বনবাসী ভারতের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

তৃসত্য পালনে শ্রীরাম চোদ্দ বছরের জন্য বনে গিয়েছিলেন। তারপর সম্মুখ যুদ্ধে রাবণকে বধ করে পত্নী সীতা এবং সহােদর লক্ষুণ-সহ অযােধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেইসময় বা তার পরবর্তীকালে সহস্রাধিক বছর পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরও একবার ঘটতে পারে। কিন্তু এমন একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। এবং এমনভাবে ঘটেছিল যাতে কোনও ব্যক্তিবিশেষ নন, একটি দেশ বা আরও স্পষ্ট করে বললে সমগ্র একটি জাতি বনবাসে গমন করতে বাধ্য হয়। দেশটির নাম ভারতবর্ষ। আর জাতির নাম হিন্দু। মধ্য এশিয়া থেকে এসে বাবর নামের এক লুটেরা হিন্দুদের বাধ্য করেছিল নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকতে। এই পরবাস ছিল বনবাসেরই নামান্তর। গত ৫ আগস্ট অযােধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপূজনের মাধ্যমে শেষ হলাে ভারতবর্ষের পাঁচ শতাব্দীর বনবাস। বনবাসী ভারত ফিরে পেল তার দেশ। তার স্বাভিমান। হাজার বছরের ইসলামিক শাসন, দু’শাে বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং সত্তর বছরের ব্রিটিশ মডেলের দেশীয় শাসনের নৈরাজ্য পেরিয়ে ভারতবর্ষ স্বাদ নিল তার নিজস্ব জাতিসত্তার।

প্রশ্ন উঠবে, ভারতীয় জাতিসত্তার সঙ্গে রামমন্দিরের ভূমিপূজনের কী সম্পর্ক? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে। আমাদের বুঝেনিতেহবেরাষ্ট্র এবং দেশের পার্থক্যটি। যে কোনও ভূখণ্ডকেই সেখানকার অধিবাসীদের দেশ বলা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র বলা চলে না। একটি রাষ্ট্রের ভৌগােলিক অস্তিত্ব তাে থাকতেই হবে। সেইসঙ্গে থাকতে হবে একটি প্রাচীন সংস্কৃতিসম্পন্ন পরম্পরা। থাকতে হবে তার নিজস্ব অস্মিতা। অর্থাৎ জ্ঞান এবং সংস্কৃতি, ইতিহাসও। এই অর্থে ভারত একটি রাষ্ট্র। কিন্তু পাকিস্তান নয়। কারণ পাকিস্তানের যে অস্মিতা তা মূলত ভারতেরই। নিজস্ব জ্ঞান এবং সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ। মানবগােষ্ঠীই কালক্রমে জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়। তাই । যে-অর্থে জার্মান, ফরাসি, ব্রিটিশরা একেকটি জাতি, সেই একই অর্থে হিন্দুরাও একটি জাতি। নিজস্ব জাতিসত্তার অধিকারী। পার্থক্য শুধু একটি জায়গায়। বিশ্বের প্রতিটি জাতির এক বা একাধিক জাতীয় নায়ক থাকেন। যারা তাদের চরিত্র দিয়ে, আদর্শ দিয়ে সমগ্র জাতিকে একসূত্রে বেঁধে রাখেন। একটি জাতির। জীবনবােধ কিংবা মানসিক গঠন কেমন হবে তার অনেকখানি পরিচয় পাওয়া যায় তাদের জাতীয় নায়কের জীবন বিশ্লেষণ। করলে। উদাহরণস্বরূপ, মাওকে যদি চীনের জাতীয় নায়ক হিসেবে গ্রহণ করি তা হলে আজকের চীনের নৃশংস এবং অত্যাচারী কার্যকলাপের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। যাই হােক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ভারতীয়দের জাতীয় নায়কের জায়গায় বহু প্রাচীন কাল থেকেই শ্রীরামের অবস্থান। কারণ তিনি আনুমানিক সতেরাে হাজার বছর আগে নানান জাতি-উপজাতিতে বিভক্ত ভারতীয়দের এক ছাতার নীচে এনেছিলেন। উদ্দেশ্য, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। আমাদের। মনে রাখতে হবে, সেযুগে রাবণ ছিলেন প্রবল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সন্ত্রাসবাদী শক্তিও বলা যেতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত রাবণের ভয়ে কাঁপত। সীতা-উদ্ধার উপলক্ষ্যে শ্রীরাম প্রবল পরাক্রমী রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিলেন। এবং রাবণকে বধ করে দক্ষিণ ভারতের একাধিক জনপদকে রাবণের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু এটুকুই কি জাতীয় নায়ক হবার জন্য যথেষ্ট?

অযােধ্যায় ফিরে তিনি রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং স্থাপন করেছিলেন প্রজাকল্যাণের অনুপম দৃষ্টান্তসমূহ। আজও আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ দেবার সময় রামরাজ্যের কথা বলা হয়। পুত্র, স্বামী, ভ্রাতা, পিতা ও সম্রাট-পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ভূমিকাতেই তিনি আদর্শ, মর্যাদাপুরুষােত্তম। ভারতবর্ষের জাতীয় নায়ক। এ দেশে মুঘল সলতনত কায়েম করেই বাবর শ্রীরামের সর্বময় উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন হিন্দুদের জাতিসত্তার মেরুদণ্ডটি ভাঙতে হলে আগে শ্রীরামের ভাবমূর্তিটি নষ্ট করতে হবে। নয়তাে হিন্দুস্থানকে গােলাম বানানাে যাবে না এবং সেইজন্য বেছে নিয়েছিলেন। অযােধ্যাকে। অযােধ্যা শ্রীরামের জন্মস্থান। যে রামায়ণী ভাবধারায় আপামর ভারতবাসী শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় তার কেন্দ্রবিন্দুহল এই অযােধ্যা। এই শহরের সুমহান মর্যাদা যদি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া যায় তা হলে হিন্দুরা কোনওদিনই বিদেশি শাসকের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সুদীর্ঘকাল ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের গােলামি করতে বাধ্য হবে। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বাবর অযােধ্যার রাম জন্মস্থান মন্দির ধ্বংস করে সেই জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করান। এই একই কারণে মথুরার কৃষ্ণমন্দির এবং গুজরাটের সােমনাথ মন্দিরও বারবার আক্রান্ত হয়েছে। বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে তৈরি করা হয়েছেমসজিদ। সুতরাং ৫ আগস্টকে শুধুমাত্র রামমন্দিরের ভূমিপূজনের দিন বললে ভুল হবে, বিলুপ্তপ্রায় ভারতীয় জাতিসত্তার পুনরুত্থানের দিন হিসেবেও এই দিন পরবর্তীকালে মান্যতা পাবে।

ভারতীয় জাতিসত্তার ভিতটি যে এখনও বেশ দুর্বল এবং নানাভাবে বিভক্ত তা টের পাওয়া যায় ভূমিপূজনের দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়ার একাংশের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলে। আসাদুদ্দিন ওয়েসির বক্তব্য ও ৫ আগস্ট অযােধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপূজনের জন্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ লঙ্ঘিত হয়েছে। এবং ভূমিপূজনে পৌরােহিত্য করে শ্রীনরেন্দ্র মােদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেওয়া তাঁর শপথ ভঙ্গ করেছেন। ওয়েসি সাহেবের কথা শুনলে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ধর্ম ও মজহবের পার্থক্য না বুঝে এই ধরনের বালখিল্য মন্তব্য আপনি করেন কোন সাহসে? হিন্দু ধর্ম ইসলামের মতাে নিছক একটি উপাসনা পদ্ধতি নয়। কোনও হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বর ভজনাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে কত ইঞ্চি চুল-দাড়ি রাখতে হবে তার লম্বা ফিরিস্তি দেওয়া হয়নি। যজমানের পাজামার ঝুলও মাপেন না হিন্দুমন্দিরের কোনও পুরােহিত। হিন্দুদের কাছে ধর্ম হলাে জীবনবােধ এবং বিশ্ববােধ। এই দুই বােধের প্রসারে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তারাই হিন্দুদের দেবী ও দেবতা। এরা প্রত্যেকেই জন্মসূত্রে মানুষ কিন্তু গুণকর্মে দেবতা। এদের কাছে। যা সত্য তাই ধর্ম। শ্রীরাম সারাজীবন সত্যের পথ অনুসরণ করেছেন। তাঁর জীবনযাপন তাকে মানুষের কাছে প্রিয় করে তুলেছে। আর প্রিয় হয়েছেন বলেই দেবতা হয়েছেন। এবার আপনি বলুন ওয়েসি সাহেব, এমন একজন মানুষের মন্দির তৈরি হলে ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে লঙ্ঘিত হয়? বাকি রইল শ্রীনরেন্দ্র মােদীর শপথ ভঙ্গের প্রশ্ন। বলা বাহুল্য এই প্রশ্নটিও বালখিল্যপনায় আক্রান্ত। অন্তত আজকের ভারতবর্ষের বিরােধী রাজনীতিতেমুসলমান-তােষণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একথা মনে হবেই। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মনমােহন সিংহ যখন ইফতার পার্টিতে মাথায় ফেজ টুপি পরে বসে থাকতেন তখন তাে আপনি শপথ ভঙ্গ করার অভিযােগ করেননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মাথায় হিজাব পরে নামাজ পড়েন তখনও তাে কিছু বলেন না। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী যখন খ্রিস্টান লবির। চাপে হিন্দু মন্দিরের ভূসম্পত্তি ষড়যন্ত্র করে হাতিয়ে নেবার পরিকল্পনা করেন তখন কেন মুখ খােলেন না ওয়েসি সাহেব? প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করার শপথ কি নরেন্দ্র মােদী একা নিয়েছেন?

ভূমিপূজনের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযােগ, করােনা মহামারীর প্রকোপে দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত তখন কেন এই সময় কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে? এই অভিযােগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আরও একটি ভুল তথ্য। বলা হচ্ছে মন্দির নির্মাণের খরচ নাকি কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয় করবে। ভারতবর্ষের সৌভাগ্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নন। যদি হতেন তা হলে রামমন্দির নির্মাণে কেন্দ্র টাকা না জোগালেও সারা দেশে সরকারি খরচে দশ-বিশটা হজ হাউস বানিয়ে দিত। ঠিক যেরকম মাননীয়া পশ্চিমবঙ্গে বানিয়েছেন। যাই হােক, অভিযােগের উত্তরে বলা যেতে পারে রামমন্দির নির্মাণের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক শুধুমাত্র প্রশাসনিক। অর্থনৈতিক কোনও সম্পর্ক নেই। নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায় রামমন্দির তৈরি করা হচ্ছে না। মন্দির নির্মাণে প্রস্তাবিত খরচ ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু মন্দির কমপ্লেক্স তৈরি করতে আরও ১২০০ কোটি টাকা প্রয়ােজন। প্রশ্ন হলাে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আসবে কোথা থেকে?মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের। ট্রাস্টের উদ্যোগেই সারা দেশে ২৫ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর অর্থ সংগ্রহ অভিযান চলবে। অর্থাৎ মন্দির তৈরি হবে মানুষের দানে। বিভিন্ন এনজিও এবং এনআরআই-দের কাছে বড়াে অনুদান আশা করছে ট্রাস্ট। আর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে? না, সহযােগিতা ছাড়া কেন্দ্রের কাছে ট্রাস্টের আর কোনও প্রত্যাশা নেই।।

রামমন্দির নির্মাণ উপলক্ষ্যে সারা দেশে এখন সাজো সাজো রব। যাঁরা ভারতবর্ষের সত্যি ইতিহাস জানেন তাঁরা এই জাতীয় আনন্দের অংশীদার। কিন্তু যারা জানেন না বা যাঁদের হাতেই যুগ যুগ ধরে বিকৃত হয়েছে ভারতের ইতিহাস তাঁদের কাছে ভারতীয় জাতিসত্তার পুনরুত্থানের এই প্রয়াস খুব শুভ সংকেত নয়। রামমন্দির নির্মাণের পর বদলে যাবে ভারতের রাজনীতি। সেই বদলে যাওয়া রাজনীতিতে তাঁদের টিকে থাকা শুধু কষ্টকরই নয়, প্রায় অসম্ভব। কারণ দেশবিরােধিতা না থাকলে তাঁদের রাজনীতিশূন্যগর্ভ হয়ে উঠতে বাধ্য।

কংগ্রেস এবং বামপন্থী রাজনীতির ঘাের দুর্দিন বােধহয় আসন্ন।

সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.