সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্কারে প্রকাশিত (৬ অক্টোবর ১৯) এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতির খ্যাতকীর্তি অধ্যাপক নোবেলজয়ী অর্মত্যকুমার সেন নিজেকে কায়া ও মনের স্বাতন্ত্রের সজীব প্রতিমূর্তি বলে বর্ণনা করেছেন। অতীতেও এই স্বাতন্ত্রের কথা এমনভাবে না বললেও একাধিক সাক্ষাৎকারে, বক্তৃতায় এবং লেখায় অধ্যাপক সেন অকপটে এমন অনেক মন্তব্য করেছেন যেখানে এই উপলব্ধি স্পষ্ট। ১৯৯৮ সালে নোবেল স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর কলকাতায় তাজ বেঙ্গলে নেচার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি নিউজ আয়োজিত পরিবেশ সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায়। তিনি পরিবেশ চর্চায় অর্থনীতির বিলম্বে অংশ নেওয়ার কেবল সমালোচনাই করেননি, পরিবেশ চর্চায় নিজের সীমিত অংশগ্রহণজনিত এক অপরাধবোধ ব্যক্ত করেছিলেন। নিউজ পরবর্তীকালে সেই ভাষণ প্রকাশ করতে চাইলে তিনি অনুমতি দেননি। একই ভাবে অর্থনীতিবিদদের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয়গুলি এড়িয়ে চলার বিষয়টিও তিনি লিখতে দ্বিধা করেননি। এমনকী সমাজ ও বহু সামাজিক সমস্যার স্বরূপ বিশ্লেষণে তাত্ত্বিক অর্থবেত্তাদের চেয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরা যে অনেক ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে থাকেন সে কথাও বলেছেন নির্দ্বিধায়।
হার্ভার্ড স্কোয়ার সংলগ্ন এক জনবিরল সরণীতে স্ত্রী এমা রথসচাইল্ডের সঙ্গে অধ্যাপক সেন বর্তমানে বাস করেন। সেখানে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে তাঁর পিতার অধ্যাপনার কথা, পণ্ডিত দাদামশাইয়ের লেখা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের মধ্য দিয়ে প্রথম বই প্রকাশের কথা যেমন বলেছেন, তেমনই কলেজ স্ট্রিটে কলেজ জীবনে মাকর্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও স্ট্যালিনের হাতে বুখারিনের নিগ্রহ ও মৃত্যুর পর সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক পরম্পরায় অবস্থান না করে অ্যাডাম স্মিথ ও জন স্টুয়ার্ড মিলের ভক্ত হওয়ার কথা বলেছেন। পর্যাপ্ত মনোযোগের সঙ্গে বাংলা ও সংস্কৃত অধ্যয়নের কথাও নিজের মুখে বলেছেন।
গুরু-শিষ্য পরম্পরার ভাষায় মরিস ডবের কাছে নাড়া বাঁধার ফলে মাইহার ঘরানার মতো তার বামপন্থী ঘরানার কথাও অর্থনীতির ছাত্র মাত্রই লক্ষ্য করে থাকবে।
সমস্যাটা হয়েছে যখন ভারতবর্ষের বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এসেছে। অধ্যাপক সেনকে আমরা তখনই নিজহাতে নিজের রাজকীয় প্রজ্ঞার ঔজ্জ্বল্যর প্রতি অবিচার করতে দেখেছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রসঙ্গে পাড়ার চায়ের দোকানের সর্বজ্ঞ দাদার ভাষায় তিনি যুক্তির জাল বিছিয়েছেন অ-অর্মত্যয়ী ভাষায় ও ভঙ্গিতে।
তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা নাকি বর্তমান ভারত সরকারের সমালোচনা টেলিফোনে তাকে করতে না চেয়ে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে বলতে চাইছেন পাছে টেলিফোন ট্যাপ করা হয়! মোদী সরকার নাকি তার ভাষায় ‘বিশ্বের প্রাচীনতম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় না বানিয়ে ক্রমশ হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বানাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পৃষ্ঠপোষকতার সৌজন্য গ্রহণের অক্ষমতা বর্তমান সরকার জানাতে গিয়ে তাঁর সুনাম রক্ষার্থে কারণগুলি প্রকাশ্যে আনেনি এটা সর্বজনবিদিত।
খাদ্যাভ্যাসজনিত প্রশ্নে বিশেষ করে বেদের যুগে ভারতবাসীর গোমাংস ভক্ষণের সঙ্গে হিন্দুদের গোভক্ষণকে এক করে দেখেছেন অধ্যাপক সেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী মানুষটির প্রতি অধ্যাপক সেনের বিরাগ সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার পক্ষে যুক্তি পরিশীলিত তত্ত্বের মোড়কে। হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। ২০১৪-র নির্বাচনের সময় থেকেই তিনি প্রবল মোদী বিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করেছেন এবং মে মাসের গরমেও কোট পরে তার বিপক্ষে ভোট দিতে এসেছেন। তখনও নোট বাতিল বা জি.এস.টি. লাগু হয়নি। ২০১৯-এর। নির্বাচনে দ্বিতীয়বার বেশি মাত্রায় জনাদেশ নিয়ে মোদীর ক্ষমতায় আসার ঘটনায় তার বিচলিত হওয়া বেশি চোখে পড়ছে। সরকারি নীতিসমূহের সমালোচনা বিদগ্ধ মহলে হতেই পারে এবং গণতন্ত্রে সেটা কাম্য। অধ্যাপক সেন আলোচ্য সাক্ষাৎকারে তা করেছেন।
তাঁর মতে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির এই জয় প্রকৃত অর্থে জয় নয়। আসল গণতান্ত্রিক জনাদেশ তাতে প্রতিফলিত হয়নি। ব্রাহ্মণ, বর্ণহিন্দু, দলিত, তপশিলি জনজাতি, মুসলমান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার অনুপাত এবং ভোট শতাংশের ক্লিশে যুক্তির সাহায্যে তিনি এই জনাদেশের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে শাসকদল, স্বাধীন প্রেস, স্বাধীন দূরদর্শনের অনুপস্থিতি ও অফুরন্ত অর্থ-সহ বিজ্ঞাপনের জন্য এই সাফল্য পেয়েছে। তিনি মনে করেন ২০১৯-এর সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পুলওয়ামার ঘটনা। এই দেশাত্মবোধের বিষয়টা তার মতে থ্যাচারের ফকল্যান্ড যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয়। থ্যাচার যেমন ফকল্যান্ড সংকটের আগের নির্বাচনগুলোতে হেরেছিলেন মোদীও পুলওয়ামার আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে হেরেছিলেন। এমনকী গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত হয়েও তিনি কোর্টকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পেরেছেন। তিনি নির্দোষ।
তিনি বলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ভারতের বহুত্ববাদ ও সর্বধর্মসমন্বয় সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কারণ শৈশব থেকেই তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারে প্রভাবিত। অবশ্য একই সঙ্গে অর্মত্যবাবু 166976991 As a political leader he is dynmic and enormously successful এই অভিধা Academician হিসাবে তার নিজের ক্ষেত্রেও খাটে। শান্তিনিকেতনে যাঁর পুষ্টি, প্রেসিডেন্সিতে শ্রীবৃদ্ধি এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর, কেমব্রিজ, দিল্লি, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স, অক্সফোর্ড, অবশেষে হার্ভাডে বিচরণ— তাকে Dynamic না বললে শব্দটাই মিথ্যে হবে। সেই সঙ্গে তাঁর সাফল্যের পালকতো গুণে শেষ করা কঠিন।
এহেন মানুষটি বলে বসলেন Gandhi was shot by an RSS member 978 তথাপি তিনি ভীত ছিলেন না এতদিন, কারণ আর এস এস এতদিন প্রান্তিক শক্তি ছিল। কিন্তু আজ তা আর নেই। তাই তিনি ভীত। এমনকী ভারতের শীর্ষ ন্যায়ালয়কেও তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেছেন এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতে বহুত্ববাদের ততটা অভিভাবক হতে পারছে না।
নেলীর মতো গণহত্যার ঘটনাকে কোনো ভাবেই উল্লেখ না করে গোধরা-উত্তর ঘটনার জন্য তিনি একা মোদীকে দায়ী। করলেন। কাশ্মীর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি এক হেঁয়ালি মেশানো বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এতদিন ওই রাজ্যকে India occupied state f962169 ore হয়েছিল, Indian State বানানো হয়নি। আবার পরক্ষণেই বললেন ভারতের অংশ হওয়ার যে বিধান কাশ্মীরের ছিল কেন তা চালিয়ে যাওয়া হবে না তার কোনো কারণ নেই। এ প্রসঙ্গে অকালপ্রয়াত অর্থনীতির অধ্যাপক কল্যাণ সান্যালের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বিব্রত করতে পারে এমন প্রশ্নকে মনোহারিণী বাক্যজালের আড়ালে এড়িয়ে যাওয়ার ঈর্ষণীয় ক্ষমতার অধিকারী তিনি। কাশ্মীর প্রসঙ্গে এত কম ভাবনাচিন্তার প্রকাশ কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান। দারিদ্র্য বৈষম্য প্রভৃতি অন্যান্য বিষয় তার অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছে।
সাক্ষাৎকারের মধ্যে অনুরঞ্জনের ভূমিকাটা শক্তিশালী না হলে তা সাক্ষাৎকার থাকে না। বিতর্কের আসর হয়। এক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। অধ্যাপক সেন। বোধ হয় সবচেয়ে নিজেকে বিতর্কিত রেখেছেন গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের প্রশ্নে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানকে অনেকটাই উপরে রাখার প্রয়াসের মধ্যে।
Multiple Identity-র প্রশ্নে জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন এ বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। এক্ষেত্রে ভারতে নাকি এটাকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
আমরা জানি বাংলাদেশের জন্মের সময় চারটি প্রধান নীতি ছিল : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাংলা জাতীয়তাবাদ। ১৯৫২-তে ইডেন কলেজে এবং ১৯৭০-এ। ডামি রাইফেল হাতে মহিলাদের মিছিলে বোরখা ছিল না। আজ শ্রমিক মহিলা থেকে সুপার এলিট পরিবারের মহিলাকেও হিজাব বোরখায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ অধ্যাপক সেন বলেছেন মহিলারা সেখানে ভারতের চেয়ে বেশি আলোকপ্রাপ্ত।
ইউরোপে, জাপানে, চীনে এমনকী ভারতেও কোনো ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে বেতার দূরদর্শন শুরু হয় না, বাংলাদেশে হয়।
ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেও এরশাদ যা করেনি সেটাই করলেন হাসিনা। ধর্মান্ধ শক্তি খিলাফতে মজলিসের সঙ্গে চারদফা চুক্তি করলেন। এগুলি হলো—
১. হাইকোর্ট বলেছিল কোনো মোল্লা ফতোয়া দিতে পারবে না। সেটা ফের চালু করা। ২. মহম্মদকে নিয়ে কটুক্তি করলে চরম শাস্তির বিধান চালু করা। ৩. কউমি মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান মর্যাদা দেওয়া। ৪. জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামি ভাবধারা চালু করা।
সর্বোপরি, যে মদিনা সনদ খোদ আরব দেশগুলি মানে না সেই সনদ অনুসারে আজ বাংলাদেশ চলতে চাইছে। এতকিছুর পরেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ দেখেছেন অধ্যাপক সেন।
তিনি যে প্রসঙ্গে কখনোই মুখ বা কলম খোলেন না সেই Demographic বাস্তবতা এই সাক্ষাৎকারেও স্থান পায়নি। Diabolically Cunning শব্দটি কোনওভাবেই তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে যে কোনো শিক্ষিত মানুষেরই কলম কাপবে। কিন্তু ভারতীয়রা তর্কপ্রিয় হবে এটাতো তিনি চেয়েছেন।
একটা গান তখনই সার্থক ভাবে শেষ হয় যদি শিল্পী ঠিকমতো সময়ে এসে থামতে পারেন। মাঝে মাঝে মনে হয় শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অমর্ত্যকুমার সেনের ক্ষেত্রেও এই কথাটা প্রযোজ্য।
কুণাল চট্টোপাধ্যায়
2019-11-08