ভারতের মহান সন্তান, ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নানাবিধ কৃতিত্বে বাঙ্গলা তথা সারা দেশ গৌরবান্বিত। শিক্ষাবিদ , মানবিকতাবাদী, রাজনৈতিক – নানা গুণের একত্র সমাবেশ হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে। কিন্তু মুসলিম লিগ ও বাঙ্গলার কমিউনিস্ট দল সর্বদাই তার অবদানকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছে, তাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওই সময়ে (১৯৪১-৪৩) আর এক বাঙ্গালি, কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হকের নেতৃত্বে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সে প্রসঙ্গে আসার আগে সংক্ষেপে ওই সময়ের বাঙ্গলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনা করা প্রয়োজন।
ওই সময়ে এ কে ফললুল হক বাঙ্গালি মুসলমান কৃষকদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে তার সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেলেও সাধারণভাবে তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সংহতির নীতি জিন্নাহর লিগপন্থী নেতারা কিছুতেই বরাদাস্ত করতে পারছিলেন না। তারা নানা অছিলায় তাকে বাঙ্গালি মুসলমানদের কাছে অপ্রিয় প্রতিপন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এজন্য তারা বাঙ্গালি মুসলমানদের কাছে প্রচার শুরু করল যে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি ইসলাম-বিরোধী। সুতরাং, প্রকৃত মুসলমানদের কাজ হবে উর্দু ভাষা ব্যবহার করা এবং ইসলাম সংস্কৃতি অনুসরণ করা। এই প্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল ফজলুল হকের জনপ্রিয়তায় চিড় ধরানো। ফলে বাঙ্গলার নানা প্রান্তে ‘উর্দু অ্যাকাডেমি’ গড়ে তুলে।
বাংলাভাষা বিরোধী প্রচার শুরু হলো। ড. শ্যামাপ্রসাদ জিন্নাহ ও তাঁর লিগপন্থী সাগরেদদের এই হক-বিরোধী প্রচার মেনে নিতে পারলেন না। তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং বাঙ্গলা ও বাঙ্গালির উন্নতিতে আস্থাশীল নেতা ফজলুল হকের পাশে দাঁড়ালেন। তাদের দুজনের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠল ‘বেঙ্গলি প্রোটেকশন লিগ’ নামে এক সংস্থা। এটির প্রতিষ্ঠাকাল সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬ সাল। এভাবে তৎকালীন বাঙ্গলার দুই সুপরিচিত রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যক্তিত্ব পরস্পরের কাছাকাছি এলেন, বাঙ্গলার রাজনীতি এক নতুন মাত্রা পেল। তারা প্রচার করলেন, বাঙ্গালি মুসলমানেরা যেন উর্দুভাষীদের প্রচারে বিভ্রান্ত না হন। তাঁদের এই উদ্যোগ সফল হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিও রাজ্য সরকারের কল্যাণে একই। রকম। যাইহোক, মুসলিম লিগের ক্রমবর্ধমান চরম সাম্প্রদায়িক নীতি ও কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফজলুল হক ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে লিগের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। তিনি লিগের সঙ্গে আঁতাতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে, বেরিয়ে এলেন এইভাবে। এই সময়ে বাঙ্গলার রাজনীতিতে কংগ্রেসের একটি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী ছিল যেটির নেতা ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু। তিনি ফজলুল হককে লিগের কবল থেকে বের করার চেষ্টায় সফল হন। এ ব্যাপারে তার সঙ্গী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।
প্রসঙ্গত, মুসলিম লিগের সঙ্গে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা গঠনের পশ্চাৎপট একটু ব্যাখ্যা করে নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ যদিও এই ১৯৩৫ সালের এই আইনকে মেনে নেয়নি তবুও তারা নির্বাচন ঘোষিত হলে তাতে অংশগ্রহণ করে। এই প্রথম সাধারণ নাগরিকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভোট দিতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। সেই সময়ে বাঙ্গলার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি ছিল কংগ্রেস, ১৯২৭ সালে স্থাপিত ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল। এই কেপিপি পূর্ববঙ্গের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। সেই সময়ে মুসলিম লিগের তত সমর্থন ছিল না বাঙ্গলায়। তাদের প্রভাব মূলত বাঙ্গলার মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান জমিদার ও ব্যবসায়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নির্বাচনে লড়ার জন্য ঢাকার নবাবের উদ্যোগে গঠিত হয় ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি। জিন্নাহ কৃষক প্রজা পার্টি এবং এই দলের মধ্যে সমঝোতা করে এগুলিকে মুসলিম লিগের আওতায় এনে নির্বাচনে লড়ার চেষ্টা করেন। তিনি ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি এবং তাঁর নেতৃবৃন্দ ঢাকার
নবাব হাবিবুল্লাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন, শাহিদ সুরাওয়ার্দি, মৌলানা আক্ৰম খান, তামিজুদ্দিন খানদের মুসলিম লিগে শামিল করতে পারলেও ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে শামিল করতে ব্যর্থ হন। মূলত লিগের জমিদার মুখীনতা এবং বাংলাভাষা বিরোধিতাই এর কারণ। ফজলুল হক বাঙ্গালি কৃষকদের ‘ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচনে।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে কংগ্রেস সর্ববৃহৎ দল হিসেবে ৬০টি আসন পায় এবং মুসলিম লিগ ৪০টি আসনে জয়ী হয়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে কৃষক প্রজা পার্টি ৩৫টি আসন, নির্দল মুসলমানরা পায় ৪১টি আসন আর নির্দল বর্ণহিন্দুরা পায় ১৪টি আসন। এই নির্বাচনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হলো ফজলুল হক পটুয়াখালী নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে সেখানকার জমিদার খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। এছাড়া, আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে কবি নজরুল ইসলাম নির্দল হিসেবে লড়েন এবং তার জামানত জব্দ হয়।
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আলোচনা করবার জন্য সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ১৭ ও ১৮ মার্চ, ১৯৩৭-এ সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা যেসব রাজ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেই সরকার গঠন করবে, তাছাড়া অন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা কোথাও সরকার গড়বে না। কংগ্রেস হাইকমান্ডের তরফে এই সিদ্ধান্ত ছিল ‘হিমালয়সদৃশ ভুল’। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য বাঙ্গলার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে হাইকমান্ডকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তখন থেকেই কংগ্রেসে হাইকমান্ডরাজ শুরু হয়ে গেছে! এই সময়ের ঘটনাক্রম একটু ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বাঙ্গলার গভর্নর স্যার জন হারবার্ট সর্ববৃহৎ দলের নেতা হিসেবে কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসুকে মন্ত্রীসভা গঠনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য ডাকেন। কিন্তু তিনি হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক কংগ্রেসের বিধানসভার দলনেতা কিরণশঙ্কর রায়কে অনুরোধ করেন তার নেতৃত্বে জোর মন্ত্রীসভায় যোগদান করতে। শরৎচন্দ্র বসু, যিনি কংগ্রেসের একটা অলিখিত গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে বাঙ্গলার বিশেষ অবস্থার কথা বিবেচনা করে মন্ত্রীসভায় যোগদানের অনুমতি প্রার্থনা করে। চিঠি লিখলেন। বলা হয়ে থাকে, এই প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্র বসু রাজি ছিলেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! মৌলনা আজাদের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকী, বিধানচন্দ্র রায়ও কংগ্রেস-কেপিপি জোট মন্ত্রীসভার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে কয়েক বছরের জন্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে থাকেন। পরবর্তীকালে যখন সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি হন তখন তঁার ও মোহনদাস গান্ধীর মধ্যে যে চিঠি চালাচালি হয় তাতেও একথা প্রমাণিত। মূলত গান্ধী, আজাদ, ঘনশ্যামদাস বিড়লার আপত্তিতেই কংগ্রেস বাঙ্গলারমন্ত্রীসভায় যোগদানে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু কংগ্রেসের এই পদক্ষেপের ফলে বাঙ্গলার রাজনীতিতে মুসলিম লিগের প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসে যায় যা পরবর্তীকালে বাঙ্গলার তথা ভারতের রাজনীতি ও সমাজকে অন্ধকারের অতলে নিক্ষেপ করে। ফজলুল হক মুসলিম লিগের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হলেন কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের ফলে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. নীতীশ সেনগুপ্ত তার “History of the Bengali
Speaking People’-476046991, “In retrospect, there can be no doubt that the Congress’s mistake in turning down Fazlul Huq’s request in Bengal, together with its blunder in United Provinces, did pave the way for the partition of the subcontinent years later. The Muslim League took full advantage of its governmental authority in Bengal to extend its support bese over the Muslim masses.”
এই প্রসঙ্গে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সুভাষচন্দ্র বসু ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৮-এর এক চিঠিতে মোহনদাস গান্ধীকে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও লেখেন, “In the case of Bengal too, his (Moulana’s) views are against mine. According to Moulana Saheb, Muslim ministries should be accepted where Muslims are in a majority even though those ministries should be accepted where Muslims are in a majority even though those ministries are blatantly communal.” optagnify মৌলানা আজাদের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা এক্ষেত্রে পরিষ্কার।
যাইহোক, এসবের ফলে কেপিপি ও কংগ্রেসের জোট মন্ত্রীসভা হলো না। ফজলুল হক লিগের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন এবং কেপিপি, লিগ, তফশিলি ও বর্ণহিন্দু এমএলএ-দের নিয়ে গঠিত হলো এক জোট মন্ত্রীসভা। এই সময়েই নির্দল হিসেবে নির্বাচিত এমএলএ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিরোধী নেতা হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে মন্ত্রীসভায় মুসলিম লিগ নানাভাবে হক সাহেবকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। নানা টানাপোড়েনের পরে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর মুসলিম লিগ সদস্যরা মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে, ফলে হক-লিগ মন্ত্রীসভার পতন হয়। অবশ্য অভিজ্ঞ হক সাহেব মুসলিম লিগের মনোভাব আঁচ করতে পেরে আগেই তৈরি হয়েই ছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেস নেতা জে সি গুপ্তের কলকাতার বাসভবনে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর একটি গোপন বৈঠক করেন তিনি। মুসলিম লিগ বাদে বাকি সব রাজনৈতিক দলকে ডাকা হয় ওই বৈঠকে। উপস্থিত ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র নস্কর, হাসেম আলি খান, শামসুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ নেতা। ওই বৈঠকে স্থির হয় ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন’ মন্ত্রীসভা গঠন করা হবে। বৈঠকের প্রস্তাবমতো হিন্দু মহাসভা নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হক সাহেবকে সভার প্রস্তাব জানিয়ে তাঁকে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি প্রস্তাব স্বীকার করে ড. শ্যমাপ্রসাদকে অর্থ এবং শরৎচন্দ্র বসুকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক গ্রহণের অনুরোধ করেন। সেখানে উপস্থিত সকলেই এতে সায় দিলেন।৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। সেইমতো ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর ৯ জন ক্যাবিটেন মন্ত্রীকে নিয়ে মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করল। এই ৯ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৪ জন ছিলেন হিন্দু সদস্য। এর মধ্যে ২ জন ফরোয়ার্ড ব্লকের, একজন তফশিলি জাতিভুক্ত এবং চতুর্থজন স্বয়ং হিন্দু মহাসভার নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে। যে দুজন ফরোয়ার্ড ব্লক সদস্য মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণ করেন তারা ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য জানিয়েই শপথ গ্রহণ করেন, যদিও তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা তখন জার্মানিতে অবস্থান করছেন। জার্মানি তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। অন্যদিকে, নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু জাপানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে মন্ত্রীসভা গঠনের ঠিক আগেই গ্রেপ্তার হন। শ্রীবসুর ওই মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার কথা ছিল।
যাইহোক, শপথ গ্রহণ করার পরেই ফজলুল হক ঘোষণা করলেন, নতুন মন্ত্রীসভা হলো ‘হিন্দু-মুসলমান’ জোট মন্ত্রীসভা। নতুন এই জোট মন্ত্রীসভায়। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মন্ত্রীসভার বিরোধীরা বলতেন, ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদের তাঁবে থাকতেন। যদিও একথা সত্য নয়। তবে শ্যামাপ্রসাদ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন। তিনি ফজলুল হকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মন্ত্রীসভায় যোগদান করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, মুসলিম লিগের তত্ত্ব বা আদর্শ হিন্দু স্বার্থবিরোধী। ফলে লিগের বাড়বাড়ন্ত হিন্দু স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। তিনি যে কোনো শর্তে মুসলমানদের সমর্থন নেওয়ারও বিরোধী ছিলেন। এবং গান্ধী ও নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস সেটাই করছিল। সেই সময়ে বাঙ্গলার রাজনীতিতে তার অবস্থান সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার 76096301, “His position in Bengal politics at the time was akin to that of Chittaranjan and Subhas Chandra”.(History of Modern Bengal, part-2). ড. মজুমদার অন্যত্র বলেছেন, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মখোপাধ্যায় এবং অন্য কয়েকজন ছাড়া গান্ধী প্রভাবিত কংগ্রেসকে থামানোর চেষ্টা কেউ করেনি, আবার ফজলুল হক ছাড়া জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগকে কেউ বাধা দেয়নি।
‘প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন’ মন্ত্রীসভা যা ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা হিসেবে সাধারণ্যে পরিচিত ছিল তা শপথ গ্রহণ করে ১২ ডিসেম্বর, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। শপথ গ্রহণের দিনই শ্যামাপ্রসাদ ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া’-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে 21660191, “Bengal has shown today that inspite of internal differences, the important elements of our national life can combine for the good of the country.” বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা গঠনকে ‘হিন্দু-মুসলমান’ ঐক্যের পথে এক বিরাট পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। এই মন্ত্রীসভার কার্যকালে একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি যা বাঙ্গলার ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। এর পরে তার উভয়ে যৌথভাবে বাঙ্গলার কয়েকটি জেলায় ভ্রমণ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করেন। প্রধানমন্ত্রী (এখন মুখ্যমন্ত্রী) ফজলুল হক ঘোষণা করেন, শ্যামাপ্রসাদমুসলমানদের ভালোমন্দ দেখবে এবং আমি দেখব হিন্দুদের ভালোমন্দ। শ্যামাপ্রসাদ ঢাকার করোনেশন পার্কের এক সমাবেশে (২১ এপ্রিল, ১৯৪২) বলেন, “বাঙ্গলার মন্ত্রীসভা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, সমস্ত মানুষের জন্য। তিনি। হক সাহেবকে ধন্যবাদ জানান সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পুরোপুরি ঐক্যের জন্য আবেদন জানান এবং হিন্দুদের কাছে আবেদন জানান মসজিদ রক্ষা করতে এবং মুসলমানদের কাছে আবেদন জানান গুন্ডাদের আক্রমণ থেকে হিন্দুদের ও তাদের মন্দির রক্ষা করতে। ব্যক্তিগত স্তরে ও শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করেছেন। কবি নজরুল ইসলাম আর্থিক সঙ্কটে পড়লে তাঁকে অকাতরে সাহায্য করেছেন শ্যামাপ্রসাদ।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় ত্রাণ সমিতি গড়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে ত্রাণ সাহায্য করেছেন। মুসলমান প্রধান মুর্শিদাবাদ জেলাতেও তিনি মুক্তহস্তে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ফলে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে এই মন্ত্রীসভা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা পেয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যও এই মন্ত্রীসভা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু শুরু থেকেই মুসলিম লিগ ও বাঙ্গলার গভর্নর স্যার জন হারবার্ট এই সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে।
ইতিমধ্যে বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মেদিনীপুর জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার, নিপীড়ন শুর করা হয়। শ্যামাপ্রসাদ এর প্রতিবাদ করে জন হারবার্টকে এই অত্যাচার বন্ধ করতে আহ্বান জানান। কিন্তু তার এই আবেদনে সাড়া না দিয়ে অত্যাচার আরও বাড়ানো হলো। শ্যামাপ্রসাদ সরকারের এই দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেন। এই সময়ে ভারতের গভর্নর জেনারেল লিনলিথগো ও বাঙ্গলার গভর্নরজন হারবার্টকে লেখা চিঠিগুলো তার স্বদেশপ্রেম ও দূরদর্শিতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শ্যামাপ্রসাদ ১৬ ডিসেম্বর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর। শামা-হক’ মন্ত্রীসভা বাঙ্গলার রাজনীতিতে ‘হিন্দু-মুসলমান’ ঐক্যের প্রথম ও শেষ আন্তরিক প্রচেষ্টা। এ ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ ও ফজলুল হক—দুজনেই ছিলেন আন্তরিক।
দু-জনের দু-জন সম্পর্কে মতামত উল্লেখ করে এ প্রবন্ধের উপসংহার টানবো। শ্যামাপ্রসাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের উল্লেখ করে ফজলুল হক তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবুল মনসুর আহমেদকে বলেছিলেন, “শোন আবুল মনসুর, তুমি শ্যামাপ্রসাদকে চিনো না। আমি চিনি। সে স্যার আশুতোষের ব্যাটা। করুক সে হিন্দু মহাসভা। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে তার মতো উদার ও মুসলমানদের হিতকামী হিন্দু কংগ্রেসেও একজনও পাবা না। আমার কথা বিশ্বাস করো। আমারে যদি বিশ্বাস করো তারেও বিশ্বাস করতে হবে।” জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার শেষ চেষ্টার অন্যতম প্রধান রূপকার ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন কাশ্মীরের কারাগারে শ্যামাপ্রসাদের অকালমৃত্যুতে ফজলুল হক পূর্বপাকিস্তান থেকে তারবার্তা পাঠিয়ে তাতে বলেন, “The loss of the only brother I had in this world had driven me mad with sorrow.”
আর শ্যামাপ্রসাদ ফজলুল হক জন হারবার্টের চক্রান্তে পদত্যাগে বাধ্য হবার পরে বলেছিলেন, “Mr. Fazul Huq had been ousted because he roused there of Civil Street and Governor by his independence. The fact that they, Hindus and Muslims had gathered on the same platform in pursuance of a common cause augured well to the future of the province.”
বিনয়ভূষণ দাশ