অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের এই দ্বিতীয় বাজেটে উপস্থাপনের প্রেক্ষাপটে ছিল উপর্যুপরি ৬টি ত্রৈমাসিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিম্নগামিতা। অন্যদিকে বাৎসরিক বাজেট ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট ছিল সরকারি খরচ আরও বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেগবান করার চেষ্টা করলে সেই ঘাটতি আরও ব্যাপক হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও ছিল।তবুও ২০২০-২১ অর্থবর্ষের এই সম্ভাব্য আগাম হিসেব-নিকেশকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ চড়ছিলই। এর মূলে ছিল আগে বলা কী পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট তৈরি করার বাধ্যবাধকতা ছিল। অর্থনীতিতে তিনটি নির্দিষ্ট ক্ষতিকারক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল—(১) বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নজরে পড়ার মতো শ্লথতা, (২) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড়োসড়ো নিম্নমুখিতা, (৩) অর্থনৈতিক পদ্ধতির ওপরই একধরনের চাপ। এই বিষয়গুলি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত গতি ফেরাবার বুনিয়াদ তৈরি করতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেগুলির দিকেই ছিল নজর। কেননা এই পথ নির্দেশ ঠিক না করতে পারলে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতিতে পৌঁছনোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
গোটা বাজেট প্রস্তাবে অর্থনীতিতে স্লো-ডাউনের বিষয়টি একবারও উল্লেখ না করলেও বাজেটের অভিমুখ নিঃসন্দেহে শুভ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বাজেটের মাধ্যমে বহুমুখী উন্নয়নের যে পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে তার রূপরেখা সবিস্তারে দেওয়া হয়েছে। এই সূত্রে সরকারি তহবিল থেকে ক্ষেত্র অনুযায়ী খরচের যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে তা থেকে বাজারে চাহিদার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটানোর যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। একইভাবে খরচের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব ঘাটতিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার বিবরণের মাধ্যমে এই ধরনের খরচ যে আদতে ফলদায়ী ও দীর্ঘমেয়াদিভাবে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সহায়ক হবে তাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অবশ্য এই পরিকল্পনার ওপর আমরাও পুনদৃষ্টিপাত করব।
এই বছরের রাজস্ব ঘাটতি ৩.৮ শতাংশ থাকবে এটাই ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে ২০২০-২১-এর। প্রস্তাবিত বাজেটে এই ঘাটতি ৩.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে ঘাটতি জিডিপি-র ৩ শতাংশের ওপর না যাওয়ার যে অলিখিত বিধি আছে ৩.৮ বা ৩.৫ শতাংশের মাত্রা রাখায় তালষ্মিত হলেও বাজারে চাহিদার পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে যেখানে সরকারের তরফে বড়ো ধরনের খরচ করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে সেই নিরিখে এই উলঙ্ন অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু একটাই কথা এই ৩.৫ শতাংশের প্রস্তাবিত ঘাটতির মধ্যেই কি অর্থনীতিকে ধরে রাখা যাবে ?
বাজারের মুদ্রাস্ফীতির হার ও অন্যান্য কিছু অর্থনীতির জরুরি বিষয়কে বাদ দিয়ে। ২০১৯-২০-তে নামমাত্র জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ। এটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। মোট কর আদায়ে আগামী বর্ষে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি ধরা হয়েছে।
এ থেকে পরিষ্কার এই যে, প্রস্তাবিত পূর্বানুমান তা এই বছরের ১০ শতাংশের জিডিপি (নামমাত্র) বৃদ্ধির থেকে আগামী বছরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে (করে ১২ শতাংশ বড়তি আদায় হওয়ার কারণে)। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে বিলগ্নীকরণের ওপর নির্ভরতা বিপুল। এক্ষেত্রে এল। আই সি-র শেয়ারের একটা অংশ বিক্রি থেকে বড়ো অর্থাগমের সাফল্য আসবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে অতীতে একবারও বিলগ্নীকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব কিন্তু কঠিন। তাদের সব সময় কড়া নজর রাখতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রগুলিতে যেন কোনো ফঁাক না থাকে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হলেই বাড়তি খরচ যা করা হবে তার সঙ্গে তাল মেলানো যাবে না। রাজস্ব ঘাটতিকে প্রস্তাবিত সীমায় ধরে রাখতে এই সতর্কতা জরুরি। বস্তুত, খরচের যে মাত্রা ধরা হয়েছে তার প্রভাবে রাজস্ব ঘাটতির। ৩.৫ শতাংশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। এক্ষেত্রে আগে বলা ৩-এর ওপর .০৫ বা ০৮ শতাংশের যে বাড়তি মাত্রাকে মোটামুটিভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে তাকে টপকে যাওয়া আদৌ গ্রহণীয় হবে না। আশা করা যায় তেমন পরিস্থিতি সরকার এড়াবারই চেষ্টা করবে যাতে না আর বি আই-কে আবার বাজারে সরকারি ঋণপত্র বেচে টাকার ঘাটতি মেটাতে সরকারকে সাহায্য করতে হয়।
কর ব্যবস্থায় কয়েকটি পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক মাস আগেই কোম্পানি করের ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট নমনীয়তা দেখিয়ে কর হার কমিয়েছে। এই বাজেটে ব্যক্তিগত করের ক্ষেত্র সরলীকরণ করতে সরকার বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছে। এর প্রভাব হয়তো খুব ব্যাপক হবে না। আমার ধারণায় কর হার কমানোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ছাড় প্রত্যাহার করে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে দু’ ধরনের ব্যবস্থা চালু রেখেছে। তা ভবিষ্যতে আরও সংশোধন করা দরকার। কোন ধরনের বিকল্প মধ্যপন্থার বদলে কেবলমাত্র বিভিন্ন স্তরে করের মাত্রাভেদই থাকবে, ছাড় নয়। বাজেটে এমন কিছু প্রস্তাব রয়েছে যার ফলে বিদেশ থেকে টাকা আসার পথ সুগম হবে। কোম্পানি তার লাভের ওপর সরকারকে কর দেয়, আবার শেয়ার হোল্ডারদের সেই লভ্যাংশ বিতরণের ওপর আবার যে কর আদায় করা হতো তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে বিদেশ থেকে ভারতীয় টাকায় সরকারি ঋণপত্র কেনার ছাড়পত্র দেওয়া। হলেও এই ঋণপত্র মাত্রাছাড়া ভাবে বিক্রি করলে সরকারি দেনা বেড়ে যাবে।
অবশ্যই অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে কীভাবে, কী মাত্রায় খরচের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা বোঝাতে যথেষ্ট মনঃসংযোগ করেছেন। এখন ক্ষেত্র বিশেষজ্ঞরা পর্যালোচনা করবেন এই খরচগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড়ো কথা, শেষমেশ প্রকল্পগুলি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রচলিত ব্যবস্থায় শুরু হওয়া সংস্কারগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি। যেমন, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যাঙ্কের কোনো একটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে বিলয় ঘটিয়ে দেওয়াই মুখ্য বিষয় নয়। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সরকারি ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলির সার্বিক মালিকানার কত শতাংশ সরকার তার হাতে রাখবে। এই সূত্রে আইডিবিআই-এর বেসরকারিকরণের প্রস্তাব ইঙ্গিতবহ। তবুও আরও পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, সরকারি ব্যাঙ্কগুলির পরিচালন পর্ষদের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সুনিশ্চিত করা দরকার। মনে রাখতে হবে কেবলমাত্র প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ হলেই সংস্থার উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায় না। তা নির্ভর করে সংস্থার মূলগত ধাচার ওপর। আবার বলছি এই বাজেট থেকে চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া ও সার্বিক সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে যাতে মূলধন সৃষ্টি হয় এই দুটি প্রত্যাশা ছিল। এক্ষেত্রে সরকার যে ছাঁচ তৈরি করেছে, যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে তা নিশ্চিতভাবেই অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধির পূর্ণ সহায়ক। যদি এই খরচগুলি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পূর্ণ উদ্যোগ, সততা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে বাস্তবায়িত হয় তাহলে লক্ষ্য পূরণের পথে অগ্রগতি নিশ্চিত। রূপায়ণই হচ্ছে শেষ কথা। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিনিয়োগ (শিল্প), এক্ষেত্রে সরকারের অংশগ্রহণ এখনও সীমিত। ২০২০-২১-এর বাজেটে যে ৩.৫ শতাংশ প্রস্তাবিত ঘাটতি ধরা হয়েছে তার ২.৭ শতাংশই হলো চলতি খাতে (আমদানিরপ্তানি, কর আদায়, পরিকাঠামো, নির্মাণ পরিষেবা, ভরতুকি ইত্যাদি)। বিনিয়োগ খাতে খরচের জন্য ঘাটতি নগণ্য।
মনে রাখতে হবে, সরকারের মূলধনী খরচের বেশিরভাগটাই বাজেটের বাইরে থেকে আসা সম্পদের ভিত্তিতে। সেই কারণেই বেসরকারি বিনিয়োগ আসার গুরুত্ব অসীম। এই বাজেটের সামগ্রিক প্রভাব কি বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে উজ্জীবিত করবে? আশা করতেই হবে।
সি. রঙ্গরাজন
(লেখক আর বি আই-এর পূর্বর্তন গভর্নর)
2020-02-12