বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা বাঙ্গালি না মুসলমান?

শিরোনামে উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান একাধিক কারণে অতীব প্রয়োজনীয়। দুই বঙ্গের বাঙ্গালিদের পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতা ও সীমাবদ্ধতা এই উত্তরে নিহিত। এর অনুসঙ্গ হিসেবে দুই বঙ্গের মুসলমানদের প্রভাব বিকীরণের বিষয়টিও এই উত্তরের সঙ্গে জড়িত।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তে পাকিস্তানের সৃষ্টি আলোচনার শীর্ষে চলে আসবে। প্রাক ১৯৪৭ ভারতে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ও সমর্থন ব্যতীত পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। কিন্তু করাচী-রাওয়ালপিণ্ডিইসলামাবাদ ভিত্তিক পাকিস্তানি শাসককুল পূর্ববঙ্গের (১৯৫৬ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের) গণতান্ত্রিক আশাআকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতিদানে অনিচ্ছুক ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে ঘোষণা করা হয় যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। এটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, যেহেতু পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ ছিল বাংলাভাষী। কিন্তু এর প্রতিবাদে আমরা কতটা বাঙ্গালিত্বের প্রতাপ দেখেছিলাম? তেমন কিছু নয়। অল্পসংখ্যক ছাত্র এবং প্রাদেশিক সচিবালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ বর্গের কর্মীরা ওই ঘোষণার প্রতিবাদ করে। কিন্তু খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন চুপচাপ সরকারি আনুকূল্যের প্রত্যাশায়।

এই ঘটনাটি আদৌ প্রচার পায়নি কিন্তু পরবর্তী একটি ঘটনা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উপলক্ষ্যে মুহাম্মদ আলি জিন্নার ঘোষণা ও উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাত্রা ছিল কতখানি? আবারও তেমন কিছু নয়। নাইমুদ্দিন আহমেদ নামে একজন মাত্র ছাত্রের নেতৃত্বে তার কতিপয় সতীর্থ জিন্নার ঘোষণার বিরুদ্ধে চিৎকার করে বলে ও ‘না, না। কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হচ্ছিল। হলের বাইরে যাওয়ামাত্র নইমুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশি হাজতে রেখে তার ওপর অত্যাচার করা হয়। নইমুদ্দিনের সমর্থক কিছু ছাত্রকেও নানারকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কাউকে কাউকে দীর্ঘ ও কঠোর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। কেউ কেউ পলাতক হয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত এই কতিপয় ছাত্র কোনওদিন তাদের প্রাপ্য সম্মান পায়নি; তাদের ক্রন্দন অঞত; তাদের গল্প অকথিত। অতএব প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ভাষা না ধর্ম। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে কতিপয় ভাষা আন্দোলনকারীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ইতিপূর্বে ভাষা আন্দোলন উপস্থাপনের বার্ষিক তিথি ১১ মার্চের স্থলাভিত্তিক হয় ২১ ফেব্রুয়ারি।

ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পূর্বে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের অনুকূলে ছিল? মোটেও না। দেখা গেল, পূর্ববঙ্গে জিন্নার গুণমুগ্ধ মুসলমানদের সংখ্যা অগণিত। জিন্নার প্রশংসায় প্রবন্ধ, নাটক ও কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল। উপরন্তু সদ্য-প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ভাবনা ও আদর্শের আলোচনায় কোনোও দোষ ছিল না, এবং ইসলামের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ছিল স্বাভাবিক। কারণ পাকিস্তান ছিল সংখ্যাধিক্য মুসলমানের দেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের সামূহিক হিতসাধনে শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদিতে আধুনিক ধ্যানধারণার আলোচনায় তদানীন্তন মুসলমান বিজ্ঞানী, কবি, লেখকরা যে অনাগ্রহী ছিলেন সেটাও অনস্বীকার্য। এভাবে তারা ছিলেন নিজেরা পথভ্রষ্ট এবং সাধারণ মুসলমানকেও পথনির্দেশে ব্যর্থ। ইসলাম ও জিন্নার জয়গানই যেন মুখ্য।

অথচ, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এই বুদ্ধিজীবীরাই যেন ছিন্ন বসন পরিত্যাগ করে নতুন বেশ গ্রহণে উদ্যোগী হলেন। এই উদ্যোগ কতটা আন্তরিক ছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল মাত্র নয় মাসের। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে ১৯৪৭- পরবর্তী পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামি লিগ পাকিস্তানের সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু ১৯৬৬ সালে প্রণীত যে ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনী লড়াই পরিচালিত হয়, তার মূলে ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবি, যাতে শক্তিশালী পশ্চিমাঞ্চলের শাসকরা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে নানা ক্ষেত্রে শোষণের সুযোগ না পায়। স্বাধীনতার দাবি তো দূরে থাক, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ক্ষীণ ধ্বনিও ছিল অস্ফুট।

এদিকে, ১৯৬০-এর দশকেই সেনাপতি আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেখানে নিতান্তই আত্মরক্ষার তাগিদেমৃতপ্রায় ভাষা আন্দোলনে একটু প্রাণসঞ্চারের প্রয়োজন হলো। যেহেতু মুসলমান হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সমকক্ষ হওয়া গেল

, অতএব বাংলাভাষা, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত ইত্যাদি দ্বারা আপন ঘরে ফিরে চলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ছিল এতটাই উৎপীড়ন ও দমনমনস্ক যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফল ধ্বংসার্থে ২৫ মার্চ ১৯৭১ স্বদেশীয় পূর্ব পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নির্মম সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ প্রায় সাড়ে তিন মাস সময় অসহযোগ আন্দোলন করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানিদের কোনো বিকল্প ছিল না। প্রায় ২৪ বছর পাকিস্তানের ইসলামি শাসনে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিরা প্রায় পুরাপুরি (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) পাকিস্তানি ভাবধারার অনুসারী হয়। তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের অনুগামী হয়ে নিজেদের বাঙ্গালি হিন্দুদের থেকে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

অতএব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের বিদায়ের শেষবাণীর মতো শেখ মুজিবুরের যে বিখ্যাত ভাষণ তাতে আবেগ ছিল, বাগ্মিতা ছিল, কিন্তু এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই শেষ পঙক্তিটি ছিল অস্পষ্ট আর্তনাদের অস্বচ্ছ কলরোল। মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা পরিচালনায় খুব একটা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু দেশজও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাচক্রের টানাপোড়েনে ভারতকে শেষ পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে নতুন একটি নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

কিন্তু তার পর ? বাংলাদেশের মুসলমানদের বাঙ্গালিত্বে প্রত্যাবর্তন কি সুদৃঢ় ও সাবলীল হলো? একেবারেই না। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাবে রচিত। এতে ছিল পরমধর্মসহিষ্ণুতা (যাকে প্রান্ত ভাবে সেকুলারিজম বলা হয়)। কিন্তু ১৯৭২ সালে ক্ষমতার অধিষ্ঠিত শেখ মুজিবুর রহমান (যাকে হাস্যকরভাবে বাংলাদেশের অধিবাসীরা অদ্ভুত ভোটদানের মারফত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হিসেবে অভিহিত করেছে) নিজেও সেকুলার ছিলেন না। তিনি অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রণয়ন করে অভিনব কৌশলে হিন্দু বিতাড়নের স্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। ১৯৭২ এর সংবিধানের ৩৮ ধারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রুদ্ধ করে। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শেখ মুজিবের হত্যার পর সেনাপতি জিয়াউর। রহমান ৩৮ ধারা লুপ্ত করেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করলো। পাকিস্তান ও ইসলামের অনুসারী শক্তিগুলি যাতে তাকে ক্ষমতাচ্যুত না করতে পারে এজন্য জিয়া ১৯৭৬ সালে একটি নির্দেশিকা জারি করেন, যাতে দেশটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলির অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে যায়। জিয়ার উত্তরসূরি সেনাপতি এইচ এম এরশাদ ইসলামিকরণকে আরও সতেজ করেন; এমনকী রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর মতো অনুষ্ঠানেও মিলাদ প্রবর্তন করেন। ১৯৮৩ সালে নতুন শিক্ষানীতিতে এরশাদ আরবি অবশ্যপাঠ্য করেন। ১৯৮৮ সালে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দিলেন, কোনও আন্দোলন প্রতিবাদ হলো না। ১৯৪০ এর দশকে বাঙ্গালিত্ব মুছে যে ইসলামি পরিচিতি প্রাধান্য পেয়েছিল, ১৯৮০-র দশকের পর তার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে সংগতি রেখে মাদ্রাসা শিক্ষার বিপুল প্রসার হলো। ইসলামিকরণের পরিবর্ধনে এরশাদের পর খালেদা জিয়ার সরকারও তৎপর ছিল। জামাত-এ-ইসলামির সমর্থনেই তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য তিনি জামাতের মনমতো কাজই করতে থাকেন। যেমন তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসের বিরুদ্ধে তার প্রতিক্রিয়া ছিল মাত্রাতিরিক্ত প্রতিকূল। কারণ এ নয় যে ওই উপন্যাসে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা ছিল। কারণ সেটাতো আদৌ অজানা কিছু নয়। কিন্তু ওই ঔপন্যাসের জাতীয় আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তার ফলে সমস্যাটি যেন অনেকের মনশ্চক্ষু উন্মীলিত করে। অতীতে অবস্থা ছিল অত্যাচারের প্রচারের অভাব যেন অত্যাচারেই অনুপস্থিতি। খালেদার হিন্দু-বিরোধী নীতি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের তুষ্ট করে। কিন্তু জামাত খুশি ছিল না, কারণ জামাত শরিয়ত আইনের প্রবর্তন চায়, যেটা খালেদার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আর জামাতও আওয়ামি লিগের সঙ্গে হাত মেলাতে বিলম্ব করেনি। রাজনৈতিক বিবর্তন জটিল হয়ে। গেল। সব কিছু বর্ণনার অবসর এখানে নেই। অতএব ঘটনাপ্রবাহকে একটু ছোটো করে এনে বর্তমান আওয়ামি লিগ সরকারের প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করা যাক। সামরিক শাসনকালে ১৯৭২ এর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে

মুখবন্ধে ‘বিসমিল্লাহির হমানিরহিম’ সন্নিবিষ্ট করে সেকুলারিজম ইত্যাদিকে লুপ্ত করা হয়। অষ্টম সংশোধনী দ্বারা ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হয়। সুখের বিষয়, সামরিক আমলের এই দুই সংশোধনীই দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১০ সালে প্রত্যাখান করে। এতত্সত্ত্বেও, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী মারফত শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ সরকার সংবিধানের মুখবন্ধে ‘বিসমিল্লাহিরহমানিরহিম’কে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম এটাও সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করে। আওয়ামি লিগ নিজেকে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি। করে। এর নেত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু বহুবার হজ যাত্রা করেছেন, হিজাব পরিধানেও তিনি অভ্যস্ত।

জামাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা স্থাপনে। আওয়ামি লিগ আদৌ ব্যগ্র নয়, যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতার ফাসির বন্দোবস্ত শেখ হাসিনা করেছেন। অথচ, জামাতের সংবিধান অনুযায়ী এই সংস্থা বাংলাদেশকে ইসলামি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজধানী ঢাকা এবং নানা জেলায়ও ইসলামি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ক্রমাগত প্রসার লাভ করছে। অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কানট্রিজ (ওআইসি) ঢাকাকে ইসলামি কৃষ্টির কেন্দ্র বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৪ লক্ষ কওমি মাদ্রাসা বিদ্যমান। এরা পুরোদস্তুর ইসলামি দেশ স্থাপনে ব্যস্ত। এই মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যসূচি পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলির সমতুল্য।

পাকিস্তানে আয়ুব সরকার ব্যুরো অব ন্যাশানাল রি-কনট্রাকশন (বিএনআর) মারফত হিন্দুগন্ধী নাম ইত্যাদি বর্জন করে ইসলামি সংস্কৃতির প্রচারকল্পে কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম ফাতেমাজা রাখে (শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট)। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধ্বজাধারী হাসিনা সরকারের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এন সি টি বি পাকিস্তানের বি এন আর-এর প্রতিরূপ। তাই জামাতের অন্যতম প্রতিভূ হেফাজত-এ-ইসলামের নির্দেশে পাঠ্যপুস্তক রচিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া পাঠ্যপুস্তকে মৌলবাদী নানা পরিকল্পনা অনুপ্রবিষ্ট সম্প্রদায়, জাতি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রচারিত হচ্ছে। সরকার জঙ্গিবাদের প্রতি শূন্য সহনশীলতার প্রচার করলেও পাঠ্যপুস্তকে সুকৌশলে অনতিসুপ্ত জঙ্গিবাদ কায়েম হচ্ছে। ২০১৯ সালে ঢাকার জাতীয় শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পঞ্চম শ্রেণীর পুস্তকে অমুসলমানদের মিথ্যাচারী, সম্পত্তি বেদখলকারী, ভ্রষ্টাচারী ও পশুর চাইতেও অধম বলে বর্ণনা করেছে।

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রায় অবিশ্বাস্য। হেফাজতের লিখিত নির্দেশে সংযোজন-বিয়োজন করে ২৯টি প্রস্তাব সরকার বিশ্বস্তভাবে পালন করেছে। এভাবে নাকি হিন্দু তাত্ত্বিকতা ও নাস্তিক্যবাদের কবল থেকে মুসলমান বিদ্যার্থীদের রক্ষা করা যাবে। বর্জিত লেখকদের সবাই হিন্দু নয়। অসাম্প্রদায়িক মুসলমান লেখকও আছেন। অতএব এস ওয়াজেদ আলির ‘রাঁচী ভ্রমণ’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙ্গালির কথা, সুকুমার রায়ের ‘আনন্দ’, লালনের সময় গেলে সাধন হবে না’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ বর্জ্য পদার্থ। এই লেখাগুলি পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, সাহিত্যরস, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা বিকীরণ করে। সুতরাং হেফাজতের মাপকাঠিতে বর্জনীয়।

এসব কার্যকলাপের সাফল্যের জন্য যে ধর্মীয় সংস্কৃতিক পরিকাঠামো প্রয়োজন সেটা প্রবর্তন ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সৌদি আরব থেকে বিপুল আর্থিক সাহায্য পেয়েছে। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটা রূপায়ণে সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তা জরুরি। কারণ প্রতি জেলায় ও উপজেলায় ৫৬০টি আদর্শ মসজিদ স্থাপন ও বহুমুখী ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গঠন অতীব ব্যয়সাধ্য। প্রতিটি সংস্কৃতিক কেন্দ্রে ইসলামি পাঠাগার থাকবে, ইসলামি অনুশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও মওলানাদের বহুবিধ নির্দেশনামা পঠনপাঠন কেন্দ্র ইতিমধ্যেই গঠিত হয়েছে, অথবা শীঘ্র গঠিত হবে।

এই যে বাংলাদেশের মুসলমানদের বাঙ্গালিত্বের অধোগামিতা ও মুসলমানত্বের ঊর্ধ্বগামিতা, তার প্রভাব কি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ওপর দৃশ্যমান? কারও কারও মতে, এইমুহূর্তে দিল্লি-বিরোধী যে আন্দোলনে হিন্দুদের নেতৃত্বেই সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল, সেখানে বাংলাদেশের মুসলমানদের মানসিকতা কি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর নিরপেক্ষ মূল্যায়নের প্রতীক্ষায়।

ইতিমধ্যে অত্যল্প যে ক’জন বাংলাদেশি মুসলমান বুদ্ধিজীবী মুসলমানত্বের বলয়ের বাইরে বাঙ্গালিত্বের নিভু নিভু প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে সচেষ্ট, তাদের প্রতি সম্ভ্রম জানিয়ে এই প্রবন্ধের উপসংহার টানা যেতে পারে।

ড. জয়ন্তকুমার রায়

(লেখক ন্যাশনাল রিসার্চ প্রফেসর, মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এবং সাম্মানিক অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.