কাটোয়া ছাড়া বঙ্গদেশের অন্যান্য বৈষ্ণবমন্দিরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিগ্রহ দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। তার চব্বিশোর্ধ্ব বয়ঃক্রম থেকেই তিনি দশনাম সম্প্রদায়ের একজন আদর্শ সন্ন্যাসী ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি সর্বকালের সকল সন্ন্যাসীর আদর্শস্বরূপ। তিনি আদি শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত দশনামি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ভারতী সম্প্রদায় থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেও ওই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীগণের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। কিন্তু তার গয়াধামে অবস্থানকালে দশনামি সম্প্রদায়ের পুরী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী শ্ৰীমন্ ঈশ্বরপুরীর কাছ হতে প্রথম দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তিনি যথাবিধি আত্মশ্রাদ্ধ শিখামুণ্ডন উপবীত বর্জন করে সন্ন্যাস গ্রহণ এবং ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করে সন্ন্যাসীগণের সঙ্গে সন্ন্যাসী সঙ্ঘের আদর্শ সন্ন্যাসীর ন্যায় চিরকাল অতিবাহিত করে গেছেন। সে কারণে গৌরভক্তগণ তাকে ন্যাসী চূড়ামণি অভিহিত করতেন।। শ্ৰীমন্ মহাপ্রভু নিজ মুখেই বলেছেনএসব জীবেরে অবশ্য করিব উদ্ধার
অতএব অবশ্য আমি সন্ন্যাস করিব।
(চৈতন্যচরিতামৃত) তখন তিনি ছিলেন নবদ্বীপে। তারপর এলেন কাটোয়ায় গঙ্গাতীরে কেশব ভারতীর আশ্রমে। এরূপ বর্ণিত আছে চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে—
এত বলি ভারতী গোঁসাই কাটোয়াতে গেলা
মহাপ্রভু তাহা যাহা সন্ন্যাস করিলা চব্বিশ বছর শেষে যেই মাঘ মাস
তার শুক্লপক্ষে প্রভু করিলা সন্ন্যাস। তার সন্ন্যাস গ্রহণের বিবরণ শুনলে ভক্তহৃদয়ে আজও করুণ রসের সৃষ্টি হয়। সেদিন গভীর রাত্রে যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত হলো। প্রসন্ন চিত্ত সৌম্যমূর্তি সন্ন্যাসীগণ বৃত্তাকারে উপবিষ্ট হলেন। মুণ্ডিত মস্তক, শিখাসূত্রধারী, শুচিশুভ্র বেশ পরিহিত তেজপুঞ্জকায় শ্রী বিশ্বম্ভর মিশ্র অগ্নি সম্মুখে স্থিরাসনে শোভিত হচ্ছেন। তার পার্শ্বে সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ যোগীরাজ ব্রহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসী শ্রীমৎ স্বামী কেশবানন্দ ভারতী সুখাসনে সমাসীন। ব্যাস-বশিষ্ট-শুক-শঙ্করের ভারতে ব্রহ্মবিদ্যার জন্য যেন আবার আত্মবিদ মহর্ষিগণের আবির্ভাব ঘটেছে। ভারতের প্রাণগঙ্গার গৈরিক স্রোতে পুনরায় উত্তাল তরঙ্গের তুফান উঠেছে। পল্লী বাঙ্গলার শ্যামল তটভূমিতে এসে সে উদ্বেল তরঙ্গ প্রবাহ বুঝি পরিণতির পথে চলেছে—বুঝি আরও একবার রূপ পরিগ্রহ করতে চাইছে নিথর নিঝুম হিমের নিশীথে অশোক-বকুল-বট-অশ্বথের ছায়ায় ঘেরা ভারতী মহারাজের আশ্রমে। যেন আজ নগাধীশ হিমালয়ের গাম্ভীর্যময় প্রশান্তি নেমে এসেছে। ভারতী মহারাজের নির্দেশানুসারে শাস্ত্রসম্মত ক্রিয়া সুসম্পন্ন হলে বিরজাহোম আরম্ভ হল। নিমাই যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দিয়ে আত্মশুদ্ধি করলেন—বর্ণ, আশ্রম, দেহ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার ইহলোক-পরলোকের ভোগবাসনা, সংসারপাশ, জীবাভিমান সমস্ত অজ্ঞান চিরতরে ভস্মীভূত হলো। ভারতী মহারাজ শিখা ছেদন করে দিলেন। যজ্ঞসূত্র ও শিখা ভস্মে পরিণত হলো। মায়িক জগতের সঙ্গে, গৃহ-গৃহাস্থাশ্রমের সঙ্গে নিমাইয়ের। সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলো। শিখাসূত্র বিহীন সন্ন্যাসী জ্বলন্ত পাবকের ন্যায় দীপ্যমান হলেন। তাঁর স্থির ধীর প্রশান্ত গম্ভীর মূর্তি দেখে সকলের হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হলো। আচার্য ভারতী মহারাজ তাকে শেষ মন্ত্র পরমহংস গায়ত্রী ব্রহ্মমন্ত্র, মহাবাক্যাদি শ্রবণ করালেন এবং গৈরিক রঞ্জিত কৌপীন, বহির্বাস, দণ্ড, কমণ্ডলু। দান করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে তাকে বিভূষিত করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমগ্র সন্ন্যাসজীবন আলোচনা করলে দেখতে পাই যে, তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী চূড়ামণি। ত্যাগে, বৈরাগ্যে, নিরভিমানিতায়, লোকশিক্ষায়, সামাজিক প্রথা পালনে, শিষ্য শিক্ষণে তিনি ছিলেন আদর্শ সন্ন্যাসী। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, তিনি নারকেল খোলা দিয়ে তৈরি। জলপাত্র ব্যবহার করতেন, তার দেহের আকৃতির সমান ছোট ঘরে নীলাচলে গম্ভীরায় দীর্ঘকাল বাস করেছেন। দেহের প্রতিতার ছিল
কোনো দৃষ্টি। সম্পূর্ণভাবে তিনি বিসর্জন করেছিলেন দেহের আরাম ও ভোগবিলাস। নীলাচলে অবস্থানকালে প্রতি বছর তাকে দেওয়া হতো শ্রীজগন্নাথদেবের প্রসাদী মূল্যবান কাপড় নন্দ উৎসবের দিন, তা তিনি মাথায় ঠেকিয়ে নিতেন কিন্তু ব্যবহার করতেন না, পাঠিয়ে দিতেন জননী শচীমাতার কাছে। পরমানন্দ পুরীর অভিপ্রায় অনুযায়ী। বাল্যসখা ও চিরসঙ্গী নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী জগদানন্দ মিহি গেরুয়া কাপড়ে ভালো শিমূল তুলো দিয়ে তৈরি করানো বালিশ ও গদিযা তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নবদ্বীপ থেকে—তা তিনি গ্রহণ করেননি। গম্ভীরার মেঝেতে সরলার (কলাগাছের থোড় হতে প্রস্তুত তখনকার দিনে প্রচলিত একপ্রকার মাদুর) বিছানায় শুয়ে রাত্রিযাপন করতেন। সারা জীবনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কঠোর বৈরাগ্য অবলম্বন করেছিলেন। সারাজীবন তিনি মাধুকরী করে জীবনধারণ করেছিলেন। শুধুমাত্র জগন্নাথদেবের প্রসাদ গ্রহণ করতেন। তার একান্ত প্রিয় ছোট হরিদাসকে চিরকালের মতো পরিত্যাগ করেছিলেন ভালো চাল সংগ্রহ করার অপরাধে।
সমীর চট্টোপাধ্যায়
2020-03-10