এ বছরের ৪ নভেম্বর দিনটি আমাদের পক্ষে খুব একটা ভালো ছিল না। Regional
Comprehensive Economic Partnership (RCEP)-এর সম্মেলন থেকে প্রধানমন্ত্রী
শেষমুহূর্তে ঘোষণা করলেন ভারতের পক্ষে এশিয়ার অন্যান্য দেশের
প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ এখন সম্ভব নয়। তিনি আলাদাভাবে চীনের
সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রসঙ্গ তোলেন। বৃহত্তর বিশ্ব বাণিজ্যিক
পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে এটি একটি বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে এটি
সাধারণ কোনো বাণিজ্যচুক্তি নয়, সমগ্র এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক
সম্পর্কের প্রশ্ন এখানে জড়িয়ে আছে। ভারত যদি এই চুক্তির অংশীদার হতো
সেক্ষেত্রে RCEP বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (free trade
Zone) হয়ে উঠতে পারত। ১৬টি দেশ সদস্য হওয়ার ফলে বিশ্বের লোকসংখ্যার
অর্ধেক, বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ ও সারা বিশ্বের ৩৫ শতাংশ সম্পদের অধিকার
এই সম্মিলিত এশীয় বাণিজ্যিক সংস্থার করায়ত্ত হতো।আমার মনে হয় ভারত
RCEP-তে থাকলেও থাকতে পারত। চুক্তির যে শর্তগুলি ছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই
আমাদের আশঙ্কাগুলোর নিরসনকারী হতে পারত। কৃষিজাত দ্রব্যের আমদানি বা
দুগ্ধজাত দ্রব্য (যেমন নিউজিল্যান্ড থেকে) যাতে না আসে তার জন্য আমাদের
কৃষকদের নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা ছিল। সামগ্রিক আমদানিযোগ্য চীনা পণ্যের
মধ্যে চার ভাগের এক ভাগকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। বাকিগুলি ওপর ৫ থেকে
দীর্ঘমেয়াদের ২৫ বছর অবধি শুল্ক চাপানোর প্রস্তাবও সম্মতি পেয়েছিল।
সামগ্রিক প্রস্তাবিত চুক্তিতে ৬০টি খুব জরুরি ভোগ্য বা সংবেদনশীল পণ্যের
চীন থেকে আমদানি যাতে হঠাৎ করে লাফিয়ে বেড়ে যায় তার রক্ষাকবচের শর্ত
থাকার কথা হয়েছিল।
দেশের হিতের জন্যই আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে
এশিয়ারই অন্য ছোটো দেশগুলি যেমন— ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, লাওস,
মায়নামার যদি প্রতিযোগিতায় নেমে RCEP-এর সদস্য থাকতে পারে ভারত কেন পারবে
না? আমাদের কেন বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক সংরক্ষণের সুবিধে নিতে হবে ?
যা সাধারণত যে দেশে শিল্পোন্নোয়ন নিতান্তই শৈশব অবস্থায় রয়েছে তাদের
নিতে হয়। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরও কেন আমাদের সংস্থাগুলি এখনও নাবালক
অবস্থায় রয়েছে? বিশ্বের কোন দেশ রপ্তানি ছাড়া সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে
পারে না। মুক্ত অর্থনীতি অনুসরণকারী দেশগুলি সবসময় সরকার পরিচালিত
অর্থনীতির দেশগুলিকে ছাপিয়ে গেছে। ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠতে
আমাদের রপ্তানি ছাড়া কোনো পথ নেই। RCEP-এর সাম্প্রতিক অবস্থানের পর ভারতকে
একমাত্রিক লক্ষ্য নিয়ে এমন কিছু সংস্কারে হাত দিতে হবে যাতে বিশ্ববাজারের
প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারি, রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে পারি।
২০২০-এর মার্চের মধ্যে আমাদের কিন্তু আবার RCEP-তে যোগ দেওয়ার সুযোগ
রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কি আমরা নিজেদের একটু গুছিয়ে নিতে পারি না?
আপ্তবাক্যটি মনে রাখতে হবে, সঠিক কাজ করার প্রশ্নে দেরি হওয়াটা কখনই
প্রতিবন্ধক হতে পারে না। সেই কাজগুলি করে আমাদের দেশকে প্রতিযোগিতা-সফল করে
তুলতে আমি দশটি নিদানের কথা বলছি।
(১) প্রথমত হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলতে
হবে। অতীতের রপ্তানি বাণিজ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ নেতিবাচক মনোভাব যার পরিণতিতে
আমাদের সমগ্র বিশ্বের রপ্তানির অংশ এখনও মাত্র ১.৭ শতাংশ। নিরক্ষরবাদীরা
সর্বদাই বাণিজ্য ঘাটতির আতঙ্কে ভোগেন। তারা ভুলে যান কম দামের, উচ্চমানের
জন্য আমদানি করে বিশ্বের আমদানি-রপ্তানি শৃঙ্খলের সঙ্গে জড়িত থাকা
প্রয়োজনীয়। দেশের উৎপাদকদের, শিল্পোদ্যোগীদের আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে
সফলভাবে লড়ার চেষ্টা করলে তারাই আরও কুশল ও পারদর্শী হয়ে উঠবেন।
প্রতিযোগিতাক্ষম হয়ে ওঠার প্রচুর সুযোগ থেকে যায় বিদেশিদের কৃৎকৌশলের
সঙ্গে লড়ার।‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রস্তাব তো ভালোই তবে আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ
করে নয়। আমাদের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া ফর দি ওয়ার্ল্ড’ করতে হবে। যারা বার
বার বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে অযথা গলা চড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের
জানা দরকার ২০১৩-১৮ এই পাঁচ বছরে ভিয়েতনামের রপ্তানি ৩০০ শতাংশ বেড়েছে
যেখানে ভারত প্রায় স্থিতাবস্থা বজায় রেখে চলেছে। বাড়বৃদ্ধি বিশেষ নেই।
এর মধ্যেই রয়েছে রুপালি রেখা। আমাদের। বিশ্বে রপ্তানিশতাংশ এতই কম যে এতে
কিছুটা বৃদ্ধি ঘটাতে পারলেই ‘আচ্ছে দিন চলে। আসতে পারে।
(২) আমাদের
শুল্কের হার কমাতেই হবে। আমদানি শুল্ক হারে আমরা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিগত কয়েক বছরে ৯ বার শুল্ক বৃদ্ধি ঘটিয়ে আমরা পরিস্থিতিকে চরম খারাপের
দিকে নিয়ে গেছি। পৃথিবীর কুশলী দেশগুলির বেশিরভাগই একটা সময়ের পর শুল্ক
তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বিদেশ থেকে সস্তায় আমদানি করলে আমাদের দেশের
শিল্পোদ্যোগীরা সেই কাচামাল ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতায় নতুন উৎপন্ন
বস্তুটিকে রপ্তানিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। উৎপাদন
ক্ষেত্রে নৈপুণ্যও ক্রমশ বাড়তে পারে।
(৩) জাতীয় ক্ষেত্রে
প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে গেলে কম করে দশটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক ও বিভিন্ন
রাজ্যগুলির সঙ্গে সহযোগে কাজ করতে হবে। কেবলমাত্র অপ্রস্তুত বাণিজ্য
মন্ত্রকের হাতে সব ছেড়ে দিলে হবে না। একজন প্রবীণ উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন
ক্যাবিনেট পদমর্যাদার মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এ কাজে হাত দিতে হবে। ক্ষমতায়
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে তাকে। যাতে তিনি বিভিন্ন
দপ্তরের সঙ্গে তালমিল রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার হলে সেগুলি
ক্ষমতাবলে করে নিয়ে যাতে দেশ প্রতিযোগিতা সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে কেবল
সেটাই দেখবেন। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রকের কথায় কেউই কান দেয় না।
(৪) এই
কাজে আমলাতন্ত্রের শ্লথতা বড়ো বাধা৷ease of doing business-এর ওপর সদা
কড়া নজর রাখতে হবে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি
হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক বা আধিকারিকদের সঙ্গে নাগরিকদের মুখোমুখি
সাক্ষাৎকার যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। যা কিছু পারস্পরিক প্রয়োজনীয়
যোগাযোগ তা অনলাইনে সেরে নিতে হবে। কাগজ, নথি সবই অনলাইনে স্থানান্তরিত করে
নিতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে চুক্তি
সম্পাদনের দ্রুততা ও সাফল্য (Enforcement of Contract) I 96469 g fer
সম্পাদনের সময়সীমা কমিয়ে নিশ্চয়তা বাড়াতে হবে। সারা বিশ্বের চুক্তি
সম্পাদনের সাফল্যে ভারতের হার খুবই খারাপ।
(৫) আমার মতে টাকার মূল্যমান
বা বিনিময় হার ডলার সাপেক্ষে সঠিক নেই। আরও নেমে গিয়ে ৮০ টাকা প্রতি ডলার
হওয়া দরকার। সেটা হলে আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে আমাদের
রপ্তানিকারকদের নানা ধরনের ডলার মূল্যমানজনিত দেয় জরিমানা অনেক কমে যাবে।
ডলার বিনিময় মূল্যকে দেশের কোনো সম্মাননীয় স্মারক হিসেবে ধরে রাখার
প্রয়োজন নেই। ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়ে তা আমাদের প্রতিযোগী
দেশগুলির সমান করতে হবে।
(৬) আমাদের স্থবির শ্রম আইন যা শ্রমিকের বদলে
কেবল চাকরিটিকে সংরক্ষণ করে রাখার বিষয়ে বেশি সজাগ তার সংস্কার করতেই হবে।
অর্থনীতির নিম্নগতির সময় কোম্পানিগুলিকে টিকে থাকতেই হবে। যখন বাস্তবে
জিনিসপত্রের অর্ডার কমে আসে অবিক্রিত মাল জমতে থাকে তখন হয় ছাঁটাই করতে
হবে নয়তো সর্বস্বান্ত ঘোষিত হতে হবে। শিল্পক্ষেত্রে সফল দেশগুলি
নিয়োগকর্তাদের ‘hier and fire’-এর সুযোগ দেয় কিন্তু যাদের চাকরি থেকে
অপসারিত করা হলো তাদের জন্য একটি নিরাপত্তার রক্ষাকবচ রাখে। ভারতেও একটি
শ্রমিক কল্যাণ তহবিল নির্মাণ করা দরকার (যেখানে সংস্থার মালিক ও সরকার পক্ষ
নিয়মিত টাকা জমা করবে)। যখন ছাঁটাইয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেই
তহবিলের অর্থে অন্তবর্তী সময়ে তাদের ভরণপোষণ ও নতুন প্রশিক্ষণ চলতে পারে।
একবার পেতে পারলে সারা জীবন সেই চাকরি করে যাওয়া যাবে এমনটা এখন ভাবা ভুল।
(৭)
শিল্পের জন্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী ১ একর জমি জোগাড় করাই একটি খরচসাপেক্ষ
ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। ইউপিএ-২ -এর আমলে চালু করা বর্তমান আইনে জমি
নিতে গেলে কয়েক শত মালিকের (পরিস্থিতি অনুযায়ী বেশি কম হতে পারে) সই নিতে
হবে। এই ধরনের আমলাতন্ত্রের বেড়াজালকে পার করার দুঃস্বপ্ন শিল্পস্থাপনের
আগের পর্ব। এর পরিবর্তন করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও সহজে যাতে
শিল্পোন্নোয়নের জমি মেলে তেমন আইন করতে হবে। বস্তুত প্রথম মোদী সরকারের
আমলে এই ধরনের আইন লোকসভায় পাশও হয়ে গিয়েছিল, রাজ্যসভায় বিরোধীদের
বাধায়। আটকে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় মোদী সরকারের হাতে তুলনামূলক ভাবে ভালো
সংখ্যা রয়েছে। সেই কারণে জরুরি ভিত্তিতে আইনটি পাশ করা দরকার।
(৮)
কৃষকদের শিল্পে-নিযুক্ত কর্মী হিসেবে গণ্য করতে হবে, নিছক কৃষক হিসেবে নয়।
আগে থেকেই কৃষিজাত পণ্যের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ, প্রক্রিয়া নির্ধারণ
করা দরকার। হঠাৎ আমদানি করার বা খুব বাড়তি মজুত হয়ে গেছে রপ্তানি করা
প্রয়োজন এমন আচমকা নীতি মোটেই কাজের নয়। এর ফলে একই সঙ্গে কৃষক ও বিদেশি
গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
(৯) ভারতীয় উদ্যোগপতিরা রপ্তানি বাজারে
তাদের প্রতিযোগীদের থেকে বিদ্যুৎ, পরিবহণ মাশুল ইত্যাদিতে অনেক বেশি টাকা
জরিমানা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর কারণ বিদ্যুৎ, মাশুল ভাড়ায় যেহেতু
কৃষককে ভরতুকি দেওয়া হয় যেমন রেলে কৃষিপণ্য চাপানোর ওপর কিছু discount
থাকে এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ওই ছাড়ের থেকে অনেক বেশি বাদ দিয়ে মূল্যমান
ঠিক করা হয়। ফলে রপ্তানিতে আর লাভ থাকে না। এই ধরনের ভরতুকি তুলে নিতে
হবে।
(১০) ঠিক কী কাজে লাগতে পারে শিক্ষার পাঠ্যক্রমে তেমন পরিবর্তন করে
চাকরি পাওয়ার যোগ্য স্নাতক তৈরি করতে হবে। ভারতে প্রতিযোগিতার উপযোগী
করতে এই দশটি কথার কোনোটিই নতুন নয়। কিন্তু যেহেতু দেশে একটি অর্থনৈতিক
মন্দার ভাব এসেছে সেটি কাটিয়ে উঠতে এগুলি যাতে দ্রুত রূপায়িত হয় তাই
আবার মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সরকার কোম্পানি করে বড়ো। ছাড় দিয়ে
তার সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছে।
গুরুশরণ দাস
(লেখক প্রাক্তন আমলা এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক)
2019-12-13