স্মৃতি খুবই মধুর হয় যদি তা নিঃস্বার্থ সাধকজনের সান্নিধ্য পাওয়া হয়। সমাজ সংগঠনে নিজেকে রাষ্ট্রায় স্বাহা’করেছেন সেই শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী আজ আমাদের মধ্যে নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে প্রচারক রূপে সেই সুদূর নাগপুর থেকে এসেছিলেন অসমে, তারপর ১৯৮১ সালে পশ্চিমবঙ্গে সহ-প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব নিয়ে । আমি ওই বছর অসুস্থ হয়ে বহরমপুর থেকে প্রান্ত কার্যালয় ২৬ নম্বর বিধান সরণিতে এসেছিলাম। তার বেশ কয়েকদিন পরে তিনি নাগপুর থেকে এলেন। তারপর প্রায় ২৮ বছর তার সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রচারক জীবনে কত কঠিন পরিস্থিতিতে কাটাতে হয়েছিল তা মর্মে মর্মে জানি। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণদা ছিলেন— সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে তথা মানাপমানয়ােঃ। তবেই তাে প্রান্ত, ক্ষেত্রীয়, অখিল ভারতীয় কার্যকর্তা হয়েছেন।
একবার আমি শ্রীকৃষ্ণদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ডাক্তারজী যে প্রথম শাখা শুরু করেছিলেন তখনকার কোনাে স্বয়ংসেবক কিংবা কার্যকর্তা বেঁচে আছেন কিনা। শ্রীকৃষ্ণদা বলেছিলেন— নাগপুরে তুমি এখন অন্তত ১০০ জনকে পাবে, যাঁরা বলবেন ‘আমি ওই পাঁচজনের একজন। এটা শুনে আমার হাসি পেল।তিনি বললেন, এখন সব প্রান্তে সঙ্ঘের শাখা—তাই তাঁরা একথা বলে আনন্দ পান।
আমি কোনােদিন শ্রীকৃষ্ণদাকে অস্থির ভাবে দেখিনি। একজন সাধক যেরকম ধীর, স্থির ভাবে সব সমস্যার সমাধান করেন, তাঁকেও সেরকম দেখেছি। সঙ্ঘের বৈঠকে সব শুনতেন, তার পর সমাধান করতেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মারা যাওয়ার খবর কেশব ভবনে আমরা পাই রাত প্রায় ১টার সময়। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় কেশবজী ও আমি কেশব ভবন সুরক্ষার কথা ভাবি। বলা যায় না কংগ্রেসি গুন্ডারা যদি ভবন আক্রমণ করে। তাই সমস্ত স্কুটার হলঘরে রাখছি, এমন সময় খবর পাই মানিকতলা থেকে কংগ্রেসের মিছিল এদিকেই আসছে। কেশবজী বললেন মােতলগজীকে খবরটা দাও। তখন রাত্রি প্রায় দুটো হবে। আমি পাঁচতলায় শ্রীকৃষ্ণজীকে কথাটা বললাম। শ্রীকষ্ণদা বললেন— কোথায় হয়েছে, আমি বললাম মাদ্রাজের পেরামপুদুরে। শুনে বললেন, ‘আচ্ছা। কোনাে অস্থিরতা নেই । কত বড়াে সাধক হলে তবেই নির্বিকার থাকতে পারেন।
কেশব ভবন তৈরিতে তার পরিকল্পনা অপরিসীম। কলকাতার স্বয়ংসেবকদের কার্যালয় নির্মাণের অর্থ সংগ্রহেরহ প্রেরণা জুগিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণদা। তিনি নিজে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সেজন্য অনেক সুবিধা হয়েছে। কেশব ভবনের প্ল্যান বাসুবাবু করলেও শ্রীকৃষ্ণদাই। আসল ছিলেন।
তিনি আমাদের বলতেন যে, তার বড়দার প্রচারক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দাদাকে ঘরে রেখে শ্রীকৃষ্ণদা নিজেই প্রচারক বেরিয়ে গেলেন। খুব মিতব্যয়ী ছিলেন তিনি। ২৬নং কার্যালয়ের ছােটো টালির ঘরে দুদিকে দুটি খাট, একদিকে কেশবজী আর একদিকে শ্রীকৃষ্ণদা ছােটো খাটে থাকতেন। ছােটো টেবিলে ল্যান্ড ফোন থাকত। জামা-কাপড় বলতে দু’জোড়া। তাও পূজার সময় অমলদা কিনে দিতেন। নিজে হাতে জামা-কাপড় কাচতেন। কোনােদিন কাউকে দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করাতেন না। ২৬নম্বরে আমরা ১২/১৩জন থাকতাম। প্রতিদিন টেবিলে এসে একসঙ্গে জলপান করতেন, গল্প করতেন।
একবার কলকাতার বাইরে থেকে আসা কোনাে স্বয়ংসেবকের উপর কেউ খারাপ ব্যবহার করেছিল ২৬ নম্বরে। শ্রীকৃষ্ণদা শুনে খুব দুঃখ পেলেন ও বললেন— আমরা স্বয়ংসেবকদের বাড়ি বাড়ি যাই, বিশেষ করে প্রবাসে, আমাদের তারা কত খাতির করে, আদর করে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে। আর সেই স্বয়ংসেবক এখানে এলে দুর্ব্যবহার কেন পাবে? তিনি বললেন, সর্বত্র একই মধুর ব্যবহার হওয়া উচিত। এটা প্রান্ত কার্যালয়, পুরাে প্রদেশের স্বয়ংসেবকেরা এখানে আসবে। কার্যালয় আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
কয়েক মাস আগে ফোনে নাগপুর থেকে কথা বলছিলেন, আমার বাড়ির খবর নিয়েছিলেন— কে কী রকম আছে। আমাদের বাড়ি অনেকবার এসেছেন। শেষবার ২০১৫ সালে কেশবজী ও শ্রীকৃষ্ণদা এসেছিলেন। আমার মেয়ে ও জামাইয়ের সঙ্গে কথা বললেন।জামাই সৌকত মাজীকে জিজ্ঞাসা করেন—কী করাে, কী পাশ। উত্তরে এএমআই পাশ করে বিএসএনএলে চাকুরি করার কথা বলে জামাই। শ্রীকৃষ্ণদা বললেন, খুব কঠিন এএমআই পাশ করা। আমি বি.টেক করেছি সহজ ভাবে। সেই সৌকত মাজী এখন শাখা কার্যবাহ। আমাকে বললেন—তুমিনার্সিং ধরছ। ছাড়ছ কী ব্যাপার। আমার এমডি(এএম) সার্টিফিকেটটা দেখতে চাইলেন, বললেন— এতদিন তুমি তাে বলােনি। আমি বললাম নিজের কথা আর কী বলব। সেদিন দুজনে। দুপুরে খেয়েদেয়ে বিকালে কেশব ভবনে ফিরলেন। তারপর কয়েকবার কেশব ভবনে দেখা হয়েছে। বছর চারেক থেকে তিনি নাগপুর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থাকতেন। দ্রুত তার শরীর খারাপ হতে থাকে। গত ২ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে অমৃতলােকে চলে গেলেন।
একজন মহান প্রচারককে আমরা হারালাম। তাঁর ত্যাগ, সাধনা, সবকিছু শুধু রাষ্ট্রের জন্য সঁপে গেছেন। তার ব্যক্তিগত সবকিছুই তিনি রাষ্ট্রের কল্যাণে সমর্পণ করেছেন। তার আদর্শ, ভালােবাসা বেঁচে থাক আমাদের মধ্যে। শ্রীকৃষ্ণদা আবার আসবেন ফিরে আমাদের মধ্যে।
ডাঃ শম্ভুনাথ ধাড়া
(লেখক হাওড়া মহানগরের স্বয়ংসেবক)
2020-08-31