সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হচ্ছিল। যে সাংবাদিক এই সাক্ষাৎকারগুলি নিচ্ছিলেন, তিনি এক আন্দোলনকারীকে বেশ মজার একটি প্রশ্ন করেছিলেন। জনৈক আন্দোলনকারীকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন— আচ্ছা, এই যে এখানে। যারা অবস্থান করছেন তাদের জন্য চারবেলা যে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে, সেই খাবার জোগান। দিচ্ছে কে? এর উত্তরে ওই আন্দোলনকারী। বলেছিলেন— আল্লাহ জোগাচ্ছেন। এরপর সাংবাদিক প্রশ্ন করেন— আল্লাহ জোগাচ্ছেন সে তো বুঝলাম। কিন্তু কার থেকে এই খাবারগুলো নিয়ে আসছেন আপনারা বা কে আপনাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। এর উত্তরে ওই আন্দোলনকারী আবারও বলেছিলেন— সে আমরা জানি না। আমরা সকালে উঠে দেখছি আমাদের কাছে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে। এই কথোপকথন থেকে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কোনো একজন। সর্বশক্তিমান অন্তরাল থেকে শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের চারবেলা খাবার সরবরাহ করে চলেছেন। আর কী কী সরবরাহ করছেন, তাও ক্রমশ প্রকাশ হবে—এরকম আশা করাই যাচ্ছে। এই সাক্ষাৎকারের পাশাপাশিই ওই শাহিনবাগ অঞ্চলের আরও কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারও ওই টিভি চ্যানেলটিতে তুলে ধরা হয়েছে। আর যে মানুষগুলির সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়েছে তারা শাহিনবাগ অঞ্চলের বিভিন্ন বিপণীর মালিক, ব্যবসায়ী। শাহিনবাগে চলতে থাকা এই আন্দোলনের ফলে তাদের দোকানে বিক্রিবাটা লাটে উঠেছে। ব্যবসাপাতিও প্রায় বন্ধ। শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের প্রতি এই মানুষগুলি তিতিবিরক্ত। মাঝে একবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এই ব্যবসায়ীদের তুমুল বাগবিতণ্ডাও হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শাহিনবাগে আন্দোলনের নামে এই বিশৃঙ্খলা অবিলম্বে বন্ধ হোক। শাহিনবাগের ব্যবসায়ীদের কথা এই কারণেই উল্লেখ করলাম যে, শাহিনবাগের আন্দোলনের পিছনে যে স্থানীয় বাসিন্দা এই ব্যবসায়ীদের সমর্থন নেই, তা এদের সাক্ষাৎকারেই বোঝা যাচ্ছে। ফলে, এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, আন্দোলনকারীদের চারবেলা খাবারের প্যাকেট অন্তত এরা জোগাচ্ছেন না। তাহলে এটাই প্রশ্ন অন্তরালে থাকা সর্বশক্তিমান মানুষটি কে? তিনি আসলে শাহিনবাগের বাসিন্দা নন। অথচ চারবেলা। খাবারের প্যাকেট জোগান দিয়ে শাহিনবাগের আন্দোলনটা জাগিয়ে রাখতে চান ? শাহিনবাগের আন্দোলন দীর্ঘজীবী হলে তার কী সুবিধা? আসলে অনেককিছুই আমাদের জানার বাইরে থেকে যায়। যেমন, আজ অবধি আমরা জেনে উঠতে পারিনি, আধবেকার কানহাইয়া কুমারকে দেশের যত্রতত্র বিমানে ভ্রমণ এবং দামি হোটেলে রাত্রিবাসের টাকা। কে জোগায়, কারা জোগায়? কাদের পয়সায় কানহাইয়া কুমার দেশের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে। ‘আজাদি’-র স্লোগান দিয়ে যান? কানহাইয়া কুমারের মতো আজাদিপন্থী নেতাদের তুলে ধরতে পারলে কার কতটা লাভ?
আসলে সর্বত্রই একজন সর্বশক্তিমান অন্তরালে কাজ করে যান। পুতুলনাচের সতোটি তারই হাতে থাকে। কানহাইয়া কমার থেকে শাহিনবাগের আন্দোলনকারী— সবাই সেই অদৃশ্য মানুষের হাতের সুতোর টানে নড়েন। যেমন, সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যগুলি বা এই রাজ্যেরই প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের কথাই ধরুন। শাহিনবাগ, পার্কসার্কাস, জামিয়া মিলিয়া, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোষ্ঠীর আন্দোলনকে এরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে প্রচার করছেন। শাহিনবাগ যেমন সমগ্র দিল্লি নয়, তেমনই পার্কসার্কাসও সমগ্র কলকাতা নয়। শাহিনবাগ দিল্লির একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল, পার্কসার্কাসও কলকাতার তাই। তেমনই জামিয়া মিলিয়া, জেএনইউ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি বামপন্থী ছাত্ররাও দেশের সমগ্র ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এদের বাইরে যে বৃহত্তর জনসমাজ রয়েছে তার বক্তব্য প্রতিফলিত হয় না কেন এই সংবাদমাধ্যমগুলিতে? বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভারতে বসবাসকারী শরণার্থীরা যে দুহাত তুলে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে সমর্থন জানাচ্ছেন— দু-একটা সংবাদমাধ্যমকে বাদ দিলে অন্য সংবাদমাধ্যমগুলি তা প্রকাশ করে না কেন? এই কেন’র উত্তর অবশ্য এক বছর আগেই পাওয়া গিয়েছে। বছরখানেক আগে দিল্লিতে কুড়িজন তাবড় সাংবাদিকের এক তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এই কুড়িজন টিভির পর্দায় এবং খবরের কাগজে পরিচিত নাম। প্রগতিশীল এবং সেকুলার— এই এদের পরিচয়। গত বছর প্রকাশিত ওই তালিকায় দেখা গিয়েছে ওই কুড়িজনই একটি বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষের কাছ থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত মাসোহারা পান। পরিচিতি অনুযায়ী এই মাসোহারার পরিমাণ দেড় লক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজারের ভিতর। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে এরাই দল বেঁধে রাহুলবাবাকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, এরাই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সংবিধান বিরোধী এমন একটি ধারণা জনসমক্ষে প্রচার করতে চাইছেন। দেড় লক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজারের বাঁধা মাসোহারা পেলেই অনেক কিছুই লেখা যায় না। লিখতেও নেই। সে জন্যই এরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের কথা তুলে না ধরে একটি ক্ষুদ্র অংশের আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালাতে চান।
এই রাজ্যের দিকে তাকান। গত আট বছরে এই রাজ্য থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলিতে রাজ্য সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। শাসকদলের সমলোচনামূলক একটি পঙক্তিও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। ব্যাপারটা এমন নয় যে রাজ্য থেকে দুর্নীতি সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গিয়েছে। বরং ব্যাপারটা উল্টোই। প্রশাসনের সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতির কথা এখন সর্বত্র। আলোচিত। শাসকদলের দমনপীড়নও সকলের জানা। শুধু এই রাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলিই এই বিষয়ে নীরব ? কেন? কারণ গত আট বছরে এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলি পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই শাসকদল এবং সরকারের অর্থানুকূল্যে কোটিপতি হয়েছেন। কোনো সাংবাদিকের বেনামে দার্জিলিঙে রিসর্ট হয়েছে। কেউ কলকাতার উপকণ্ঠে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের প্রাসাদ বানিয়েছেন ইত্যাদি। কাউকে কাউকে তো এখন দুর্নীতির দায়ে ভুবনেশ্বরের জেলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই যে রাতারাতি তারা ফুলে ফেঁপে উঠলেন— এর পরিবর্তে কলমটিকে তাদের বন্ধক রাখতে হচ্ছে। বদলে রাজ্যের কোনো প্রভাবশালী মন্ত্রীর মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবায় সংবাদপত্র মালিককে হাসপাতালে রাত কাটাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর তালে তাল মিলিয়ে জল উঁচু জল নীচু বলে যেতে হচ্ছে। আর তাল না মেলালে? তার উদাহরণও রয়েছে। রাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকের প্রাক্তন সম্পাদক তাল মেলাতে রাজি হননি। ফলে নিজের সাম্রাজ্য থেকেই উৎখাত হতে হয়েছে তাঁকে।
আসলে আমরা সকলেই সবকিছু জানি। কিন্তু অন্তরালে থাকা ওই সর্বশক্তিমানদের মুখোশটি উন্মোচিত করা যায় না। তারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেমন সিঙ্গুরে যখন টাটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল, তখন কানাঘুষোয় শোনা গিয়েছিল ওই বিক্ষোভে মদত জোগাচ্ছে একটি গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা, যারা টাটদের প্রতিদ্বন্দ্বী। এবং এও শোনা গিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের অর্থ-সহ নানাবিধ সাহায্যও করছে এরা। সিঙ্গুরের ওই বিক্ষোভের ফলে টাটারা এখানে ওই প্রকল্প। আর করেননি। চলে গিয়েছিলেন গুজরাটের আনন্দে। কিন্তু তারপর কী হয়েছে? সিঙ্গুরের মানুষগুলির আম ও ছালা দুই-ই গেছে। তাদের এখন সর্বস্বান্ত অবস্থা। মাঝখান থেকে কারো কারো রাজনৈতিক বাসনা চরিতার্থ হয়েছে। এবং টাটাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ওই গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থার বাজার পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেড়েছে। অনেক কিছুই প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু বোঝা যায়। তবে, এখন বোধহয় চেনা যাচ্ছে শাহিনবাগ, জামিয়া মিলিয়া, জেএনইউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পার্কসার্কাসের বিক্ষোভের সুতোয় অন্তরাল থেকে কে টান দিচ্ছে। সম্প্রতি তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। চালিয়ে যেতে ১২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। তার ভিতরে কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বলই একা ৭৪ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। যাক, ঘুঘু এতদিনে ফাদে পড়েছে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2020-02-13