মাটির নীচে হিন্দু স্থাপত্য ওপরে বাবরের জবরদখল

ইতিহাস কখন বাঁক বদলাবে আগে থেকে বলা যায় না। সময় হলে ইতিহাস নিজেই তার আত্মপ্রকাশের রাস্তা খুঁজে নেয়। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রকৃত ইতিহাস চেপে রাখার চেষ্টা কম হয়নি। বস্তুত ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ চিরকালের জন্য গুমঘরে পাঠিয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছেন বাম ও কংগ্রেস পোষিত ইতিহাসবিদেরা। আশার কথা মোদী সরকারের আমলে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের পুনরুদ্ধারের কাজ জোরকদমে শুরু হয়েছে। এবং সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত এই প্রয়াসকে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছেন।
অযোধ্যা মামলার রায় দিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালত আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার উৎখননের রিপোর্টটি বিশেষ গুরুত্ব। সহকারে বিবেচনা করেছেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৫-৭৬ সালে প্রথমবার, ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বাবরি মসজিদে খননকার্য চালিয়েছিল। তারই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের পর্যবেক্ষণ : মাটির নীচে যে স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে সেটা হিন্দু রীতির। তাকে কখনই ইসলামিক ধাঁচের স্থাপত্য বলা যায় না। ওখানে রামমন্দির ছিল কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা গেলেও, ওখানে যে হিন্দুদের কিছু একটা ছিল সেটা স্পষ্ট। অর্থাৎ বাবর খালি জমিতে মসজিদ বানাননি।
বস্তুত, আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ১৮৬২-৬৩ সাল থেকে রামজন্মভূমি মন্দিরের পাথুরে প্রমাণ খোঁজার প্রয়াস করে আসছে। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৬২-তে অযোধ্যায় গিয়েছিলেন বৌদ্ধ যুগের ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহের কাজে। উল্লেখ্য, এক সময় অযোধ্যা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ কেন্দ্র। পর্যটক ফা-হিয়েন অযোধ্যাকে শা-চি নামে বর্ণনা করেছেন। হিউয়েন সাঙের লেখায় অযোধ্যা সাকেত বা সকেত। গৌতম বুদ্ধ এই শহরে জীবনের ছটি বছর অতিবাহিত করেছেন। কানিংহাম রামজন্মস্থানে কোনও মন্দির দেখেননি। লিখেছিলেন, সম্ভবত মহাভারতের যুদ্ধের পরই রামজন্মস্থানের মন্দির এবং প্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। মহাভারত উদ্ধৃত করে কানিংহাম লিখে গেছেন, ইক্ষাকু বংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্বল (রামের বত্রিশতম উত্তরপুরুষ) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। যুদ্ধে তিনি নিহত হন। কানিংহামের মতে তারপরই অযোধ্যার মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রাজা বিক্রমাদিত্য এখানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ যখন অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তখন সেই মন্দিরের কোনও চিহ্ন ছিল না। সপ্তম শতকে অযোধ্যা পুরোপুরি বৌদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছিল।
১৮৮৯-৯১ সালে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার একটি দল অ্যালয়িস অ্যানটন ফুহরারের নেতৃত্বে অযোধ্যার প্রাচীনত্ব নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। কিন্তু তারা অযোধ্যায় কোনও উল্লেখযোগ্য প্রাচীন মূর্তি, স্থাপত্য বা স্তম্ভ দেখতে পাননি। কিন্তু শহরের নানা জায়গায় বাড়ি বা প্রাসাদ নির্মাণে ব্যবহৃত ইট কাঠ পাথর চুনসুরকির মশলা ইত্যাদি যা এক কথায় রাবিশ নামে পরিচিত তার স্তুপ দেখেছিলেন। এইসব মালমশলা ফৈজাবাদের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো। স্থূপগুলির মধ্যে প্রাচীনতম তিনটির নাম মণিপর্বত, কুবের পর্বত এবং সুগ্রীব পর্বত। কানিংহাম ভেবেছিলেন এইসব স্থূপ বৌদ্ধ গুম্ফার ধ্বংসাবশেষ। কানিংহামের মতো ফুহরারও বিশ্বাস করতেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বৃহদ্বলের মৃত্যুর পর অযোধ্যা ধ্বংস হয়ে যায়। পরে তা বিক্রমাদিত্য নির্মাণ করেন। স্থানীয় মানুষের। সঙ্গে কথা বলে ফুহরার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে ইসলামিক আক্রমণের সময় অযোধ্যায় তিনটি মন্দির ছিল। জন্মস্থানম্ (যেখানে রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন), স্বর্গদ্বার (যেখানে রামকে দাহ করা হয়েছিল) এবং ত্রেতা কে ঠাকুর (যেখানে রাম কোনও এক ব্রতপালন করেছিলেন)। ফুহার লিখেছেন, মির খান (মির বাকি ?) জন্মস্থানম্ মন্দির ধ্বংস করে ৯৩০ হিজরিতে (১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ) বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন। ফুহরার লিখেছেন। বাবরি মসজিদ নির্মাণে জন্মস্থানম্ মন্দিরের বহু স্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছিল। যার মধ্যে তিনটি ছিল কালো পাথরের, স্থানীয়রা একে বলত কসৌটি। অওরঙ্গজেব স্বর্গদ্বার এবং ত্রেতা-কে-ঠাকুর মন্দির ধ্বংস করে ওখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে তাও ধ্বংস হয়ে যায়। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ থেকে ১২৪১ সম্বতে (১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) কনৌজরাজ জয়চন্দ্রের খোদাই করা একটি শিলালেখ পাওয়া গেছে যা থেকে জানা যায়। ত্রেতা-কে-ঠাকুর মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি ছিল। শিলালেখটি ফৈজাবাদ জাদুঘরে সুরক্ষিত রয়েছে।
স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে গেল। ইতিহাস অনুসন্ধানের যে স্বাভাবিক স্পৃহা ব্রিটিশ সরকারের ছিল, সদ্য স্বাধীন ভারতের নতুন সরকার বা কংগ্রেস নেতাদের তা ছিল না। উপরন্তু, ভারতের প্রকৃত ইতিহাস যাতে সদাসর্বদা গোপন থাকে তার জন্য তারা সচেষ্ট থাকতেন। ফলে রাম জন্মভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান একরকম ধামা চাপা পড়ে গিয়েছিল বলাই ভালো। শুরু হলো ১৯৭৫-৭৬ সালে। খ্যাতনামা প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক বি.বি.লালের নেতৃত্বে একটি দল রামায়ণে বর্ণিত মোট চোদ্দটি জায়গায় অনুসন্ধান চালাল। কিন্তু এই সমীক্ষক দলের রিপোর্ট প্রকাশ করেনি সরকার। বহু বছর পরে ১৯৯০ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ অনুপ্রাণিত মন্থন পত্রিকায় বি.বি.লাল দাবি করেন তারা মাটির নীচে কিছু স্তম্ভের শেষাংশ (বেদী বলাই ভালো) পেয়েছেন যা কোনও মন্দিরের অংশবিশেষ হতে পারে।
বি.বি.লালের নেতৃত্বাধীন দলটি পাঁচটি অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। অযোধ্যা, ভরদ্বাজ আশ্রম, নন্দীগ্রাম, চিত্রকূট এবং শৃঙ্গভেরপুর হলো সেই পাঁচটি অঞ্চল। প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি মাটির নীচে বেশ কয়েকরি স্তম্ভবেদী আবিষ্কার করেছিল। যা থেকে ওরা সিদ্ধান্ত নেন এক সময় এখানে বাবরি মসজিদের থেকে অনেক বড়ো কোনও স্থাপত্য ছিল। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার সমীক্ষক দলের দাখিল করা প্রাথমিক রিপোর্ট হিমঘরে পাঠিয়ে দেয়। সমীক্ষাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পর্ষদের (আই সি এইচ আর) পত্রিকায় রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালে বি বি লাল তার গ্রন্থ রামা : হিজ হিস্টরিসিটি, মন্দির অ্যান্ড সেতুতে লিখেছিলেন, বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে এবং আশেপাশে বারোটা পাথরের স্তম্ভ পাওয়া গেছে যেখানে নানারকম হিন্দু আধ্যাত্মিক চিহ্ন এবং হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি খোদিত দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে স্পষ্ট, এইসব স্তম্ভ বাবরি মসজিদের অংশ নয়। এগুলো মসজিদ তৈরির আগেই কোনও হিন্দু স্থাপত্যের অংশ ছিল।
১৯৯২ সালে রামকোট পাহাড়ের কাছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালায় আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। নেতৃত্বে ছিলেন ড. ওয়াই ডি শর্মা এবং ড. কে এম শ্রীবাস্তব। ওরামাটির নীচে বহু হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে একটি বেশ বড়োসড়ো বিষ্ণুমূর্তি পেয়েছিলেন। ওদের মতে এই মূর্তি বড়ো কোনও মন্দিরে (ত্রেতা-কে-ঠাকুর মন্দির ?) ছিল। অধ্যাপক এস. পি. গুপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক দলটির আবিষ্কৃত মূর্তি পরীক্ষা করে বলেছিলেন, মূর্তি-সহ যেসব জিনিস পাওয়া গেছে সেগুলি দশম এবং দ্বাদশ শতাব্দীর। সেই সময় প্রতিহার এবং গাহড়োওয়াল রাজবংশের শাসন ছিল।
এর পর ২০০৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনৌ বেঞ্চের নির্দেশে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে আর একবার খননকার্য চালানো হয়। এতে অংশগ্রহণকারী ১৩১ জন শ্রমিকের মধ্যে ৫২ জন ছিলেন মুসলমান। ২০০৩ সালের ১১ জুন সমীক্ষার অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করা হয়। অন্তিম রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ওই বছরের আগস্ট মাসে। রিপোর্টে বলা হয়েছে : বাবরি মসজিদের নীচে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ অভিমুখী ইটের পাঁচিল পাওয়া গেছে। এছাড়া পাওয়া গেছে চিত্রায়িত রঙিন মেঝে, অনেকগুলো স্তম্ভবেদী এবং একটি ১.৬৪ মিটার দৈর্ঘ্যের কালো পাথরের অলংকৃত স্তম্ভ। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, পাওয়া গেছে একটি সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ যার দুদিকে কালো বেসাল্ট পাথরে নির্মিত দুটি স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে প্রস্ফুটিত পদ্মে পায়ের ওপর পা রেখে বসে থাকা কারোর আবক্ষমূর্তি। যার দুদিকে পেখম মেলে নৃত্যরত দুটি ময়ূর।
উৎক্ষননের ফলে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের। ভিত্তিতে সমীক্ষকেরা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিলেন যে কোনও এক সময় বাবরি মসজিদের নীচে এক সুবিশাল স্থাপত্যের অস্তিত্ব ছিল। এবং এই স্থাপত্য ছিল হিন্দুরীতির। কারণ প্রাচীনকালে নির্মাণরীতি ছিল উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম অভিমুখী। অনেক পাথরের প্লেট পাওয়া গেছে যা পদ্ম কৌস্তভ মণি ইত্যাদি হিন্দু চিহ্ন দ্বারা অলংকৃত। এই ধরনের প্লেট প্রাচীরের গায়ে লাগানো হতো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে প্লেটগুলি অন্তত ১৫০০ বছরের পুরনো। আবার কিছু প্লেট পাওয়া গেছে যার বয়েস ২৫০০ বছরের কম হবে না।
সম দূরত্বে নির্মিত ৩০টি স্তম্ভবেদী পাওয়া গেছে। সমান্তরাল দুই সারিতে সাজানো বেদীগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখে নির্মিত। পাওয়া গেছে একটি অষ্টকৌণিক যজ্ঞকুণ্ড। ২০০০ বছর ধরে ভারতে গৃহনির্মাণে সুরকি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রাম জন্মভূমির মন্দির নির্মণে সুরকির বহুল ব্যবহার হয়েছিল। মন্দির নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল একদিক। বাঁকানো— এমনকী বৃত্তকার গড়নের ইট। গৃহনির্মাণে এই রীতি প্রাচীন ভারতবর্ষে। অনুসরণ করা হতো। ইসলামিক শাসন প্রবর্তিত হবার পর এর চল ছিল না। আধুনিক ভারতেও গোলাকার ইট ব্যবহার করা হয় না। গুপ্তযুগ এবং কুষাণ যুগের ইট পাওয়া গেছে। গাহড়োয়াল যুগে তৈরি পাঁচিলও পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তবে এই অঞ্চলে সাধারণ মানুষের বসবাসের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিমত, স্থানটি ছিল অত্যন্ত পবিত্র। এখানে এমন কারোর মুর্তি ছিল যার পুজো হতো সাড়ম্বরে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যকামীরা তাঁর কাছে আসতেন। অযোধ্যায় এখনও তীর্থযাত্রীরা সমবেত হন। সরযূ নদীতে স্নান করে শ্রীরামের পুজো করেন।
২০০০ বছর আগেও ছবিটা সম্ভবত এখনকার মতোই ছিল। অন্তত ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ বিচার করলে তাই মনে হয়।
চন্দ্রভানু ঘোষাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.