নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯ নিয়ে বিরোধী দলগুলি তুমুল সরকার বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। বিরোধী দলগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টিকরে বিভ্রান্তি ও কুৎসায় লিপ্ত রয়েছে। দেশের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক শক্তিগুলিকে উৎসাহিত করছে এবং ব্যাপক হিংসায় প্ররোচনা দিচ্ছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিরোধী দলগুলি পাথর ছোঁড়াছুড়ি, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশকে আক্রমণ করেছে, যা গান্ধীজীর শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতাদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এমনকী, কেউ কেউ আবার। বিদেশি হস্তক্ষেপেরও দাবি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রামলীলা ময়দানে এই আইন সম্পর্কে বিশদে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে এই আইন নিয়ে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার কথা বলেছেন। দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও যাবতীয় সন্দেহের নিরসন ঘটিয়ে দেশ জুড়ে একাধিক শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা হয়েছে, যেখানে সত্যিকার প্রকৃত শক্তির প্রতিফলন ঘটেছে।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন আমাদের বৈচিত্র্যের সত্যতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতীয় সভ্যতার বিষয়গুলিকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা প্রায় ৭ হাজার বছরের পুরনো। আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব এক সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মধ্যে প্রোথিত রয়েছে। আমাদের সভ্যতাগত ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রতিফলিত হয় মালাবার জিউস, সিরিয়ান খ্রিস্টান, তৎকালীন পার্সিয়ার পারসি সম্প্রদায় অথবা আমার অভিভাবক, যাঁরা সকলেই দেশ বিভাজনের ফলশ্রুতি-স্বরূপ হিংসার কারণে অন্যত্র চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং এই দেশেই তারা সকলেই নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ওই সমস্ত ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এবং এই আইন ভারতীয় সভ্যতার মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত। এটা সুবিদিত যে, ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্মীয় নিপীড়ন হয়েছে। এই আইনে প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান-সহ ওই দেশগুলি থেকে যারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের আশ্বস্ত করার কথা বলা হয়েছে। এই আইনে যে সমস্ত কথা বলা হয়নি, তা উল্লেখ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আইনে ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে কোনও ভারতীয় নাগরিকেরই অধিকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়নি। ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এই আইনের দরুন যে ভয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন ও অসত্য। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে, বিশেষ করে যুবসম্প্রদায়কে প্ররোচিত করে ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হচ্ছে এবং এ ধরনের ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলঙ্কিত পন্থা অবলম্বনের বিষয়গুলিকে মনে করিয়ে দেয়।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ভারতের তিনটি প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের কাছে কোনও খোলা আমন্ত্রণ নয়। বিরোধীদের কেউ কেউ একে খোলা আমন্ত্রণ হিসেবেই দেখছেন। ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত দিন স্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনে কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দানের কথা বলা হয়েছে, যাঁরা শরণার্থী হিসেবে ইতিমধ্যেই ভারতে রয়েছেন এবং যাঁদের বর্তমানে ভোটাধিকার রয়েছে। এই নাকরিকত্ব দানের সঙ্গে নতুন দিল্লির অনুমোদনহীন কলোনিগুলির বাসিন্দাদের সম্পত্তির অধিকার দানের তুলনা চলে।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়ার বিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চলছে। এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাঁরা ওই তিন দেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাদের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারও অতিরিক্ত কিছু। আইন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও সমাজ বিদ্যার ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকলে এ ধরনের সন্দেহগুলি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। প্রথমত, এই তিনটি ইসলামিক দেশ। সুতরাং, ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রগুলিতে ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের নিপীড়নের কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তবে, এর অর্থ এটা নয় যে, ওই তিন দেশে যে সমস্ত মুসলমান ধর্মীয় কারণ ছাড়া অন্যভাবে নিপীড়িত হয়েছে, তারা ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন না। প্রকৃত ঘটনা হলো—বিগত পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার ওই তিন দেশের প্রায়। ৬০০ জন মুসলমানকে নাগরিকত্ব দিয়েছেন। সুতরাং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন মুসলমান বিরোধী বা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকেই অবজ্ঞা করে — বিরোধীদের এই মিথ্যা অপবাদ ধোপে টেকে না।
দ্বিতীয়ত, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে কার্যকর করা থেকে বিরত রাখার জন্য ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, বিগত সাত দশক ধরে অনুচ্ছেদে যে সমস্ত নজির রয়েছে, সেগুলি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মতো একটি বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গতভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তঁাদের । অধিকার কে প্রতিষ্ঠিত করে, যাঁরা ঐতিহাসিকভাবে বৈষম্যের শিকার।
তৃতীয়, প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ স্থির করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। এমনকী, অধিকাংশ উন্নত দেশই শর্তা ছাড়া বা বিচারবিশ্লেষণ না করে নাগরিকত্ব প্রদান করে না। আধুনিক ভারতের ক্ষেত্রে তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা অথবা বাংলাদেশ থেকে। আসা শরণার্থীদের সকলকেই আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাই, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কোনোভাবেই মানবাধিকারের অঙ্গীকারকে লঙ্ঘন করে না, বরং এই আইন মানবিকতার। মূল্যবোধগুলিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
সবশেষে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিবাদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমোদী গত ২২ ডিসেম্বর তার ভাষণে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সরকারি স্তরে এনআরসি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে এনআরসি প্রক্রিয়া কেবল অসমেই সীমাবদ্ধ। এনআরসি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মধ্যে রহস্যজনক যোগসূত্র খুঁজে বের করা, বিশেষ করে যখন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ক্ষেত্রে ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরকে চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, তখন ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির স্বার্থে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং তথাকথিত কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ তকমাধারী দল কয়েক দশক ধরে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ভোটব্যাঙ্কের এই রাজনীতি ২০১৪-তে মানুষ প্রথমবার প্রত্যাখ্যান করেন।
শিকাগোতে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আমি এমন একটি রাষ্ট্রের মানুষ হিসেবে গর্বিত, যে রাষ্ট্র বিশ্বের সমস্ত ধর্ম ও সমস্ত রাষ্ট্রের ধর্মীয় নিপীড়িত ও শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। মোদী সরকার ভারতে এই পরম্পরায় ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন আইন কার্যকর করেছে। আসলে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন হলো— ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়বাহক, যেখানে ভারতীয় ভূখণ্ডে ইতিমধ্যেই বসবাসকারী প্রত্যেকের নিরাপত্তার কথা রয়েছে। যাঁরা বিভ্রান্তির দরুন অন্ধ, তারা ভারতের সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতি চাইছেন। তাই, দায়িত্ববান ভারতীয় হিসেবে এটা আমাদের কর্তব্য যে, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এ ধরনের শক্তিগুলিকে উপেক্ষা করা এবং আমাদের সভ্যতাগত ঐতিহ্যের মূল্যবোধগুলিকে তুলে ধরা।
হরদীপ সিংহ পুরী
(লেখক কেন্দ্রীয় আবাসন ও শহরাঞ্চল বিষয়ক স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় বিমান পরিবহণ বিষয়ক স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী)
2020-01-14