অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তার । কর্মযজ্ঞের সাধনা ৭০ বছর পার করেছে। সেখানে আমি ৩০ বছর সঙ্ঘঘের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করি। শেষ কয়েকটি বছরের। উত্তরপূর্বাঞ্চলের কিছু বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছি।। আমরা বিশ্বাস কবি – সঙ্ঘকাজ ঈশ্বরীয় কাজ। সেখানে। সঙ্ঘকর্মযজ্ঞে স্বয়ংসেবকদের পরিশ্রম ও আত্মবলিদানের ফলস্বরূপ সমাজজীবনে জনতা জনার্দন এক বিরাট পরিবর্তন। আনছে, তার আভাস আমরা কয়েকবছর থেকে উত্তরপূর্বাঞ্চলে। বসেই অনুমান করছিলাম।
স্বর্গীয় কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা উঠে যাবার পর কোচবিহার জেলায় প্রবাসে এসেছিলেন। নগরের । স্বয়ংসেবক সম্মেলনে বৌদ্ধিকে বলেছিলেন, “১৮ মাসের স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচার শেষ হয়েছে। ভারতের জনতা জনার্দন অশুভ শক্তিকে অপসারিত করে শুভ শক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। জনতা যখন জাগ্রত ও সক্রিয় হয় তখন দেশে অনেক ‘পরিবর্তনও আসে। অনেক আগে থেকে তার শুভ ইঙ্গিত। অনুভব হয়। যাঁরা অনুভব করার, ঠিক অনুভব করেন এবং সাধারণ মানুষকে পথনির্দেশও করে থাকেন।
আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছেন, অসম, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মণিপুরেও সেভাবে জাগ্রত হিন্দুসমাজ সক্রিয়তা ও সংগঠিত রূপ দেখিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে জেলা প্রচারকের দায়িত্ব নিয়ে ত্রিপুরা গিয়েছিলাম। সেখানে সব রাজ্যেই এক হতাসার পরিবেশ বিরাজ করছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বে থাকাকালীন শুনেছিলাম অসমে হিন্দু সংগঠনের কাজ বৃদ্ধি না হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারতে। যুক্ত রাখা সম্ভব হবে না। কারণ তখন অসম ছিল ‘হার্ড নাট টু ক্র্যাক’ । তৎকালীন অসম-বঙ্গ ক্ষেত্রের ক্ষেত্র প্রচারক সুদর্শনজী। সারাভারত ভ্রমণ করে স্বয়ংসেবক ও নাগরিকদের সামনে উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানচিত্র রেখে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝাবার চেষ্টা। করেছিলেন। ভারতের রাজ্যে রাজ্যে সুদর্শনজী অসমের প্রান্তের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন।
সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাঁচাতে সেখানকার সাতটি রাজ্যকে সাংগঠনিক দৃষ্টিতে শক্তিশালী রাজ্যগুলি দত্তক নেবে। ধনবল, জনবল ও বুদ্ধিবল দ্বারা সেখানকার কাজে সহযােগিতা করবে। ত্রিপুরার দায়িত্ব পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ওপর। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে অনেক প্রচারক ও পূর্ণকালীন কার্যকর্তাকে সেখানকার বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানাে হয়। ১৯৮৮ সালে আমি যখন প্রথম ত্রিপুরাতে যাই, তখন প্রথম বামফ্রন্ট শাসনের শেষ প্রহর চলছিল। সামনেই ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাচন ছিল। শহরে ও গ্রামে আওয়াজ উঠেছিল ‘লালের তলে যাইও না, পােলা হারা হইও না।। নির্বাচনে বামফ্রন্টকে পরাজিত করে জোট-সরকার ক্ষমতায় এসেছিল।
সেখানকার সব রাজ্যেই অরাজকতা চলছিল। সেখান থেকে একের পর এক প্রাণ বলিদানের সংবাদ আসছিল। ভারতমাতার নামে সংকল্পবদ্ধ সন্তানস্বরূপ স্বয়ংসেবক-সেনানীরা মাতৃচরণে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করছিল। ১৯৯০ সালে নলবাড়ী। জেলা প্রচারক মুরলীজীকে অসমের জঙ্গলে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে প্রাণাহুতি দিতে হয়েছিল। কারণ উলফা সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার নিজরাজ্য কেরলে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। মুরলীজী সেই নির্দেশ পালন করেননি বলে এই শাস্তি পেতে। হয়েছিল। একবছর পর ধুবড়ী বিভাগের কোকরাঝার জেলা। প্রচারক মির্জাপুরের (U.P.) ওমপ্রকাশ চতুর্বেদী ও বরপেটার। জেলা প্রচারক মহারাষ্ট্র হতে আগত প্রমােদ দীক্ষিতজীকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাগুলাে সংগঠিত হওয়ার জন্য লােয়ার অসমের নলবাড়ী ও ধুবড়ী বিভাগে সঙ্ঘকাজের গতি আলফা-আতংকে মন্থর হয়ে যায়। সেই সময় আমাকে ধুবড়ী বিভাগ প্রচারক । হিসেবে ত্রিপুরা থেকে স্থানান্তরিত করা হয়। কয়েকজন গৃহী কার্যকর্তাকেও মাতৃচরণে প্রাণাহুতি দিতে হয়েছে। মণিপুরের। স্বয়ংসেবক মধুমঙ্গল শর্মা, আগরতলার স্বয়ংসেবক শ্যামহরি। শর্মা, কল্যাণ আশ্রমের কোকরাঝাড় জেলার রতন বােড়াে, নলবাড়ী বিভাগ কার্যৰ্বাহ শুক্লেশ্বর মেধী। পশ্চিমবঙ্গ হতে যাঁরা। ত্রিপুরা গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্যামল সেনগুপ্ত, যিনি গৃহস্থ। কার্যকর্তা হয়েও প্রচারকের মতাে প্রবাস করতেন। শ্যামলদা, সুধাময় দত্ত, দীনেন্দ্র নাথ দে ও শুভঙ্কর (কাঞ্চন) চক্রবর্তী। ত্রিপুরাতে বাম জামানায় ১৯৯৯ সালে প্রবাসে গিয়েছিলেন। এলএলএফটি সন্ত্রাসবাদীরা খ্রিস্টান মিশনারিদের নির্দেশে তাদের। অপহরণ করে ত্রিপুরার জঙ্গলে হত্যা করে। এই সংবাদ তৎকালীন সরকাৰ্যবাহ মােহনরাও ভাগবতজী গৌহাটীতে ২০০১ সালের । ২৮ জুলাই আমাদের প্রদেশিক বৈঠকে সকলের সামনে ঘােষণা করেছিলেন। ওই মৃত্যুসংবাদ কতাটা বেদনাদায়ক ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বেদনাদায়ক মুহূর্তে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিলাম। কারণ এই চিন্তাভাবনা বা সংকল্প নিয়েই। আমরা ডাক্তারজীর স্বপ্ন সাকার করতে চলেছি। একটি কবিতার পঙক্তি মনে পড়ছে—
“আপন হৃদয়, নিঙারিয়া মােরা শােনিত করেছি দান। বিশ্বের মাঝে রেখে যেতে চাই জননীর সম্মান।”
আমার প্রতি নির্দেশ আসে, আমাকে দক্ষিণ অসম প্রান্তের শিলচরে যেতে হবে। ত্রিপুরা তখন দক্ষিণ অসম প্রান্তের সঙ্গে ছিল। চারজন কার্যকর্তার মৃত্যুর জন্য অনেক স্বয়ংসেবকের বাড়িতে বিরােধিতা হচ্ছিল। কার্যকর্তাদের বৈঠক বােঝানাে হচ্ছিল যে, আতঙ্কের পরিবেশ ও বিরােধিতা শীঘ্রই অবসান হবে। কারণ। শত শত কার্যকর্তা তখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে, জঙ্গলের গ্রামে ও চা বাগানের বস্তিতে ভারতমায়ের সেবার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। দৃঢ়সংকল্পের বাক্যগুলাে যে আমাদের সবসময় বাধাবিপত্তির মাঝেও কাজ করার প্রেরণা দেয়। সংকল্পে আমরা বলেছি—‘সঙ্ঘের কাজ সৎ ভাবে, নিঃস্বার্থ বুদ্ধিতে দেহ, মন ও ধন দ্বারা করিব।
উত্তর -পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সঙ্ অধিকারীদের সংকল্পবদ্ধ হবার আহ্বান এবং অধিকারীদের পথপ্রদর্শন দ্বারা সেখানকার ভয়ংকর পরিবেশের চিত্র বদল হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যগুলিতে কল্যাণ আশ্রম, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সেবা ভারতীর দ্বারা সেবাকাজ ক্রমশ বিস্তার লাভ করছিল। বনবন্ধু পরিষদ ও বিদ্যাভারতী দ্বারা শ্রীরাম কথা ও শ্রীকৃষ্ণ কথার কার্যক্রম, একল বিদ্যালয় যােজনা, চা-বাগান অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে, বস্তিতে বস্তিতে এক একটি শক্তিকেন্দ্র স্থাপন হয়ে গিয়েছিল। এই কাজে বিস্তারলাভের জন্য রাষ্ট্র বিরােধী শক্তির ক্রিয়াকলাপও বন্ধ হতে শুরু হয়ে যায়। কারণ খ্রিস্টান মিশনারিদের সামনে আমাদের এই কাজ বা সংগঠন পালটা ধমকি স্বরূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাধারণ জনতাও এই রাষ্ট্র বিরােধী কাজের প্রতিরােধ করতে এগিয়ে আসছিল। জনতা জনার্দন প্রতিটি রাজ্যে এই পরিস্থিতিতে জাগ্রত নাগরিকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হচ্ছে—সেটা অনুভব হচ্ছিল।
ত্রিপুরা রাজ্যেও গত ৪০-৪৫ বছর যাবৎ যেসব ঘটনা ঘটে চলেছিল, তার প্রতিক্রিয়া জাগ্রত জনতার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। পূজ্য শান্তিকালী মহারাজের হত্যাকাণ্ড, শ্যামহরি শর্মার হত্যা , সঙ্ঘের চার কার্যকর্তার হত্যা এবং হিন্দু শ্ৰদ্ধাবিন্দুর উপর খ্রিস্টান মিশনারিদের মদতে ত্রিপুরার সন্ত্রাসবাদীদের একের পর এক আঘাতের ঘটনা ঘটে চলেছিল। সাধারণ জনতা এই পরিবেশ পরিবর্তনের পথ খুঁজছিল। ত্রিপুরা রাজ্যেও কল্যাণ আশ্রম, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সেবা ভারতী, একল অভিযান, বাঁশওয়ারা পরিযােজনা, শিবরাঈ সংগঠন এবং অন্য আরও কয়েকটি সংগঠন দ্বারা সমাজ জাগরণের যে কর্মযজ্ঞ চলছিল, তার পরিণাম আসতে শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আগরতলাতে ২০১৭ সালে সরসঙ্ঘচালকজীর প্রবাস উপলক্ষ্যে স্বয়ংসেবক ও নাগরিকদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল হিন্দু মালায়ামা’। ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতিটি পঞ্চায়েত হতে যথেষ্ট সংখ্যায় স্বয়ংসেবক ও নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব হয়েছিল। সম্মেলনের পূর্বে প্রত্যেক নগর, গ্রাম ও পাহাড়িক্ষেত্রে ‘জয়শ্রীরাম’ লেখা গৈরিক পতাকা লাগানাের ব্যবস্থা হয়েছিল। নাগরিকরা নিজ আগ্রহে গৈরিক পতাকা লাগিয়ে তাদের গ্রামগুলাে গেরুয়াময় করেছিল। যে ত্রিপুরা রাজ্যের নাগরিকরা লালঝান্ডা ছাড়া অন্য পতাকা দেখতে অভ্যস্ত ছিল না, সে রাজ্যের জনতা এই কার্যক্রম দ্বারা অশুভ শক্তির হাত থেকে নিজেদেরকে মুক্তি পেতে চাইছিল।
ত্রিপুরা রাজ্যে আমাদের চারজন কার্যকর্তার জীবনদানের প্রতিদান স্বরূপ পট পরিবর্তন আগত প্রায়। যেভাবে হিন্দুসমাজ খ্রিস্টান মিশনারিদের পাতা ফাঁদ হতে সামাজিক মুক্তি চাইছিল এবং মনে হচ্ছিল রাজনৈতিক লাভালাভকে প্রশ্রয়দানের চক্রান্ত। হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই এই পরিবেশ নির্মাণ হয়েছিল। ত্রিপুরা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি রাজ্য। তার পরিবর্তন না হলে বৈভবশালী ভারতের পুনর্নির্মাণ কী করে সম্ভব হবে। কাজ অনেক বাকি, অশুভ শক্তি আজও সক্রিয় রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগত অন্যান্য রাজ্যের স্বয়ংসেবকরা ও স্থানীয় শুভশক্তি যেমন সংকল্পবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে, ত্রিপুরা। রাজ্যেও সেখানকার স্বয়ংসেবকরা প্রতি বছর ৬ আগস্টে নুতন করে সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলার পাথেয় সংগ্রহ করে থাকে।
তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজীর সময় হতে আজ পর্যন্ত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি পরিবর্তনের যে প্রচেষ্টা হয়েছে, সেই বিষয়গুলি আগামী প্রজন্মের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারত তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভারতমাতার এই কর্মযজ্ঞের যদি কোনাে ইতিহাস লেখা হয়, তাহলে সমাজ জাগরণ ও সমাজ সংগঠনের সময়কালের প্রতিটি ‘টার্নিঙপয়েন্ট’ শিক্ষণীয় হবে। প্রতি মুহূর্তে বাধা এসেছে এবং স্বয়ংসেবকরা সেই সকল বাধা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গেছে। কারণ স্বয়ংসেবকদের মন্ত্র হলাে— “যায় যেন ভাই জীবন মােদের এই মাটিকেই ভালবেসে মায়ের সেবা করব শুধু মায়ের কোলেই ফিরে এসে।”
অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি ‘টার্নিংপয়েন্ট’ আমাদের প্রেরণা দিয়ে যাবে। কারণ আমরা। বর্তমান সময়ের ভারতমায়ের জাগ্রত প্রহরী – ‘বয়ং হিন্দুরাষ্ট্রে জাগৃয়াম।
বলরাম দাসরায়
(প্রতিবেদক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ক্ষেত্ৰীয় বৌদ্ধিক প্রমুখ।