যুবসমাজের প্রতি বিবেকানন্দের আহ্বান

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যে সর্বাত্মক জাগরণ হয়েছিল তাঁর প্রক্রিয়াকে সঞ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল বিবেকানন্দের বাণী ও আদর্শ। রাশিয়ার অ্যাকাডেমি অব সাইন্সের ডিরেক্টর ই পি চেলিশভ বলেছিলেন— বিবেকানন্দ ছিলেন শান্তি, সমন্বয় এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহান। ‘প্রফেট’। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক দেশপ্রেমিক, এক বরেণ্য গণতন্ত্রপ্রেমী এবং এক মহান মানবতাবাদী। তিনি তার দেশবাসীকে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। সোভিয়েত দেশের মানুষের চোখে রামমোহন রায় অথবা গান্ধীজীর চেয়ে নতুন ভারত গড়ার স্থপতি হিসেবে বিবেকানন্দের অবদান বেশি বলে স্বীকৃত হয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা হুয়াং জিন চুয়ান বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘চীনদেশে স্বামী বিবেকানন্দকে আমরা একজন ধর্মীয় নেতমাত্র মনে করি না, আমরা তাকে আধুনিক ভারতবর্ষের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক হিসেবে দেখি। ভারতবর্ষে তিনিই। সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। ভারতবর্ষের বহু বিপ্লবীর কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস। বর্তমান চীনে তার দার্শনিক ও সামাজিক চিন্তা এবং বীর্যদীপ্ত দেশপ্রেম কেবল ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকেই উদ্বুদ্ধ করেনি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার সম্পর্কে বলেছেন : বিশ্ব-সংস্কৃতির আধুনিক মানচিত্রে বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের মানুষ এই প্রথম হিন্দুধর্মের উচ্চ তত্ত্বগুলিকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসম যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন : আগামী শতাব্দীগুলিতে বিবেকানন্দই বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম প্রমাণ রূপকার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর রংপুর ভাষণে (৩০ মার্চ, ১৯২৯) বললেন, ‘সমাজতন্ত্রের জন্ম কার্ল মার্কসের পুঁথিতে নয়, ভারতীয় সংস্কৃতিতেই তার উৎস ও আশ্রয়। সেই ভাব বিকশিত হয়েছে বিবেকানন্দের বাণীতে। ইংলন্ড-প্রবাসী অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুকে সেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু (৮ জানুয়ারি, ১৯১৩) লিখেছিলেন : “আমার মনে হয় আমার দূত। আমাদের মধ্যে আসিয়াছেন আমার প্রাণের সকল তমঃ নাশ করিয়া হৃদয়ে অনির্বাণ শিখা জ্বালাইতে। তিনি হলেন ঋষি বিবেকানন্দ। জাতির জীবনে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে জাতিকে স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি। তরুণ প্রাণে জ্বালিয়েছিলেন স্বদেশ প্রেমের অগ্নিতি। যুব সমাজের প্রতি তারই কণ্ঠে উদগিরিত হয়েছিল জ্বালাময়ী বাণী :তোমরা কি মানুষকে ভালোবাস? তোমরা কি দেশকে ভালোবাস? তাহলে পিছনে চেয়ো না, অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন কাঁদুক, পিছনে চেয়ো না। সামনে এগিয়ে যাও। ভারতমাতা অন্তত সহস্র যুবক বলি চান। জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে গরীয়সী ভারতমাতাই যেন আমাদের একমাত্র আরাধ্যা দেবী হোন। আমরা যেন দাস-মনোবৃত্তি ত্যাগ করে সোনার শিকল ছিড়ে ফেলে কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হয়েও সর্বাগ্রে স্বাধীনতা অর্জন করি। কারণ, পরাধীন জাতির কোনো ধর্ম নেই। তোদের একমাত্র কাজ সর্বশক্তি সঞ্চয় করে দেশ থেকে শত্রুকে বিতাড়িত করা।যুবকদের প্রতি তাই তার আহ্বান : “তোমাদের জীবন ইন্দ্রিয়সুখের নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয়, তোমরা জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। পৃথিবীতে যখন এসেছে তখন অন্তত একটা দাগ রেখে যাও। এই ভাবেই স্বামীজী স্বদেশের সবুজ প্রাণের কোমল হৃদয়ে জ্বেলেছিলেন অভীঃ মন্ত্রের অগ্নিশিখা।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর আগে মিস মেরি হেলকে এক পত্রে (৩০.১০.১৮৯৯) লিখছেন— ‘ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করেছে, মেয়েদের মর্যাদা নষ্ট করেছে, বিনিময়ে আমাদেরই পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরেছে পেনসন ভোগ করতে। খোদ ইউরোপের মাটিতে দাঁড়িয়ে (১৮৯৫) তাদের দিকেই আঙুল তুলে তীব্রভাষায় তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন : ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা রেখে গেছে অপূর্ব সব মন্দির, মুসলমানরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। আর ইংরেজরা? তূপীকৃত ভাঙা ব্রান্ডির বোতল, আর কিছু নয়। আমাদের গাঁয়ে গাঁয়ে দেশে দেশে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষেমরেছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে পিষেছে, নিজেদের তৃপ্তির জন্য আমাদের শেষ রক্তবিন্দুটি শুষে নিয়েছে, আর এদেশের কোটি কোটি টাকা নিজের দেশে চালান করেছে। আজ যদি চীনারা জেগে ওঠে ও ইংরেজকে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দেয়, যা তাদের উচিত প্রাপ্য, তাহলে সুবিচার হবে। ইংরেজদের কৃতকর্মের প্রতিশোধইতিহাস নেবেই নেবে। স্বাধীনতার প্রাক্ পর্বে ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যাচারী শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর কেউ এইরূপ প্রতিবাদী কণ্ঠে স্বদেশের হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস দেখাননি। এর ফলে ভারতবাসীর মনে বিশ্বাস এসেছিল যে তাদের মধ্যেও অদম্য শক্তি রয়েছে। পাশ্চাত্যের মানুষও জানতে পারল যে ভারত এক অতি পুরাতন উন্নত কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পন্ন সভ্য দেশ। ভারতের বাইরে বিবেকানন্দই প্রথম স্বদেশের নিজস্ব মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা অন্য কোনো বুদ্ধিজীবী বা নেতা একক বা সমষ্টিগতভাবে পারেননি।
সুতরাং পরাধীন ভারতে স্বামী বিবেকানন্দই ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম সেনাপতি।
যুবসমাজের উদ্দেশে স্বামীজী বলেছিলেন ‘প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। নিজেদের সংকীর্ণ গত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। প্রভু তোমাদের নড়নচড়নরহিত সভ্যতাকে ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্নমেন্টকে প্রেরণ করেছেন। কজন লোকের লক্ষ লক্ষ অনাথের জন্য প্রাণ কাঁদে? হে ভগবান আমরা কি মানুষ! ওই যে পশুবৎ হাড়ি, ডোম তোমার বাড়ির চারিদিকে, তাদের উন্নতির জন্য তোমরা কী করেছ, তাদের মুখে অন্ন দেবার জন্য কি করেছ, বলতে পার? তোমরা তাদের ছোঁও না, ‘দূর দূর’কর, আমরা। কি মানুষ?’ ‘ভারতের দরিদ্র, পতিত, পাপীগণের সাহায্যকারী কোনো বন্ধু নেই। সে যতই চেষ্টা করুক, তার উঠবার আর উপায় নেই। তারা দিন দিন ডুবে যাচ্ছে। রাক্ষবৎ নৃশংস সমাজ তাদের উপর ক্রমাগত আঘাত করছে, কিন্তু তারা জানে না, কোথা থেকে ওই। আঘাত আসছে। তারাও যে মানুষ তা তারা ভুলে গেছে। এর ফল দাসত্ব ও পশুত্ব।”
তাই, বলি এগিয়ে যাও বত্স, এগিয়ে যাও। পাশ্চাত্য সমাজ চিরকাল স্বাধীনতা। সম্ভোগ করে এসেছে।‘উন্নতির প্রধান উপায় স্বাধীনতা। ১৮৯৭ সালে বেলুড়মঠে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে স্বামীজী বলেছিলেন যে, “আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভারত স্বাধীন হবে। কিন্তু। যেভাবে সাধারণত দেশ স্বাধীন হয়, সেভাবে নয়। হেমচন্দ্র ঘোষকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : India should be freed politically first. ‘ভারতমাতার সেবা করতে চাও তো দেশমাতৃকার দুর্গতি দূর করার জন্য। প্রচণ্ড শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে অগ্রসর হও। জয় তোমাদের অনিবার্য। পরাধীন জাতির কোনো ধর্ম নেই, তোদের একমাত্র ধর্ম মানুষের শক্তিলাভ করে দেশ থেকে শত্রুকে বিতাড়িত করা।স্বামীজীর মুখে এই বাণী শুনে হেমচন্দ্র সেদিন সংকল্প করেছিলেন যে যতদিন না এই বাণী সার্থক করতে পারছেন ততদিন তাঁর বিরাম নেই। তাই কৈশোর থেকে জীবনে শেষ দিনটি পর্যন্ত বাধার পাহাড়কে তিনি ভয়। করেননি, ভয় করেননি দুর্দিনের রক্তচক্ষুকে। কখনো পিছন ফিরে তাকাননি। তিনি বলেছিলেন, “স্বামীজীর প্রেরণা ও আশীর্বাদ সম্বল করেই আমি বিপ্লবী দল প্রস্তুত করেছি। ভারতমাতা, বন্দে মাতরম্ এবং স্বামী বিবেকানন্দ এই তিনটি সত্যের পতাকা নিয়ে আমরা চলেছি এবং চলেছে বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দীনেশ’ (রাখাল বেণু’ পত্রিকা, ১৩৮৬, মাঘ-চৈত্র সংখ্যা)। হেমচন্দ্র ঘোষেরই মতোই বিবেকানন্দের পথে চলতে হবে। বর্তমান ভারতের যুবসমাজকে, বিশেষত বাঙ্গলার যুবসমাজকে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের জাতীয়তা বিরোধী আন্দোলন এখন প্রবল। তাই, জাতীয়তা বিরোধী রাজনৈতিক দলের । বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাই বিবেকানন্দ নির্দেশিত একমাত্র পথ বলেই লেখকের দৃঢ় অভিমত। তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃবন্দের কেউই জনশক্তির এই রূপ সদ্ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ২০ জানুয়ারি, ১৯১২ ‘মাইসোর-টাইমস্’-এ প্রকাশিত হয়েছিল : ‘বিবেকানন্দ ভারতের সর্বাত্মক জাগরণ এনেছিলেন, বিশেষত তিনি দুঃখী দুর্গত অগণিত সাধারণ মানুষের মুক্তির পথনির্দেশ করেছিলেন। তিনিই ছিলেন শক্তিধর দেশপ্রেমিক। অন্যরা যেখানে একদিকে গল্প কাকুতি, অন্যদিকে শূন্যগর্ভ আস্ফালন করে যায় দেশপ্রেমিকের ভূমিকা নিয়ে, সেখানে তিনি বুকের রক্ত ঝরিয়েছেন মানবকল্যাণে। তিনিই একমাত্র ভারতের পরিত্রাণকর্তা। ওই পত্রিকাতেই (৮ মার্চ, ১৯১২) গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে লেখা হয়েছিল : ‘পতিত মানুষকে অনুন্নতি থেকে উত্তোলন করাই বিবেকানন্দের ভাবনার প্রধান ভিত্তি এবং কর্মের প্রেরণা দেশবাসীর কাছে সেই পরম মানবতার আদর্শই তিনি দান করে গেছেন।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি দুর্ধর্ষ বিপ্লবী কানাইলালের (১০.১১.১৯০৮) ফাঁসি হবে! কারাগারের নির্জন কক্ষে পদচারণা করতে করতে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী থেকে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে শোনাতেন জেলের অন্য বন্দিদের। তাকে উচ্চৈস্বরে পড়তে দেখে সাহেব-সুপার ভৎসনা করলে কানাইলাল বলেছিলেন— ‘মরতে আমরা ভয় পাই না, সাহেব! মৃত্যুতেই আমাদের আনন্দ। মৃত্যুকে আমরা ভালোবাসি, আর ভালোবাসি আমাদের দেশকে, আমাদের মাতৃভূমিকে। যাঁর লেখা আমি পড়ছি সেই স্বামী বিবেকানন্দই আমাদের মৃত্যুকে। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তাই, যুবসমাজের প্রতি লেখকের আহ্বান : তোমরা বিবেকানন্দকে ভালোবাসো! কারণ, তাকে ভালোবাসা মানেই নিজের দেশকে ও নিজের জাতিকে ভালোবাসা। আর, দেশকে ভালোবাসা মানেই মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। তাই, জাতীয়তা বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াই স্বামী বিবেকানন্দ নির্দেশিত প্রকৃত পথ।
স্বামী ত্যাগিবরানন্দ
(লেখক রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সম্পাদক, কৈলাসহর, ত্রিপুরা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.