সংবিধানের শাসন বিপর্যস্ত হলে রাষ্ট্রপতির শাসনই শ্রেয়

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কারণ ইতিহাস কোনাে সরলরেখা ধরে চলে না। বিভিন্ন সামাজিক শক্তির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই সামাজিক প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চারিত হয়। আর কখনাে কখনাে পুরােনাে ঘটনা আবার নতুন করে ঘটতে থাকে। তখনই প্রয়ােজন হয় নতুন ইতিহাস সৃষ্টির। আজ পশ্চিমবঙ্গ সেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টির যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনে এরাজ্যে মুক্ত সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ আরােপের অভিযােগ বার বার উঠেছে। অভিযােগ উঠেছে শাসকদল কর্তৃক এ রাজ্যে গণতন্ত্রের পরিসরকে সংকুচিত করার, মানুষের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করার, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করার। যে প্রধান নীতিগুলির উপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে তার সবগুলিকেই বিপর্যস্ত করার অভিযােগ উঠেছিল বাম শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তকালীন বাম শাসকদলগুলাে বিশেষত সিপিএম-এর আগ্রাসী রাজনীতিকে দমন করতে বিরােধী দলগুলাে বার বার এ রাজ্যে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি তুলেছে। কেন্দ্রের কাছে দাবি করা হয়েছে এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির। ২০০৬ সাল থেকে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল তার চরম পরিণতি ঘটে ২০১১ সালে বাম সরকারকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে। যে প্রধান বিরােধী দল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের মূল দাবি ছিল পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রাজ্যবাসীর প্রতি তাদের আশ্বাস ছিল তারা যদি বাম সরকারকে উৎখাত করতে পারে তবে এ রাজ্যে গণতন্ত্র ফিরে আসবে, এক মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল নতুন করে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সেই অভিযােগগুলাে উঠছে যা উঠতাে পূর্বতন বাম সরকারের বিরুদ্ধে। বিরােধী দলকে তার প্রাপ্য পরিসর না দেওয়া, প্রশাসনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ, নির্বাচনে মানুষকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়ােগ করতে না দেওয়া– বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে অভিযােগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তৃণমূলর কংগ্রেসের শাসনকাল ৯ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আবার নতুন করে দাবি উঠছে। এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি না করলে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধানস্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার যা একটি মুক্ত সমাজে জনগণের ভােগ করার কথা তাও রক্ষা করা সম্ভব নয়। ক্রমেই জোরদার হচ্ছে এই দাবি।।

ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতীয় সংবিধানের রচনাকারগণ ভারতীয় গণপরিষদ এদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা রক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন। গণতন্ত্রের সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে। দেশের ঐক্য ও সংস্কৃতি। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামাে এবং ঐক্য ও সংহতির চেয়ে রাজ্যগুলির স্বাধিকার বড়াে হতে পারে না। কারণ একটি ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশের কাঠামাের মধ্যেই রাজ্যগুলি তাদের স্বাধিকার ভােগ করতে পারে। এবং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামাে তখনই রক্ষিত হবে যখন দেশের সর্বত্র সংবিধানের ধারাগুলি কার্যকরী থাকবে। এ কারণেই ভারতীয় সংবিধানে ৩৫৬ নম্বর ধারাটিকে যুক্ত করা হয়। এই ধারা অনুযায়ী কোনাে রাজ্যের রাজ্যপাল বা অন্য কোনাে সুত্রে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে সেই রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না বা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে তিনি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি করতে পারেন।” সাধারণভাবে একেই রাষ্ট্রপতির শাসন বলা হয়। কারণ রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রশাসনিক যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি নিজে পালন করতে পারেন কিংবা রাজ্যপাল বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষকে দিতে পারেন। আবার ৩৫৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনাে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ না মানলে বা মানতে ব্যর্থ বা অক্ষম হলে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি করতে পারেন। তবে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫৬নম্বর ধারাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ স্বাধীনােত্তর ভারতে মূলত এই ধারারই প্রয়ােগ ঘটেছে।

ভারতীয় সংবিধানে অঙ্গরাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির যে সংস্থান আছে। তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট। সংবিধান। প্রণেতাগণ দেশে গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামাে বজায় রাখার ব্যাপারে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। ফলে কোনাে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা যদি সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত না হয়। তবে সেই রাজ্যের মন্ত্রীসভার হাত থেকে রাজ্য প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ রাজ্যমন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের প্রশাসন পরিচালিত না হলে সেই রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। এ কারণে গণপরিষদের বিতর্কে অল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আইয়ার, ঠাকুরদাস ভার্গব কিংবা ব্রজেশ্বর প্রসাদের মতাে ড.বি.আর আম্বেদকরও সংবিধানে এই ধারার অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে সংবিধানকে রক্ষা করতে গেলে কেন্দ্রের হাতে এই ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখা প্রয়ােজন।

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নষ্ট হয় যদি সে সংবিধানপ্রদত্ত সুযােগ-সুবিধাগুলি ভােগ করতে না পারে। বাম আমল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিংসার প্রয়ােগ এতাে বেশি যে এ রাজ্যে সুস্থ। গণতান্ত্রিক পরিবেশের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিংসার অভিযােগ ওঠে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের দিকে। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর। ২০১১ সালে বামদলগুলি ক্ষমতার অলিন্দ থেকে বিদায় নিলেও হিংসার পরিবেশ এ রাজ্যে কমে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক হিংসা প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালের লােকসভা নির্বাচনে গােটা দেশে ১৬ জন রাজনৈতিক কর্মী নির্বাচন সম্পর্কিত হিংসায় নিহত হন। এর মধ্যে সাতজন নিহত হন পশ্চিমবঙ্গে। নির্বাচন কমিশনের রিপাের্ট অনুযায়ী

২০১৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ২০০৮ জন রাজনৈতিক কর্মী জখম হন হিংসার কারণে। এর মধ্যে ১২৯৮ জনই পশ্চিমবঙ্গে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরাের হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৯ থেকে ২০১৬-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বছরে গড়ে ২০টি রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচন্যক কেন্দ্র করে এ রাজ্যে হিংসার সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে যায়। এই নির্বাচনে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে মােট ৫৮৭৯২টি আসনের এক তৃতীয়াংশের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নেয় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। সেই নির্বাচনে লাগামছাড়া হিংসার সাক্ষী হয় পশ্চিমবঙ্গ। বিরােধী দলের প্রার্থীদের মনােনয়ন পত্র জমা দিতে না দেওয়া, প্রচার করতে না দেওয়া , নির্বাচনের দিন হিংসা, এমনকী ভােট গণনার দিনও ভুরি ভুরি হিংসা এবং অসৎ উপায় অবলম্বন করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযােগ ওঠে। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন কিছু রাজনৈতিক হিংসা এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। হিংসা ঘটেছে ২০১৯ সালের লােকসভা নির্বাচনের সময়কালে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হিংসার এই প্রকোপ দেখে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত জুন মাসের এক ভাচুয়াল র্যালিতে এ রাজ্যে ‘হিংসার সংস্কৃতি’ চালিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্যের শাসকদলের তীব্র সমালােচনা করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হিংসার প্রকোপ অত্যন্ত বেশি, কারণ শাসকগােষ্ঠী এখানে বিরােধী দলগুলিতে জায়গা ছাড়তে চায় না। হিংসার সঙ্গে দুর্নীতির একটা প্রত্যক্ষ যােগ আছে, কারণ শাসকদলের কর্মী-সমর্থকরা কিংবা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ‘দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারা সেই সম্পর্কটিকে বদলাতে চায় না। অর্থাৎ তারা দাতার ভূমিকায় থেকে যেতে চায় সে সম্পর্ক থেকে বৈষয়িক সুবিধা লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষরা এতাে বেপরােয়া হয়ে উঠেছে যে আমফানের মতাে ঘূর্ণিঝড়ের ত্রাণেও অজস্র দুর্নীতির অভিযােগ উঠেছে। দুর্নীতির পাশাপাশি রাজ্যের জনপ্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিশেষত পুলিশ প্রশাসনের। অসহায় মানুষ সঠিক পথ হাতড়াচ্ছে। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপালও বার বার রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে তার ক্ষোভ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

ভারতের সংবিধান দেশের সকল মানুষের জন্য মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন প্রদান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাজ হলাে সংবিধান অনুযায়ী প্রসাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনা করা। সেই কাজে কোনাে সরকার ব্যর্থ হলে সংবিধান স্বীকৃত পথে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠবে। পশ্চিমবঙ্গে সেই দাবিই উঠছে। কোনাে ব্যক্তি বা দলের চেয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা অনেক জরুরি। তাতে যদি রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে হয় তাতেও অসুবিধা নেই।

বিমল শংকর নন্দ

(লেখক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান, চারুচন্দ্র কলেজ, কলকাতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.