দশকের পর দশক ধরে চলা ভারতীয় উপমহাদেশের সবথেকে জটিল ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর একটি আইনি সমস্যার সমাধান হলো গত ৯ নভেম্বর। এ যেন আর এক রকমের নাইন ইলেভেন। দিনটি স্বাধীন ভারতের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন দেশের সর্বোচ্চ আদালত অযোধ্যার বিবাদিত ২.৭৭ একর জমিতে রামলালা বিরাজমানের দাবিকে স্বীকৃতি দিলেন এবং সেখানে রামমন্দির নির্মাণের পথে সব রকম বাধা সরিয়ে দিলেন। দেশের মুসলমান সমাজের খানিকটা প্রতিনিধিত্ব করছিল যে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড তাদেরও নিরাশ করেনি সর্বোচ্চ আদালত। অযোধ্যাতেই ৫ এরক জমির ব্যবস্থা করে দিতেহবে কেন্দ্র বা উত্তরপ্রদেশ সরকারকে যেখানে তারা মসজিদ বানাবেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এই রায় দিয়ে দেশের সবথেকে জটিল একটি সমস্যার সমাধান করে নিলেন। আমরা এই দেশের সচেতন নাগরিকেরা নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করতে পারি শুধু এই কারণেই যে, আমরা এই রায় জীবিত অবস্থায় দেখতে পেলাম। হিন্দুদের মধ্যে রামজন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণের জন্য লড়াই করেছেন এরকম বহু মানুষের ইতিমধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে। আমরা আজ যেন তাদের কথা ভুলে না যাই।
সারা ভারতেরই শুধু নয়, সারা বিশ্বের একশো কোটির বেশি হিন্দু জনসমষ্টির। কয়েকশো বছরের লালিত স্বপ্ন এতদিনে সাকার হতে চলেছে। এই স্বপ্ন তারা দেখেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। হতাশায় নিরুদ্যমে ভেঙে না পড়ে হিন্দু সমাজ তার স্বপ্নকে ধরে রেখেছিল। স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে বলে হিন্দুমন আজ খুশি। দীর্ঘদিনের একটি অমীমাংসিত বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান করে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-সহ আরও চার ন্যায়াধীশ। এই বিচার প্রক্রিয়াও চলেছে অনেকদিন ধরে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে অনেকে চেয়েছিলেন বিষয়টির প্রতিদিন শুনানি হোক এবং নির্বাচনের আগেই রায় চলে আসুক। প্রধান বিচারপতির কাছে এ মর্মে আবেদনও করা হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সে আবেদন শোনেননি। তিনি জানিয়েছিলেন বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে আদালতের নিয়ম ও রুটিন মেনেই; কোনো তাড়াহুড়ো করে নয়। কিন্তু তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন তার অবসর গ্রহণের পূর্বেই এই বিষয়টির তিনি সমাধান করে দিয়ে যাবেন। আপোশ মীমাংসার মাধ্যমে আদালতের বাইরে যাতে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এফ এম আই কলিফুল্লার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দেওয়া হয়। কমিটির বাকি দুই সদস্য ছিলেন শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর ও বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রীরাম পাঞ্চ। কমিটিকে প্রথমে আট সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়। পরে সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। তাই আদালতকেই দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসতে হয়। টানা চল্লিশদিন শুনানি চলে। সব পক্ষের সব মত শোনা হয়। দলিল দস্তাবেজ দেখা হয়। খুঁটিয়ে পড়া হয় ঐতিহাসিক উপাদান, ভ্রমণকাহিনি, গেজেটিয়ার্স, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকদেবজী বাবরি মসজিদ গড়ে ওঠার অনেক আগেই রামজন্মভূমি দর্শন করেছিলেন এই তথ্যও বিচারকদের নিজেদের রায় দানের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগে। রায়ে এ বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়েছে— “The visit of Guru Nanak Devji in 1510-11 AD and to have darshan of Janmabhumi of Lord Ram do support the faith and beliefs of the Hindus.”
অবশেষে শুনানি শেষ হয়। তারপর কয়েকদিনের বিরতি। রাতদিন প্রায় এক করে ১০৪৫ পৃষ্ঠার রায় তৈরি করেন বিচারপতিগণ। অবসান হয় সব দ্বন্দ্ব আর বিরোধের। রায় বেরোনোর পর গোটা দেশ জুড়ে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে সব শ্রেণীর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা খুশি ও আনন্দের ভাব দেখা গেছে। কিন্তু এই খুশি প্রকাশ করার বা উচ্ছ্বাস দেখানোর সেরকম কোনো উপায় ছিল না। কারণ এই বিষয়টি ছিল স্পর্শকাতর। উচ্ছ্বাস দেখানোর বিষয়ে প্রশাসনের নানারকম বিধিনিষেধ ছিল। সামাজিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে মাতামাতি করার কোনো উপায় ছিল না। খুব একটা মাতামাতি কেউ করেওনি। এতবড়ো রায়ের পরেই প্রয়োজনীয় সংযম আমজনতা দেখাতে পেরেছিল।
সবথেকে বড়ো কথা হলো, দেশের বৃহত্তর মুসলমান সমাজও এই রায়কে মেনে নিয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন মুসলমান সংগঠন অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য অর্থসাহায্যের প্রস্তাব দিচ্ছেন। এত দিনের একটা বিরোধ যা হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে গলার কাটার মতো আটকে ছিল তার নিরসন হয়ে যাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন মুসলমান ধর্মের সাধারণ মানুষ। তারা ভেবেছেন এবার সম্প্রীতির বন্ধনের মাঝখানে আর কোনো বাধা রইল না। তাই মৌলানা ইমরান হাসান সিদ্দিকি বা মৌলানা সুফিয়ানের মতো ধর্মগুরুকিংবা খালিদ রশিদের মতো আইনজীবী ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্যরাও এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা ভেবেছেন নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিল এই রায়। নতুন ভারতের নতুন প্রজন্ম মন্দির মসজিদের মধ্যে আর জড়িয়ে থাকতে চায় না। মন্দির মসজিদের বাইরে মুসলমান সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ এরপর সচেতন ও শিক্ষিত হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারবে বলেও এই রায়ের জন্য তারা আনন্দিত।
কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও বিষাদ খুঁজে বেড়িয়েছেন অনেকেই। হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা পড়লে, সব রকম বিভেদ ভুলে । গিয়ে দেশের কথা ভাবলে যাদের রাজনীতির কারবার বন্ধ হয়ে যাবে সে রকম দু’য়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও তাদের দল এই দেশব্যাপী সন্তুষ্টির মধ্যে চোনা খুঁজে বেড়ালেন। এদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয়। হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওবেসির কথা। তিনি এখন ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধি কিংবা মসিহা হয়ে উঠতে চাইছেন। তার দল এ আই এম আই এম রাজনীতি করে হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে পুঁজি করে। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা পড়লে, ধর্মীয় বিভেদ ভুলে মুসলমানরা আধুনিক উদারনৈতিক চেতনার কথা ভাবলে আবেসির রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তিনি বিরোধ জিইয়ে রাখতে চান। অযোধ্যার রায় বেরোনোর পর সবাই যখন রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন তখন অবেসি প্রমাদ গুনলেন। একটু পরেই তার টুইট এল ‘আই ওয়ান্ট মাই মসজিদ ব্যাক। মুসলমানদের হয়ে গলা ফাটিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টা করে চলেছেন ওবেসি সাহেব। আশা করি এরকম রাজনীতি থেকে। মুসলমান সমাজ সচেতন থাকবেন।
ওবেসি হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে নিয়েই রাজনীতি করেন, তাই বিরোধকে তিনি প্রকাশ্যেই বজায় রাখতে চান। তার উদ্দেশ্য জলের মতো পরিষ্কার ও তা বোঝা যায়। কিন্তু যাঁরা নিজেদের সেকুলার বলেন তারাও এই রায়ে খুশি নন। যেমন সিপিআই (এম)। এদের সাধারণ সম্পাদক আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিচার চান। এই রায়কে প্রশ্নাতীত নয়’ বলে তার মনে হয়েছে। তবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েও সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। আপাতত এই উদার মনের জন্য জাতীয় কংগ্রেসকে ধন্যবাদ। তবে আমাদের রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এই যুগান্তকারী রায় সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। মুখ্যমন্ত্রী নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন। একটি কবিতা লিখে বলতে চেয়েছেন অনেক সময় নীরবতা বহু কথা বলে। মানুষ তাদের নীরবতার মর্ম বোঝেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও স্বাগত জানানোর সাহস নেই যাদের তারা তাদের রাজনীতিকে কোথায় বন্ধক রেখেছেন তা সবাই জানেন। এভাবে কি বেশিদূর যাওয়া সম্ভব? সময়ই বলবে। সব থেকে বড়ো কথা হলো, এই রায়ের পর হিন্দু মুসলমান বিরোধের অবসান ঘটবে বলে মনে হচ্ছে। ধর্ম বা মন্দির মসজিদ যে আধুনিক ভারতের উদার ও মুক্ত মনের নাগরিকদের কাছে আর রাজনীতির বিষয় হয়ে থাকবে না, এই রায় সেই ভাবনার পথও প্রশস্ত করল। ধর্মচর্চা নিজস্ব অনুভবের বিষয়, নিজস্ব ভালো লাগার আর ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের বিষয়। মানুষ ধর্মচর্চা করে শান্তি পায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ধর্মকে নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হানাহানির যেন শেষ নেই। এই পটভূমিতে একবিংশ শতাব্দীর নতুন ভারতের নাগরিকদের কাছে অযোধ্যার রায় প্রাণের আরাম ও শান্তি এনে দিয়েছে। সব বিরোধের অবসান হয়েছে। অযোধ্যার সেই পুরোনো জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ হবে। সারা দেশ থেকে হিন্দুরা এমনকী অন্য ধর্মের বহু মানুষও অসবেন। ভগবান রামের মূর্তি দর্শন করবেন। পুজো দেবেন। আরতি করবেন। আর হয়তো খানিক দূরে এই অযোধ্যাতেই গড়ে উঠবে মসজিদ। সারা দেশের মানুষ সেখানেও আসবেন। সেখানে আজানের সুর শোনা যাবে। আরতি আর আজানের সুরে সব বিভেদের ঊর্ধ্বে জেগে উঠবে আগামীদিনের নতুন ভারত।
গৌতম কুমার মণ্ডল
2019-12-13