লোকসভা ও রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুমোদন সংক্রান্ত বিতর্কের মধ্যে কমন পয়েন্ট কিছু ছিল না। বিলটি উভয়কক্ষেই স্বচ্ছন্দ গরিষ্ঠতা নিয়ে পাশ হয়ে গেলেও বিতর্কের চরিত্র ছিল লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন।
একদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল-সহ অসমের পথে ঘাটে যে বিক্ষোভ চলছে তার বক্তব্য হচ্ছে। যে বড়ো সংখ্যায় বাঙ্গলাদেশ থেকে আসা বিদেশি বাঙ্গালি হিন্দুদের সেখানে পাকাপাকি বসবাস করা নিয়ে। তারা সব ধরনের বিদেশিকেই অসম ছেড়ে চলে যাওয়ার দাবি জানাচ্ছে যারা ২৫/৩/৭১-এর বা তারও আগে সে রাজ্যে ঢুকেছে। অসমের বিক্ষোভকারীরা আদৌ চায় না যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, পার্সি বা জৈন যারা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের মধ্যে অসমে এসে বসবাস শুরু করেছে তাদের অনায়াসে নাগরিকত্ব প্রদান করে দেওয়া হোক। অর্থাৎ তারা। অসমের স্থায়ী নাগরিক হয়ে উঠুক।
অন্যদিকে রয়েছে আরেক ধরনের বিরোধিতা যা সাধারণভাবে সংসদে এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় দৃশ্যমান। এদের বক্তব্য অনুযায়ী এই বিল বৈষম্যমূলক ও প্রবলভাবে মুসলমান বিরোধী। তাদের মতে বিলটিকে এইভাবে সরাসরি ধর্মীয় চরিত্র প্রদান করা একান্তভাবে সংবিধান বিরোধী ও idea of India-র ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। এঁরা নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে পাকিস্তানের নীতি ও ধর্মীয় দেশের ঘরনায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রথম বিরোধীদের বিরোধিতার সত্যটা বোঝা যায়। অসম ও ত্রিপুরা এই দু’টি রাজ্যে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর মোটেই জনসংখ্যার বিন্যাসের ক্ষেত্রে এক বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিরাট সংখ্যক বাঙ্গলাভাষী হিন্দু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ হওয়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে এই দুটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এটা অবশ্যই সত্যি যে ঐ আগমনকারীদের একটা বড় অংশই অকথ্য ধর্মীয় নির্যাতনের কারণেই জান-মান বাঁচাতে এই রাজ্যে ঢুকেছে। কিন্তু এদের সঙ্গেই বহু মুসলমান ভারতের এই রাজ্যগুলিতে এসে অর্থনৈতিকভাবে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকেছে।
এই যুগ্ম অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে অসমীয় মাতৃভাষার অসমবাসীদের সংখ্যা তাদের রাজ্যেই ভয়ংকরভাবে তুলনামূলক কমে গেছে। তারা নিজ রাজ্যেই এই বিদেশি আগমনে। সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরার সামাজিক পরিচয়টিই হারিয়ে যাবার মুখে পড়েছে। এর থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে হিন্দুশরণার্থী ও বৌদ্ধ চাকমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে সেখানে নিশ্চিত অসন্তোষ রয়েছে। অবশ্য এই দুটি সম্প্রদায়ের লোক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক সংহতি নষ্ট করার মতো বিপজ্জনক নয়। কিন্তু জনসংখ্যার ভারসাম্যের ও অসম রাজনীতির চরিত্রগত পরিবর্তন নিয়ে যে রাজ্যবাসীর উদ্বেগ তা যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। কেননা তারা নিজেদের মঙ্গলের দিকটিই হারিয়ে ফেলার চিন্তায় ভুগছে। সারা ভারতের অন্যান্য অংশে কিন্তু এই ধরনের আশঙ্কার কোনো পরিস্থিতি নেই। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ১৯৪৭ থকে ৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে রীতিমতে পরিকল্পনা করে অত্যাচারের মাধ্যমে দেশছাড়া করা হয়েছে। এগুলি বিভিন্ন মাধ্যমে নথিভুক্ত হয়ে আছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে যেরকম রাতারাতি হিন্দু বিতাড়ন করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে অত দ্রুততায় ও একলপ্তে তা না হওয়ার বিষয়টা আনেকে খাটো করে দেখেন। প্রথম দিকে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে হয়তো পূর্ব পাকিস্তান একটি বহুধর্মীয় চরিত্র ধরে রাখতে পারবে।
আমাদের দেশের গণপরিষদে ১১ জুলাই ১৯৪৮ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময় রাখা হয়েছিল যখন নাগরিকরা ঠিক করে নিতে পারবে তারা পাকিস্তানে যাবে না ভারতে থাকবে। এর পরে পরেই ১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে উভয়দেশই তাদের সংখ্যালঘু সমাজকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার অঙ্গীকার করে। এর ২১ বছর পরে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম হলো তখন এটা সহজেই বিশ্বাস করা গিয়েছিল যে এইবার অন্তত হিন্দু ও বৌদ্ধ সংখ্যালঘুরা নতুন দেশে শান্তি ও মর্যাদায় জীবন যাপন করতে পারবে।
এই চুক্তিতে আস্থাবানরা এটাও বিশ্বাস করেছিলেন যে, ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার অত্যাচারে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারতে প্রবেশ করেছিলেন তাদের একটা বড়ো অংশই যুদ্ধ মিটতে সে দেশে ফিরে গেছেন। বাস্তবে এঁরা আদৌ ফিরে যাননি। বাঙ্গলাদেশ থেকে নিয়মকরে ভারতে ঢোকাও আদৌ বন্ধ হয়নি। এই সত্যটি বহু মহলে কানাঘুসোয় বা কখনো সোচ্চারে মেনে নেওয়া হলেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে এ বিষয়ে কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টাই হয়নি। অবশ্যই নাগরিকত্ব সংশোধন বিল (CAB) এই দীর্ঘকালীন সমস্যাটিকে বৃহত্তর পটভূমিতে দেখার সুযোগ পায়নি, তবুও হিন্দু ও বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সুযোগ দিয়ে তারা যে চিরস্থায়ী ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে পাকাপাকিভাবে উদ্বাস্তুর অপমানজনক জীবন যাপন করছিল সেই যন্ত্রণা অন্তত কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করেছে। সাধারণ দৃষ্টিতে এই পলায়নকারীদের উদ্বাস্তু হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত, কখনই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নয়। কিন্তু ১৯৪৭-৪৮ থেকেই তাদের এই নির্যাতিত হয়ে ভারতে আসার বিষয়টিকে দেখেও না দেখার ভান করা হয়েছিল, যার ফলে তারা কোনো সামাজিক পরিচয় পায়নি। যেন কোনো আশাহীন অদৃশ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করত। ভাবলে অবাক হতে হবে প্রাক্ স্বাধীনতা পর্বে এই মানুষদেরই বহু পূর্বপুরুষ। স্বাধীনতার লড়াইয়ে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। আর তাদেরই ধর্মীয় নির্যাতনকারীদের অনুকম্পার বস্তু হিসেবে জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়েছিল। এটি হয়েছিল ভারতের একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির ছলনাকে টিকিয়ে রাখার কারণে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এই মহাবিচ্যুতি ও অন্যায়েরই প্রতিকার। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হিন্দুরা ভারতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থান। নিয়ে বসবাস করতে পারবে। একটি ঐতিহাসিক ভুলেরই সংশোধনী হলো, অতীতে পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এঁদের অবস্থানে সমতা ফিরল।
একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের বেদনাদায়ক পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের সমস্যা কিছুটা সুরাহা করার অর্থ কিন্তু এই নয় যে ভারত ওই তিনটি দেশের নীতিকেই অনুসরণ করছে। অর্থাৎ তারা যেমন ধর্মীয় দেশের অনুশাসন মেনে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লোককেই গুরুত্ব দেয় বাকিরা অত্যাচারিত হয় এমনটা নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যে সমস্ত পাকিস্তানি রাজাকাররা এদেশে ঢুকেছিল, তাদেরও কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না এমন দাবি বাস্তবের সম্পূর্ণ বিচ্যুতি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অন্যায়। দু’ ধরনের মানুষকে এই সূত্রে এক দৃষ্টিতে দেখা ঘোরতর অপরাধ। যাঁরা CAB নিয়ে এই ধরনের বিরোধিতায় নেমেছেন ও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে দুটি জিনিসকে একই পঙক্তিতে বসিয়ে গুলিয়ে দিচ্ছেন তারা এই ধরনের বিকৃত মানসিকতার কাজই করছেন।
CAB গোটা সমস্যাটির একটি খণ্ডাংশের ওপর ব্যবস্থা নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করা সংক্রান্ত বিষয়টিই কেবল তার অন্তর্গত। কিন্তু যে সমস্ত লোক ভারতে ঢুকে বসবাস করছে অথচ বোঝা যাচ্ছে তারা নিশ্চিতভাবে অবৈধ নাগরিক সেই সমস্যার দিকে নজর দেওয়া এখনও বাকি। এই বিলের মাধ্যমে একটি নাগরিক সমস্যা সমাধানের আন্তরিক প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। সকলেরই সেই বিষয়টিকে সংবেদনশীলতার সঙ্গে বোঝা উচিত। ভারতমাতার কাছে আশ্রয়পার্থী ও নিরাপত্তা ভিক্ষুদের দেশ যে ফেরায়নি এই বিল তারই প্রমাণ।
স্বপন দাশগুপ্ত
2019-12-26