তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ উন্মোচিত হোক

মহারাষ্ট্রের পালঘরে মবলিংচিঙের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হলো কল্পবৃক্ষ গিরি (৭০), সুশীল গিরি মহারাজ (৩৫) এবং তাদের ড্রাইভার নিলেশকেও। ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম আধ ডজন পুলিশের উপস্থিতিতে কোনো ধর্মীয় গুরুদের ভিড়ে ঠেলে দিয়ে আঘাতে আঘাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বারবার আকুতি-মিনতি করে বলছেন ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রং না দিতে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ঠাকরে কি সত্যি নিরপেক্ষ ছিলেন! তাহলে নৃশংস ঘটনাটি ১৬ এপ্রিলের রাতে ঘটলেও কেন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল, কোনো প্রকার গ্রেপ্তার তখন কেন করা হয়নি? অবশেষে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ১৯ এপ্রিল ঘটনাটি ভাইরাল হলে মহারাষ্ট্র সরকার ১০৯ জনকে গ্রেপ্তার করে ডেমেজ কন্ট্রোলের মাত্র চেষ্টা করে। অথচ ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক ক্রোশের থাকলেও পুলিশের পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তারপরও যখন ভিড় পুলিশের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন পুলিশ কেন লাঠিচার্জ, খোলা ফায়ারিং বা অতিরিক্ত বাহিনী ডাকেনি ? স্পর্শকাতর এই এলাকাটিতে আগে ধর্মান্তকরণ, মাওবাদী গতিবিধির মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও এভাবে ট্রিপল মার্ডার হয়নি। জানা যাচ্ছে। এটা এক খ্রিস্টান মিশনারি এলাকা । তাই হিন্দু সন্ন্যাসীদের আর শেষ রক্ষা হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়া ১০৯ জনের অধিকাংশই খ্রিস্টান ও কমিউনিস্ট। নাম-পদবিতে এদের হিন্দু মনে হলেও এরাই সেই ঘটনা ঘটিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া জয়রাম ধাক ভাবর, মহেশ সীতারাম রাবনে, গণেশ দেবজিরাও,রামদাস রূপজি, সীতারাম চৌধরীদের নাম হিন্দুদের মতো হলেও এরা ধর্মান্তরিত কমিউনিস্ট এবং হিন্দু বিদ্বেষী। অনেকটা কমিউনিস্ট নেতা সীতারাম ইয়েচুরির মতো। সিরাজ বালসারা নামের এক খ্রিস্টান মিশনারি পুলিশ হেফাজতে দুষ্কৃতীদের জামিনের জন্য লড়ছে। উল্লেখ্য, স্থানীয় বিধায়ক কমরেড বিনোদ নিকোলেকমিউনিস্ট নেতা হওয়ায় সন্দেহ আরও। গভীর হচ্ছে।

ভারতীয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি সভ্যতাতে কমিউনিস্টদের সমস্যা যুগ যুগান্তরের। পালঘর হত্যাকাণ্ড মনে করে দেয় ২০০৮-এ কেরলের কমিউনিস্ট সংগঠন Democratic Youth Federation of India (DYFI) -র সদস্যদের সেখানকার সাধু-সন্তদের উপর নির্মম অত্যাচারের। সেই সময় কেরলে সন্তোষ মাধবন নামের এক ভুয়ো সন্ন্যাসী নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হলে DYFI-এর সদস্যরা পুরো রাজ্য জুড়ে সাধুসন্ত নিধনে মেতে উঠে। তাহারা খুঁজে খুঁজে সন্ন্যাসীদের আশ্রমে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। জোর করে তাদের চুল-দাড়ি, জটা কেটে দেওয়া হয়। কেরলের কানুড় জেলায় সাধু বিনোদ নামের এক সন্ন্যাসীকে মিথ্যে (যেটি পরে মিথ্যা প্রমারিত হয়) অপবাদে কমিউনিস্টরা তাকে শারীরিক হেনস্থা করে। তাঁরও চুল, দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। সাধু বিনোদ এক সাক্ষাৎকারে জানান শারীরিক অত্যাচারে এতটুকু কষ্ট হয়নি যতটুকু তার লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেওয়াতে কষ্ট হয়েছিল। কারণ লাইব্রেরিতে প্রায় ষোলো হাজারেরও বেশি আধ্যাত্মিক পুস্তক ও অন্যান্য তথ্যাদি ছিল। তারপরও এই সাধুর আখড়ায় নকশালরা ত্রিশবারেরও বেশি ভাঙচুর চালায়। কিন্তু তিনি পালিয়ে যাননি, বরং বিশ্বাস করতেন যে এই পথভ্রষ্টরা একদিন ঠিক পথে ফিরে আসবে। একসময় পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্টদের শক্ত গড় ছিল। পালঘর হত্যাকাণ্ডের একই কায়দায় বিজন সেতু হত্যাকাণ্ডের ছক কষা হয়েছিল। ১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল, কলকাতার তিলজলাতে আনন্দমার্গের একটি ধর্মীয় শিক্ষা সম্মেলনে যাওয়ার পথে ১৭ জনের একদল সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে ছেলেধরা গুজবে সিপিএম ক্যাডাররা দিনের প্রহরে মাঝরাস্তায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী সিপিএম ক্যাডাররা ওইদিন বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে রাখে। তাই সন্ন্যাসীদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিজন সেতুর বন্ডেল গেটে সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে চরম নির্মমতায়তাঁদের ট্যাক্সি থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে শাবল দিয়ে মাথা থেতলিয়ে দেওয়া হয়, ছোরা দিয়ে চোখ উপড়ে শরীরে পেট্রোল ঢেলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির হেঁটে দূরত্ব প্রায় পাঁচ মিনিটের হলেও আশ্চর্যজনকভাবে দিনদুপুরে ঘটে যাওয়ার এক ঘণ্টার নরসংহারে পুলিশের সামান্যতম তৎপরতা চোখে পড়েনি। তৎকালীন নির্লজ্জ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু সাধু হত্যাকাণ্ডটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে বিবৃতি দিয়ে নিজের দায় এড়িয়ে যান। তাদের রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাসগুপ্তের মন্তব্য কেবল ছিল ঘটনাটি সাধারণ জনগণ ঘটিয়েছে। বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী বিজনসেতু হত্যাকাণ্ডের রোডম্যাপ তৈরি হয়েছিল ১৯৮২-র ৬ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন শাসক বামেদের পিকনিক পার্কে ডাকা কনভেনশনে। সেদিনের মিটিঙে বাম নেতা কান্তি গাঙ্গুলি (তৎকালীন কমিশনার যাদবপুর পৌরসভা ও প্রাক্তন মন্ত্রী), সুজন চক্রবর্তী, মিহির চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকার), আশুতোষ সেন (অ্যাডভোকটে), কবি অরুণ মিত্র, সুনীল চক্রবর্তী (চেয়ারম্যান যাদবপুর পৌরসভা), প্রণব সেন (কমিশনার) প্রমুখ আনন্দমার্গের সাধুসন্তদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণেউপস্থিত সবাইকে উত্তেজিত করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডটির চূড়ান্ত ছক কষা হয় সেই বছরের ২৯ এপ্রিল কান্তি গাঙ্গুলির সভাপতিত্বে সিপিএম ক্যাডারদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কর্মীদের দায়িত্ব বণ্টনে। সিদ্ধান্তনুযায়ী আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রাখা হয়। ঘটনার দিন ক্যাডারবাহিনী প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি মজুত রেখে বিজনসেতু, বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এবং বালিগঞ্জ রেলওয়ের জিনিসপত্র রাখার স্থানে নানা দলে বিভক্ত হয়ে লুকিয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী নিরস্ত্র সন্ন্যাসীরা তিলজলার আশ্রমে পৌঁছতেই লুকিয়ে থাকা কমিউনিস্টরা ইতিহাসের অন্যতম নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় । দুঃখের কথা, ৩৮ বছরেও সেই আনন্দমার্গীরা কোনো ন্যায় পাননি, বরং তারা আজও সেই একই চক্রান্তের শিকার। পরিবর্তনের ডাকে সাড়া দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ঘটা করে বিচারপতি লালার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডটির যে কমিশন বসিয়েছিলেন, অদৃশ্য ইঙ্গিতে আজও তা তিমিরে। দেশের বামপন্থী এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা দিন-রাত্রি বিজেপিআরএসএসের বিষোদ্গার করলেও তারা নিজেরাই জানে প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্টরাই ফ্যাসিবাদের মূর্তিমান প্রতীক।

অধুনা নওমুসলিম কবির সুমন ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ১৯৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশাতে অস্ট্রেলিয়ান খ্রিস্টান পাদরি গ্রাহাম স্টেইনের হত্যাকাণ্ডের দিনই তিনি নাকি ধর্ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত স্থির করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। স্থানীয় গরিব বনবাসীদের সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিদের সংঘাতই ছিল তারর মুখ্য কারণ। আক্ষেপ সেদিনের বিজনসেতু হত্যাকাণ্ডে এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, ধর্মনিরপেক্ষর ধ্বজাধারীরা যেমনটি করে মুখে কুলুপ দিয়ে রেখেছিল, পালঘরে সাধুহত্যায় তারা একই ভূমিকা পালন করছে। কমিউনিস্টদের হিন্দু দেব-দেবী, সাধুসন্ত, পূজাপার্বণে আপত্তি থাকলেও বাকি সব ধর্মে তাদের কোনোসমস্যা নেই, হওয়ার কথাও নয়। উত্তর প্রদেশের দাদরিতে দুষ্কৃতীরা আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে ভারত অচানক অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। পুরস্কার ফেরত গ্যাংদের অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আখলাকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারি চাকরি, ফ্ল্যাট, এককালীন কোটি টাকার সাহায্য কোনো কিছু বাদ যায়নি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবে পালঘর হত্যাকাণ্ডের মৃত ড্রাইভার নিলেশের (৩০) পরিবারকে কত টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে?। কোনো রাজনৈতিক নেতা ওই পরিবারে গিয়ে নিলেশের স্ত্রী, সন্তানদের সান্তনা দিয়েছে কি! প্রকৃতপক্ষে এটাই বর্তমান ভারতবর্ষের সেকুলারিজমের নগ্ন চিত্র। আরও আশ্চর্যের, যখন জুনেদ নামের এক যুবক ট্রেনের আসন নিয়ে ঝগড়ায় সহযাত্রীর ছুরিকাঘাতে মারা গেলেও তাতে সাম্প্রদায়িকতার রং ঢালার অপচেষ্টা এখন পর্যন্ত চলছে।

ভারতের বুদ্ধিজীবীরা মবলিনচিংয়ের ঘটনাগুলোর নির্বাচনপটু (সিলেক্টিভ) প্রতিবাদ করেন। এইরকম মবলিংনচিং ঘটলে প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির ধর্ম যাচাই করে যদি মুসলমান হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ হাতে প্লেকার্ড নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদী, বিজেপি, আর এস এসকে টার্গেট মুণ্ডপাত করা হয়। যদি আক্রান্ত ব্যক্তি হিন্দু হন তাহলেও তার জাত দেখা হয়। দলিত হলে টার্গেট সেই মোদী, বিজেপি, আরএসএস, ব্রাহ্মণ, হিন্দুত্ববাদীরা। আবার সেই হিন্দু ব্যক্তি দলিত না হলে যাচাই করা হয় ঘটনাটি বিজেপি শাসিত রাজ্যে কি না, যদি হয় তাহলেও টার্গেট মোদী সরকারেব দুর্বল প্রশাসন। তবে সেই আক্রান্ত ব্যক্তি অবিজেপি শাসিত রাজ্যে হলে সহজ ফর্মুলা মুখে কুলুপ আঁটা। মহারাষ্ট্রের পালঘর মবলিনচিং সেই একই ফর্মুলার প্রতিফলন। সম্প্রতি এক মার্কিন সংস্থা ‘United State Commission on International Religious Freedom’ (USCIRF) 2030 সালের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থিতি খুবই চিন্তাশীল।উল্লেখ্য, এই তালিকাতে ভারতের সমান্তরালে রাখা হয়েছে পাকিস্তান, চীন, উত্তরকোরিয়া, সিরিয়ার মতো অশান্ত, মৌলবাদী, একনায়ক দেশ সমূহ। কারণ সহজেই অনুমেয়, বিশ্ব দরবারে ভারতরে ছোটো করা। পাকিস্তান আপদমস্তক একটা মৌলবাদী জঙ্গির মদতদাতা দেশ, যারা করোনা মহামারীতেও দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ত্রাণে বঞ্চিত রাখে, সংখ্যালঘু নাবালিকাদের বলপূর্বক অপহরণ, ধর্ষণ ও ধর্মান্তকরণের পিশাচ নৃত্যে মেতে আছে। অপরদিকে ভারত পৃথিবীর একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিল, আইন প্রণয়নে কারো সঙ্গে ভেদভাব করা হয় না। বিরোধী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রাণখুলে।সরকারের বিরোধিতা করতে পারে। আশ্চর্যজনকভাবে USCIRF রিপোর্টে চরম সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয়েছে, অথচ সেই দেশে করোনা ভাইরাসের সুযোগে ধর্মীয় মৌলবাদীরা প্রতিদিন দেশের কোনো না। কোনো জায়গায় হিন্দু নির্যাতনে লিপ্ত। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের মাইনরিটি ওয়াচ বোর্ডের রিপোর্টনুযায়ী গত এপ্রিল মাসের ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৬, ১৮, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৯ তারিখে হিন্দুদের উপর হামলা, বাড়িঘর জ্বালানি, জবরদখল, ধর্ষণ, খুন প্রভৃতি অপরাধমূলক কাণ্ড সংগঠিত হয়। এরপরও হায়, মার্কিন রিপোর্টে এরা সহিষ্ণু দেশ!

রঞ্জন কুমার দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.