পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ কি এনআরসি’র ভয়েই বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়েছেন ? নিছক ইলেকশন। ডেটা কিন্তু অন্য কথা বলছে। তাহলে মাত্র ছ’মাস আগে যে কালিয়াগঞ্জে বিজেপি ৫৭, ০০০ ভোটের লিড পেয়েছিল, সেখানে তারা প্রায় ২,৫০০ ভোটে হেরে গেল কেন? কারণ লোকসভা ভোটের বিচার্য বিষয়, প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ ভোটারের পছন্দ অপছন্দ বিধানসভা ভোটের থেকে আলাদা হয়।
ইলেকশন ডেটা বলছে, সীমান্তবর্তী হওয়া সত্ত্বেও কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরে এনআরসি ভীতির প্রচার তেমন দাগ কাটতে পারেনি। মানুষ তত ভয় পাননি। এটি জানা কথা যে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী দুইয়েরই আধিক্য। অতএব সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে তৃণমূলের এনআরসি ভীতির প্রদর্শন ও অপ্রপচার অধিকতর ফলদায়ী হওয়ার কথা। সীমান্তের মানুষের এনআরসি নিয়ে বেশি ভয় পাওয়ার কথা এবং এনআরসি করার প্রস্তাব উত্থাপন। করার জন্য বিজেপিকে বেশি করে প্রত্যাখ্যান করার কথা। কারণ ছিন্নমূল মানুষের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। সাধারণ অনুমান এটিই এবং কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরে বিজেপির পরাজয়ে রাজ্যে সাধারণ মানুষের একটা বড়। অংশ ধরেই নিয়েছেন যে এনআরসি’র কারণেই সম্ভবত এই হার। বিশেষত কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপির হারকে বিজেপি সমর্থকদের এক বৃহৎ অংশ তো এনআরসি ভীতির কারণে পরাজয় বলেই ধরে নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব হলো, এই তৈরি করা এনআরসি ভীতি কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরের মানুষকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি। ভোটের ফলাফল স্পষ্ট দেখাচ্ছে যে এইসব অঞ্চলের মানুষ হয়তো ভয় দেখানো সত্ত্বেও এনআরসি নিয়ে তত ভয় পাননি। বরং এই দুটি কেন্দ্রে বিজেপির ফল ২০১৬-র তুলনায় ঢের ভালো। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে যেখানে শরণার্থীও অনুপ্রবেশকারী দুইয়েরই আধিক্য, সেখানকার মানুষ এনআরসি’র অধিক বিরোধিতা করবেন এবং এনআরসিকে বেশি করে এড়িয়ে যেতে চাইবেন; উপনির্বাচনের ফলাফল কিন্তু এমন। অনুমানকে সমর্থন করছে না।
সাধারণ বিজেপি সমর্থক গত মে মাসে লোকসভা ভোটের ফলাফলের সঙ্গে এই উপনির্বাচনের ফলাফলের তুলনা করছেন। এবং বেশ খানিক উদ্বিগ্ন ও হতাশ হচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব হলো, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বিধানসভা ভোটের। ফলাফল তুলনা করতে যাওয়া সামগ্রিকভাবে অনুচিত, পদ্ধতিগতভাবে ভু ল এবং মিসলিডিং বা বিভ্রান্তিকর। লোকসভা ভোটে মানুষ ভোট দিয়েছিলেন দিল্লিতে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হবে কী হবে না তা নির্ণয় করতে। সেই বিপুল জনমত ছিল মোদীজীর পক্ষে। তারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীকে জেতাতে। বিশেষত ফ্লাইং ভোটাররা। এই ফ্লাইং ভোটাররা এও জানেন যে রাজ্যের উপনির্বাচনে তৃণমূলকে হারালে শাসকদলের রোষের মুখে পড়তে হতে পারে তাদের, কারণ উপনির্বাচনে বিজেপি জিতলেও রাজ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই থাকবেন এবং যে বিধানসভা কেন্দ্রে হারবেন, সেই বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারেন। সেই কারণেই। পশ্চিমবঙ্গের জেলার ভোটাররা মূলত শাসকদলের পক্ষে ভোট দিয়ে থাকেন। একেবারে তৃণমূল স্তরের মানুষও ‘দিল্লি ভোট’ আর ‘রাজ্য ভোট’ তফাত করতে জানেন। তারা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট তখনই দেন যখন বুঝতে পারেন যে তাদের ভোট পট পরিবর্তন ঘটাবে। তাই উপনির্বাচনে তারা বিজেপিকে জিতিয়ে শাসককে চটানোর চেষ্টা করেননি।
সেই কারণে ২০১৯-এর বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ ও তুলনা যদি করতেই হয়, তাহলে ২০১৯-র লোকসভা ভোটের ফলাফলের সঙ্গে নয়, বরং ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে তা করাই যুক্তিযুক্ত। তাই, যদিও একথা সত্যি যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপির যে ফলাফল হয়েছিল, সেই তুলনায় এই উপনির্বাচনে তা খারাপ, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এই উপনির্বাচনে কালিয়াগঞ্জের মানুষ। বিজেপিকে প্রত্যাখান করেছেন।
২০১৬ কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রমথনাথ রায়। পেয়েছিলেন ১,১২,৮৬৮ টি ভোট। তৃণমূলের বসন্ত রায় পেয়েছিলেন ৬৬, ২৬৬টি ভোট আর বিজেপির রূপ রায় ২৭, ২৫২ টি ভোট। ওই বছর এই বিধানসভায় । মোট ভোট পড়েছিল ২,১৪,৬৪২টি। সেই তুলনায় ২০১৯-এর উপনির্বাচনে তৃণমূলের তপন দেব সিংহ পেয়েছেন ৯৭,৪২৪টি ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির কমলচন্দ্র সরকার ৯৫,০১৪টি ভোট। কংগ্রেসের ধীতশ্রী রায় ১৮,৮৫৭ টি ভোট। কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় মোট ভোট পড়েছে ২,১৮,২০০ টি।
অর্থাৎ ২০১৯-এ এই বিধানসভায় কংগ্রেসের ২০১৬-র ভোট ভাগ হয়ে গিয়েছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ কংগ্রেসের ভোট কমেছে (১, ১২,৮৬৮ -১৮,৮৫৭) = ৯৪,১১টি। যদি ধরে নেওয়া হয় যে এতগুলি ভোট বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়েছে, তাহলে তৃণমূল ও বিজেপি, উভয় দলেরই এ বছরে ভোট বুদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল প্রায়। (৯৪,০১১/২) = ৪৭,০০৫ টি করে। কিন্তু বাস্তবে ২০১৯ সালের এই উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে (৯৫,০১৪ –২৭,২৫২) = ৬৭,৭৬২টি আর তৃণমূলের ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে (৯৭,৪২৪ –৬৬,২৬৬) = ৩১,১৬২টি। অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০১৯-এ তৃণমূল ও বিজেপির ভোট সমানভাবে বৃদ্ধি পায়নি। বরং বিজেপির ভোট বেড়েছে অনেক বেশি। তুলনামূলক ফলাফল দেখলে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের ভোট যতখানি বৃদ্ধি পেয়েছে, বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে তার (৬৭,৭৬২/৩১, ১৬২) = ২.১৭ গুণ, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে বিজেপির ফল তৃণমূলের চেয়ে ভালো হয়েছে, কালিয়াগঞ্জের প্রচুর মানুষ বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও জয় হয়েছে তৃণমূলেরই। সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত কিছু ডেটা অনুযায়ী মে মাসে লোকসভা ভোটে শুধু কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায়ই বিজেপি পেয়েছিল ৫৭,০০০ ভোটের লিড়। আর উপনির্বাচনে সেখানে বিজেপি হেরেছে (৯৭,৪২৮ – ৯৫,০১৪) = ২,৪১৪ ভোটে। লোকসভা নির্বাচনে কোনো একটি বিশেষ বিধানসভা অঞ্চলে ভোটের ফলাফল ঠিক কেমন হয়েছে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত ইলেকশন ডেটা থেকে তা সরাসরি জানবার বোধহয় কোনো উপায় নেই। কারণ লোকসভা ভোটে নির্বাচন কমিশন বিধানসভাভিত্তিক কোনো ডেটা প্রকাশ করছে বলে কোথাও খুঁজে পাইনি। তাই মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপি যে ৫৭, ০০০ ভোটের লিড নিয়েছিল বলে শোনা যাচ্ছে, সে তথ্য অফিসিয়ালি কোনোখানে পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ বোধহয় কেবলমাত্র কিছু সংবাদমাধ্যমের বা রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী এজেন্টদের এস্পিরিকাল অ্যাসেসমেন্ট।
এই উপনির্বাচনের তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ লোকসভার অর্ন্তগত কালিয়াগঞ্জ এবং মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত করিমপুর, এই দুটিই হলো সীমান্তবর্তী অঞ্চল। কালিয়াগঞ্জের মানুষ যদি সত্যিই এনআরসি ভীতির শিকার হতেন, তাহলে ২০১৬ বিধানসভার তুলনায় এত বেশি মানুষ এ বছর বিজেপিকে ভোট দিতেন কি? বোধ হয় না। ২০১৬ থেকে ২০১৯-এ কালিয়াগঞ্জে বিজেপির ভোট বেড়েছে ৬৭, ৭৬২ টি। ভয়ভীতি থাকলে এত ভোট বৃদ্ধি পেত না, বরং আরো অনেক বেশি ক্ষতি হতো বিজেপির। অথচ তা হয়নি, বরং এ বছর তৃণমূল কালিয়াগঞ্জ জিতেছে মাত্র ২, ৪১৪টি ভোটের ব্যবধানে। একথা সত্য যে। কালিয়াগঞ্জের বেশকিছু মানুষ যাঁরা। লোকসভায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, বিধানসভায় তারা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এই সকল ভোটাররের এমত মন পরির্তনের কারণ সম্ভবত এনআরসি ভীতি নয়। বরং ফ্লাইং ভোটাররা উপনির্বাচনে সচেতনভাবে শাসকদলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন এবং এটি বিজেপির পরাজয়ের অন্যতম প্রধান একটি কারণ। আবার লোকসভা ভোটের ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে তৃণমূলও এলাকার স্থানীয় ইস্যুগুলোতে যত্নসহকারে নজর দিয়েছে। এবং মানুষের কাছাকাছি পৌঁছেছে, সেটিও বিজেপির পরাজয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ফ্লাইং ভোটাররা তাতেই আবার তৃণমূলের দিকে ঢলেছেন এবং নির্বাচনের ফলাফলও তাতে বদলে গিয়েছে। এনআরসি ভীতির ভূমিকা এরমধ্যে কতটুকু আছে বা আদৌ আছে কিনা তা জানতে গেলে পৃথক সমীক্ষার প্রয়োজন।
এবার দেখা যাক, করিমপুরের তুলনামূলক চিত্র।
২০১৬-তে করিমপুর বিধানসভায় জয়ী হয়ে ছিলেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। পেয়েছিলেন ৯০,৯৮৯টি ভোট। সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ পেয়েছিলেন ৭৫,০০০ ভোট আর বিজেপির শুভাশিস ভট্টাচার্য (আনন্দ) ২৩,৩০৩টি ভোট। ঐ বছর এই বিধানসভায় মোট ভোট পড়েছিল ২,০১, ১০৬টি। সেই তুলনায় ২০১৯-এর উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিমলেন্দু সিংহ রায় পেয়েছেন ১,০২,২৭৮ টি ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির জয়প্রকাশ মজুমদার ৭৯,৩৬৮টি পেয়েছেন। সিপিএমের গোলাম রাব্বি পেয়েছেন ১৮, ৬২৭টি ভোট। এ বছর করিমপুর বিধানসভায় মোট ভোট পড়েছে ২,০৪, ৮০৫টি। অর্থাৎ এই বিধানসভায় আদতে কমেছে সিপিএমের ভোট এবং তার অধিকাংশই গিয়েছে বিজেপির খাতায়। ২০১৬ র তুলনায় সিপিএমের ভোট কমেছে (৭৫,০০০-১৮৬২৭) = ৬৫,৩৭৩টি আর বিজেপির ভোট ২০১৬-র তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে (৭৯,৩৬৮ – ২৩,৩০৩) = ৫৬, ০৬৫ টি। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই কেন্দ্রে সিপিএমের যে কটি ভোট কমেছে, তার প্রায় সবগুলিই গিয়েছে বিজেপিতে। অর্থাৎ গত ১২0১৬-র বিধানসভায় বিজেপির যা ফল হয়েছিল, সেই তুলনায় এ বছরের উপনির্বাচনে করিমপুরে বিজেপির ফল ভালো হয়েছে। ২০১৬-র তুলনায় এ বছর বিজেপি ৫৬,০৬৫টি ভোট বেশি পেয়েছে।
আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ বছরের উপনির্বাচনের তিনটি বিধানসভার মধ্যে একমাত্র করিমপুরেই ২০১৬তে সিপিএমের কিছু ভোট ছিল যা এবার তলানিতে ঠেকেছে। মুসলমান প্রার্থী গোলাম রাব্বিকে করিমপুরের বাম সমর্থকরা তেমন গ্রহণ করেননি। তবে কি সিপিএমের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সীমান্তবর্তী করিমপুর প্রত্যাখ্যান করেছে ? তৃণমূলের খাতায় ২০১৬-র তুলনায় এবছর বৃদ্ধি পেয়েছে (১,০৩,২৭৮ – ৯০,৯৮৯) = ১২,২৮৯টি ভোট। এবছর এই বিধানসভা কেন্দ্রে বাড়তি ভোট পড়েছে মাত্র (২,০৪, ৮০৫ – ২,০১,১০৬) = ৩,৬৯৯ টি। যদি ধরে নেওয়া যায় যে এই নতুন ভোটগুলির সবই গিয়েছে তৃণমূলের খাতায়, তা সত্ত্বেও তৃণমূলের ভোট ২০১৬-র তুলনায় ২০১৯-এ বৃদ্ধি পেয়েছে আরও ১২,২৮৯ – ৩,৬৯৯) = ৮,৫৯০টি। এই ভোটগুলি অন্য নানা প্রার্থীদের থেকে তৃণমূলের খাতায় গিয়েছে বলে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ তুলনামূলক দেখতে গেলে করিমপুরেও বিজেপির ফল খারাপ হয়নি, কিন্তু তৃণমূলের ফল হয়েছে আরও অনেক ভালো। তারা কনসলিডেট করেছে আরও মনোযোগ সহকারে। এ থেকে এও স্পষ্ট যে বুথ। লেভেল থেকে প্রতিটি ভোটার এবং তাদের নির্বাচনী পছন্দ-অপছন্দ সম্বন্ধে বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছে তৃণমূল। নচেৎ এমন কনসলিডেশন অসম্ভব ছিল।
করিমপুরের সিপিএম ভোট বিজেপির খাতায় আসা থেকে এও বোধ হয় প্রমাণিত হয় যে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ধর্মীয় মেরুকরণের চোরাস্রোত বইছেই। গোলাম রাব্বিকে ভোট দিতে হয়ত তারা রাজি হননি। তাছাড়া এনআরসি’র। বিরোধিতা সিপিএমের দিক থেকেও তীব্রভাবে হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সিপিএমের ভোটের (৫৬,০৬৫৭৫,০০০) = প্রায় ৭৫% ২০১৯-এ বিজেপিতে চলে যাওয়ায় এটা স্পষ্ট যে সিপিএমের এনআরসি বিরোধিতা এবং তাদের প্রার্থী গোলাম রাব্বি উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করেছেন করিমপুরের সিপিএম সমর্থকরা।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ এর আনন্দবাজার পত্রিকার একটি খবর, যা । উপরোক্ত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একেবারেই মিলে যায়। আনন্দবাজারের খবর অনুযায়ী, করিমপুরের সিপিএমের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ এখন বিজেপিতে। ২০১৬ করিমপুরের সিপিএম প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষও বিজেপিতে, এমনকী সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তাত্ত্বিক নেতা অনিল বিশ্বাসের করিমপুরবাসী পরিবারের অধিকাংশ সদস্যও বর্তমানে বিজেপিতে। ভোটের ফলাফলও এই তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভোটের ফলও দেখাচ্ছে যে করিমপুরে। বিজেপি টেনেছে সিপিএমের ভোট, তৃণমূলের ভোটে দাঁত ফোটতে পারেনি, বরং বুথভিত্তিক জনসংযোগের মাধ্যমে তৃণমূল কনসলিডেট করেছে। ছোটখাটো নানাদলের। প্রার্থীর ভোটও টেনেছে নিজের দিকে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এনআরসি। ভীতির প্রচার করিমপুরের মানুষকেও তেমন স্পর্শ করেনি। ভোট হয়েছে স্থানীয় মানুষের। স্থানীয় ইস্যুর নিরিখে।
কারণ সম্ভবত এই যে এখানকার বহু মানুষ যেহেতু আদতেইশরণার্থী এবং নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা বোঝেন, পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ইসলামিক নির্যাতনের প্রকৃতি আদতে কতখানি ভয়াবহ তা জানেন এবং নিজেদের শরণার্থী স্টেটাস সম্বন্ধে অবগত, সেইজন্যই তা নথিভুক্ত/পঞ্জীকরণ করানোর জন্য অর্থাৎ এনআরসি’র জন্য তারা হয়তো মানসিকভাবে প্রস্তুত। তাই এনআর সি-কে ভয়ও পান না। যাঁরা এমনিতেই নিরাপত্তাহীন, তাদেরকে আরও বেশি ভয় দেখানো যায়নি। বরং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা মানুষকে আরও বেশি ভয়। পাইয়ে দেওয়ার অমানবিক অপপ্রয়াস তৃণমূলের দিক থেকে হওয়াটাই অবাঞ্ছনীয় ছিল।
তাছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ হয়তো নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সম্বন্ধেও কিছুটা সচেতন এবং জানতে পেরেছেন যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ না করে এ রাজ্যে এনআরসি হবে না। সেই কারণেই হয়তো বর্ডার নিকটবর্তী বিধানসভাগুলিতে তৃণমূলের তরফ থেকে এনআরসি ভীতির প্রচার যদি হয়েও থাকে, তা সত্ত্বেও তা তৃণমূলের জন্য বড় একটা ফলদায়ী হয়নি। এবং সেই কারণেই এই দুটি বিধানসভায় বিজেপির ফল তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত ভালো। এবং এই একই কারণে সিপিএমের গোলাম রাব্বিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সিপিএমের ভোটাররাও।
এইসব কেন্দ্রগুলির লোকাল ইস্যুগুলি সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে এই দুটি কেন্দ্রের। বিজেপির পক্ষে তৃণমূলকে টপকে যাওয়া যথেষ্ট সহজ ছিল। কিন্তু লোকাল ইস্যু নিয়ে বিজেপি তেমন কাজ করেনি বলেই মনে হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর এনআরসি করলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মানুষের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে অনুমান করা যায়।
সীমান্ত থেকে দূরে, বিশেষত কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে এনআরসি সম্বন্ধে যে অপপ্রচার হয়েছে তা যথাসময়ে খণ্ডন করা হয়নি। অপপ্রচারের গতিবেগ ক্রমশ বেড়েছে, প্রত্যুত্তর দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে তা করার প্রয়োজন পড়বে এবং এনআরসি যে পশ্চিমবঙ্গের কোনো নাগরিককেই তার নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য তৈরি হবে না সে বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রচার প্রয়োজন।
তার জন্য বিজেপিকে তেমন বক্তাকে নিয়ে জনসভা করতে হবে, যারা এনআরসি কী, কেন, কী তার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বুঝবেন এবং সাধারণ মানুষকে সাধারণ মানুষের ভাষায় তা বুঝিয়েও দিতে পারবেন। সারা দেশে এনআরসি যে অসম এনআরসি’র মেথডোলজি বা পদ্ধতি অনুযায়ী হবে না, সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে হবে যাতে মানুষের হয়রানি হবে না, এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রচারের পরিকল্পনা, স্লোগান ও রূপরেখা তৈরি করার প্রয়োজন আছে।
দেবযানী ভট্টাচার্য
2019-12-05