শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ভারতে পুরোদমে জারি রয়েছে। অযোধ্যার রায় তারই একটি মাইলস্টোন। ইহলৌকিক জগতে বিচরণ করে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলিকে কীভাবে বিচার করতে হবে বাস্তব জীবনে তার চর্চা কতদুর প্রসারিত করা যাবে এ নিয়ে রামায়ণে বিস্তর টানাপোড়েনের ঘটনা রয়েছে। রামায়ণ মোটেই কোনো অদৃশ্যমান জগতের দেবতাদের কাহিনি নয়। প্রাসাদ বাসিন্দা হিসেবে তার সংশ্লিষ্ট রাজনীতিতে, অন্তর্দ্বন্দ্বে ও যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানব-মানবী কীভাবে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনচর্যাকে ক্রমাগত শ্রেষ্ঠতার দিকে, পূর্ণ মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এটি তারই উপাখ্যান। যেখানে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন বড়ো ভূমিকা নেয়। রামচন্দ্রের জীবন আমাদের দেখায় রাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ ও রাষ্ট্র নিজে কিভাবে পারস্পরিক কল্যাণে কাজ করে যেতে পারে। একই সঙ্গে তাঁর জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন সদগুণের অধিকারী হওয়া ও ন্যায়পরায়ণতা শুধুমাত্র আচারনিষ্ঠ পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে অর্জিত হয় না। জীবনে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমেই তার অর্জন আর তাতে কিছু ত্রুটিও থেকে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক অযোধ্যার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আদতে রামায়ণেরই একটি ক্ষুদ্রাকার প্রতিরূপ। রামের জন্মস্থান নিয়ে হিন্দুমানসে চিরস্থায়ী অধ্যাত্ম চেতনা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবের একটি মসজিদের ওই স্থানে অবস্থান নিয়ে শতাব্দী প্রাচীন বিতর্কের সঠিক নিরসনের প্রচেষ্টাই এই রায়ের সারাৎসার।
রামায়ণের মতোই এই বিচারপর্বেও ছিল আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের সঙ্গে ইহলোকিক অবস্থানের এক পারস্পরিক সংঘর্ষময় পরিস্থিতি। এই পরস্পরবিরোধী অনেক সময় অনির্ণেয় শক্তির দ্বন্দ্বের সমাধানে সর্বোচ্চ আদালত অধিকাংশ বিতর্কিত বিন্দুতেই সঠিক মীমাংসা সংবলিত রায়ই দিয়েছেন। দিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্দেশ।
চূড়ান্ত রায়দান পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার তোড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে অত্যন্ত জটিল কিছু আইনি প্রশ্নে আদালতের যুক্তি ও বিশ্লেষণ। এরমধ্যে কঠিনতম ছিল শ্রীরামের জন্মস্থানের আইনি বৈধতা।
১৯৫০ সালে সুপণ্ডিত প্রধান বিচারপতি বি. কে. মুখার্জি হিন্দু আইনের ওপর এমনই একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য রায় দান করেছিলেন।
খুব ভালভাবে খেয়াল করুন। সর্বোচ্চ আদালত রামজন্মের নির্দিষ্ট স্থানটির কোনো আইনি বৈধতা নেই বলে হিন্দু পক্ষের দাবি খারিজ করে দেন। কিন্তু বিচারক অন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ যুক্তি অবলম্বন করে বললেন স্থানের পরিবর্তে পুজ্য দেবতার আইনি বৈধতা নিশ্চয় আছে কেননা এই হিন্দু দেবতার পূজা-অর্চনা যাতে বাধাহীনভাবে হয় তারই পবিত্র ভাবনা নিয়ে এই দেবতার উদ্দেশ্যেই জমি অর্পিত হয়েছে। নির্দিষ্ট জমিতে দেবতার তাই পূর্ণ অধিকার আছে। শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর রায়দানকে এড়িয়ে দেবতার ওপর মানবিক অস্তিত্ব আরোপের এ এক অসাধারণ আইনি ব্যাখ্যা। শুধুমাত্র ব্যক্তির বিশ্বাসের যুক্তিটিকে ভিত্তি করলে ভবিষ্যতে অনেক মানুষই নিজস্ব আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সেই স্থানটির বাস্তব মালিকানা দাবি করতে পারে যার আদৌ কোনো আইনি বৈধতা নেই। এর পরিণতিতে দেশে সহজেই আইনের শাসন হটে গিয়ে বিশ্বাসীদের শাসন জারি হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হবে। ১৯৫০ সালের অত ধৈর্য ও প্রতীক্ষার দামে তৈরি সংবিধানের মর্যাদাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।
অনেকে বলছেন আদালত প্রমাণকে সরিয়ে রেখে বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে রায় দিয়েছেন। এমন লোকেরা রায়ের বিরাট অংশকে এড়িয়ে যাচ্ছেন শুধু নয়, তারা প্রমাণ কথাটির তাৎপর্য বুঝতে পারছেন না। শতাব্দী প্রাচীন কোনো বিবাদিত বিষয়ের ক্ষেত্রে কতকগুলো title deed বা সম্পত্তি সম্পর্কিত কাগজপত্রই কোনো প্রমাণ হতে পারে না। বিতর্কিত সম্পত্তিটির ব্যবহার কীভাবে হয়েছে সেই বিষয়ের মূল্যায়নের। ভিত্তিকেই প্রমাণ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে।
এই সূত্রে আদালত এটাই বিচার করেছে যে হিন্দুরাইতুলনামূলকভাবে অতি দীর্ঘদিন অবিচ্ছিন্নভাবে বিতর্কিত জমিটির বহির্ভাগে তাদের দেবোপাসনা চালিয়ে গেছে। ভেতরের অংশে যেখানে একটি মসজিদও ছিল সেখানেও অন্তত ১৮৫৭ সাল অবধি হিন্দুরা পূজা অর্চনা করেছে। এই যুক্তির অনুসরণে আদালত হিন্দু-মুসলমান উভয় তরফের দেওয়া যুক্তির ভিত্তিকে গ্রহণ করে উভয়েরই কিছু সম্পত্তি জনিত অধিকারকে মেনে নিয়েছে। কেউ একমত নাও হতে পারেন যে কীভাবে হিন্দুদের আংশিক প্রমাণ আদালত পূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ধরল। কিন্তু পূর্ণ প্রমাণের প্রশ্নে আদালতকে মোটেই দোষ দেওয়া যায় না। উল্টো দিকে আদালতকে কিছুটা বৈষম্যের জন্য দায়ী করার প্রশ্নে অনেক বড়ো অন্য বিষয়। রয়েছে। বিতর্কিত সমস্ত কাঠামো ও জমি তো হিন্দুদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুটা ভর পাই করতেই ধরে নেওয়া যায়। মুসলমানদের বিতর্কিত ২.৭৭ একরের বদলে প্রায় ডবল ৫ একর জমি প্রদান করা হয়েছে যেখানে তারা মসজিদ বানাতে পারবে।
এখানে দুটো প্রশ্ন আসবে, আদালতের কি এই ধরনের অদল বদল করে কোনো পক্ষকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রাখার কারণে জমি দেওয়ার অধিকার আছে? যদি অদলবদল (অন্য জায়গায় ৫ একর বিতর্কিত অঞ্চলে নয়) করাই হয় তা কি ভবিষ্যতে আইনগ্রাহ্য হবে?সংবিধানের ১৪২ নং ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত কোনো রায় নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রয়োগের পূর্ণ অধিকার আছে। অতীতে অবশ্য পালিত সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে রূপরেখা তৈরি, MBBS-এ ভর্তির পরীক্ষার পাঠ্যক্রম নির্ধারণ বা বিচ্ছেদ মামলার ক্ষেত্রে আদালতকে কিছু ইচ্ছামতো আইনি ক্ষমতা একই সঙ্গে প্রশাসনিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছিল। এই মামলার ক্ষেত্রে তা নয়। নির্দিষ্ট করে এমন জটিল একটি সংবেদনশীল মামলার ক্ষেত্রে আদালত যাতে সুষ্ঠু সমাধানে পৌছাতে পারার কারণে তার ওপর ১৪২ ধারা বলে সম্পত্তি বন্টনের পূর্ণ ক্রমে করা হয়েছিল।
আদালত যে প্রক্রিয়ায় এই ধারাটি ঘোষণা করেছে এবং ১৪২ নং ধারায় তার ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ করেছে তাতে মুসলমানদের অনেকের মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা আধুনিক ভারতে তাদের অবস্থান সম্পর্কে চিন্তাশীল হয়ে পড়ছে। এই মোহভঙ্গ যাতে জাতির প্রতি উদাসীনতার দিকে না গড়ায় তেমন পরিস্থিতি হওয়ার আগে একটা বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। বিতর্কিত জমিটি এখনও গঠিত হয়নি এমন। একটি ট্রাস্টের হাতে দেওয়া হবে। এর অর্থ এমনটা ভালো ভালো যে প্রস্তাবিত ট্রাস্ট সদস্যরা কিছুটা রাষ্ট্রপুরুষের গুণান্বিত হবেন। এবং তার ফলে মসজিদ তৈরির জমিটি প্রস্তাবিত রাম মন্দিরের থেকে খুব দূরে যাতে হয় যেটা নিশ্চিত করবেন। ভবিষ্যতে জাতির নির্মাণে কতটা যত্ন ও পারস্পরিক সম্মান নিয়ে মসজিদ তৈরিতে সহযোগিতা করা হচ্ছে তার একটি নির্ণায়ক ভূমিকা থাকবে।
আদালত ১৯৪৯ ও ১৯৯২ সালে। মসজিদের বিকৃতি ও ধ্বংসের মতো আইনভঙ্গকে চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে তার আইনসম্মত বিধি বিধান যে কাম্য তাও জানাতে ভোলেনি।
এই বিষয়টি ছাড়াও এই রায় নিয়ে সব সময় দুটি মত থাকবে। এটি বাস্তবভিত্তিক ও প্রজ্ঞাপ্রসূত কিন্তু দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের দিকে যেন একটু ঝুঁকে আছে। একটি প্রথম পক্ষের, একটি বিরোধী পক্ষের। ঠিক যেমন রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রাম সীতাকে পরীক্ষা দিতে বলছেন, কেননা তাকে রাবণ হরণ করেছিলেন। এই মিথটির মতো এই রায়ের মধ্যেও হয়তো কোনো অংশ জটিল ও একপক্ষীয় প্রতীয়মান হতে পারে। আগেই তো বলা হয়েছে সার্বিক ন্যায় প্রদানের প্রক্রিয়াসভাবে এগিয়ে চলেছে।
অর্ঘ্য সেনগুপ্ত
(লেখক কেন্দ্রীয় আইন প্রণালী কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক)
2019-11-15