানুষ শুদ্ধতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ব্যবসা করেছেন। রোদ্দুর রায় সেই শুদ্ধতার মুখে থাপ্পড় মেরে অশ্লীলতার মোড়কে রবীন্দ্রনাথকে বন্দি করে ‘বেওসা’ করতে নেমেছেন। এ ধরনের প্রতিভাকে মাথায় তোলা যতটা অন্যায় ঠিক ততটাই অন্যায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। কারণ রোদ্দুর রায় মানে বিষ। বিষাক্ত ভাইরাস। রোদ্দুর রায়রা সংগোপনে বেড়ে ওঠে। তারপর ছড়াতে থাকে সমাজের পরতে পরতে। এদের মুখ থাকে না। থাকে মুখোশ, যে মুখোশের মুখ দিয়ে মানবতার বাণী ঝরে ফুটপাতবাসীর জন্য, ধর্ষিতা নারীর জন্য, অর্থের অভাবে শিক্ষায় অপুষ্ট নারী পুরুষের জন্য। অথচ ওই মুখোশই ফুটপাতবাসীকে ঘরের সন্ধান দিতে আগ্রহীনয়, ধর্ষিতা নারীকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা না দিয়ে আরও পাঁচটা নারীকে ঠেলে দেয় যৌনতা সর্বস্ব পৃথিবীর দিকে। শিক্ষার আলোয় অশিক্ষিত নারী পুরুষকে আলোকিতনা করে সমাজের শিক্ষিত সমাজকেই অশিক্ষিত করে তোলে। আর বাঙ্গালির সর্বংসহা মনোভাবকে পুঁজি করে দুর্বলতা বেচে রোজগার করে চলেন অবলীলায়।

আমার মনে পড়ছে, হাংরি জেনারেশন যুগে বাংলা সাহিত্যের জগতে কফি হাউস সর্বস্ব হাংরি জেনারেশনের রমরমার সময়ে একটা স্লোগান উঠেছিল– ‘ছাঁচ ভেঙে ফ্যালো’। ওইসব সাহিত্যিকরা বলতেন রবীন্দ্রনাথের মতো আগাছা সর্বত্রই গজাতে পারে। ছাঁচ ভাঙতে গিয়ে নিজেরাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছেন। সাহিত্যপ্রেমীরা তাদের কাজ তো দূরের কথা, নামও মনে রাখেনি। রোদ্দুর রায়ও সাময়িক। তফাত একটাই— হাংরি জেনারেশন বা অ্যাংরি জেনারেশন সত্যিই কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন সাহিত্যকে ভালোবেসে। এরা কেউ মুখ ছিলেন না। বদমাইশ তো ননই। রোদ্দুর রায় মূখ এবং বদমাইশ। যাঁরা বলছেন, রোদ্দুর রায় এক্সপ্লোরেটর বা আবিষ্কারক, যাঁরা তাকে বিদ্যাসাগর, রামমোহন কিংবা ডিরোজিওর মতো সমাজ সংস্কারের অবতার হিসেবে সম্মান দিতে চাইছেন, তারা আরও বেশি মূখ। আরও বেশি বদমাইশ। কারণ তারা রোদ্দুর রায়কে ব্যবহার করছেন সমাজকে ধ্বংস করার জন্য। সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য। সেই সঙ্গে ‘বেওসা’ করে দু’পয়সা রোজগারের জন্য। এঁদের মধ্যে আছেন নব্য স্বাধীনচেতা বামপন্থীরা। আছেন মানবতাবাদীরা।

আছেন মানবাধিকারবাদীরাও। এঁরা সমাজের Change Agent বা পরিবর্তন প্রতিভূর পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চাইলেও আসলে এঁরা যে পরিবর্তন আনতে চাইছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের ২০১১ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মতোই নেতিবাচক পরিবর্তন অথবা এখন বামপন্থীরা সামাজিক জনবিন্যাসে যে পরিবর্তন আনতে চাইছেন, সেই পরিবর্তনের মতো।

রোদ্দুর রায় এদেরই প্রতিভূ। ইনি হাস্যরস আর খিস্তিখেউড়ের তফাত বোঝেন না কিংবা বুঝতে চান না। তাই সগর্বে খিস্তির সুরে বলেছেন, তিনি নাকি আর্ট আন্দোলন করছেন। বাংলাপ্রেমী শিল্পী ‘বাঙ্গলা রক্ষায় নেমেছে— ওই ‘বাঙ্গলার ত্রাতা’ গর্গ চ্যাটার্জি কিংবা বামপন্থী শতরূপ ঘোষের মতো যারা রোদ্দুর রায়ের কাগের ঠ্যাঙ বগের ঠ্যাঙ কবিতার বইয়ের উদ্বোধনে হাজির ছিলেন সগর্বে। রোদ্দুর রায় ওই গর্গদের গর্তেই বসবাসকারী এক বিজাতীয় মানুষ। না, কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সভ্যতা নয়। রোদ্দুর রায় যদি প্রতিষ্ঠান হন তাহলে গোটা পরিবেশটারই ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। ভুলে। যাবেন না, যে রবীন্দ্রনাথকে খিল্লি করে উনি আজ ইউটিউব থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করছেন, সেই রবীন্দ্রনাথই ওনার মূলধন। অর্থাৎ তোমার খাব– তোমারই ক্ষেতে চোরকাটার বীজ ছড়াব। এরা তাই নদর্মর কীট ছাড়া কিছুই নয়। এখনও যাঁরা স্রেফ মজার জন্য রোদ্দুর রায়ের গান শুনছেন, এখনও যাঁরা সমর্থন জোগাচ্ছেন তাদের অনুরোধ করব— সাবধান হয়ে যান। চন্দ্রবোড়ার বিষ খুব ধীরে ধীরে শরীরে ছড়ায়। কিন্তু যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন আর কিছু করার থাকে না। মৃত্যু হয়ে ওঠে অনিবার্য পরিণতি। অথবা সারাজীবনের মতো পঙ্গুত্ব হয়ে ওঠে শরীরের অলংকার।

আপনি যদি নেতিবাচক মানসিকতার মানুষও হয়ে থাকেন, বলব— নিজেকে পরিবর্তন করুন। সনাতনী ঐতিহ্যের সঙ্গে থেকে সুস্থতার সন্ধানে নামুন। পরিবর্তন সে তো সব সময়েই কাম্য। কিন্তু নিশ্চয়ই তা দেশ, সমাজ, মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়। দুঃস্বপ্নের অন্ধকারময় রাত্রির ঘাম মেখে জেগে থাকার জন্য নয়। পরিবর্তন আসুক খাঁটি সোনার মতো রৌদ্রকিরণে। ভেজা কাকের মতো রোদ্দুর রায়ের বিকৃত ঢঙে নয়।

সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.