‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’ কোনো ফুটবল ম্যাচের গ্যালারি থেকে যখন এই ধরনের কথা লেখা একটা বিরাট ব্যানার ঝোলে তখন সাময়িকভাবে একটা চমক তৈরি হয় বই কী। আর ব্যানারটি যখন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে সল্টলেক স্টেডিয়ামে গত ১৯ জানুয়ারির ডার্বি ম্যাচে, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের গ্যালারি থেকে ঝোলে, এবং সারা রাজ্য জুড়ে কিছু রাজনৈতিক শক্তির মদতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতার স্লোগানের অংশকে সুচতুরভাবে তাতে ব্যবহার করা হয়, তখন বিষয়টি আর শুধু ফুটবলে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক বার্তা, যেটি খেলার মঞ্চকে অপব্যবহার করে সারা রাজ্যের টিভি দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পরে একটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন অবশ্য এর দায়িত্ব স্বীকারও করেছেন। প্রশ্ন হলো, হঠাৎ ইস্টবেঙ্গলের গ্যালারি থেকে কেন, মোহনবাগানের গ্যালারি থেকে কেন নয়?
১৯১১ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে ফুটবল খেলে মোহনবাগানের শুরু আর ১৯২০ সালে শৈলেশ বসু পূর্ববঙ্গের ফুটবলারদের এক করবেন বলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম দিয়েছিলেন। দুটি ক্লাবই ফুটবল খেলতো, শরীরচর্চা করতো, বাঙ্গলার বাঁ দিক আর ডান দিক একে অপরের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধা করতো ঠিকই কিন্তু একজোট হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে লড়তো। ফুটবলে ঘটি-বাঙাল লড়াই নিজেদের আরও লড়াকু, আরও শক্তিশালী করার কাজে ব্যবহার করা হতো, দেশদ্রোহিতার জন্য নয়। তারপর গঙ্গা ও পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, ইংরেজ চলে গেছে কিন্তু যাবার আগে মুসলিম লিগ আর । কংগ্রেসের সঙ্গে দেশভাগের সমঝোতা করে বাঙ্গালিকে ভারতীয় আর পূর্ব পাকিস্তানি করে দিয়ে গেছে। যারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছিলেন তারা নিজেদের বাপ-ঠাকুরদার বহুত্ববাদী উদার সংস্কৃতি ছেড়ে সংকীর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক মরুসংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন। ফলত, প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার চিহ্নমাত্র তারা তাদের নতুন দেশে রাখতে চাননি, বিভিন্ন বাহানায় বারেবারে নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত শ্রেণীর হিন্দুদের তারা হয় হত্যা করেছিলেন, নয় জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন অথবা পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। পূর্ববঙ্গে ১৯৪৬-এর অক্টোবর- নভেম্বর জুড়ে নোয়াখালিতে যে হিন্দু নরসংহার শুরু হয়েছিল, তা ১৯৫০, ১৯৬৪ আর ১৯৭১-এ আরও ভয়াবহ রূপ নেয় এবং পৃথিবীর সবচেয়ে কম চর্চিত ধর্মীয় কারণে নরসংহার যদি কোথাও হয়ে থাকে, তো সেটা এই পূর্ববঙ্গে। পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল। দেশভাগের পর কমিউনিস্টরা এই বিতাড়িত, সর্বহারা, অসহায় মানুষগুলোর বন্ধু সেজে তাদের হাতে লালঝান্ডা ধরিয়ে সর্বনাশ করেছিল। আজ তাদের বংশধরেরা ইস্টবেঙ্গলের গ্যালারিতে ব্যানার ঝুলিয়ে ঠিক সেই একই কাজ করে চলেছে।
আমি কমিউনিজমকে একটি বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবেই দেখি। পৃথিবী জুড়ে যন্ত্রণাময় অমানবিক নিপীড়নতন্ত্র তৈরি করে এবং গণহত্যা চালিয়ে যারা বদনাম কামিয়েছেন, সেই সব অমানুষদের কমিউনিস্টরা আইকন বলে গণ্য করেন। আর এই ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক তত্ত্বের যারা অনুসারী, তারা মূলত অসহিষ্ণু, ধর্মদ্বেষী, মানবতাবিরোধী, স্বৈরাচারী, স্বার্থসর্বস্ব, সংকীর্ণমনা এবং দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী। কিছু বললেই এরা হিটলারের কথা তুলে জাতীয়তাবাদ কত বিধ্বংসী, তা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। আসলে এদের গোটা অস্তিত্বই মিথ্যাচারের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই একজন অস্ট্রিয়ানকে এরা অনায়াসে জার্মান জাতীয়তাবাদী বলে দেগে দেন। বস্তুতপক্ষে হিটলার জার্মান ছিলেন না, জাতীয়তাবাদীও ছিলেন না, নিখাদ বর্ণবাদী ছিলেন। তিনি এক কল্পিত আর্যজাতির racial supremacyতে বিশ্বাস করতেন, সেটি দেশাত্মবোধ নয়। ভারতবর্ষের মতন হিন্দুপ্রধান বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশে আজ স্বৈরতন্ত্রী কমিউনিজমের সত্যিই কোনো স্থান নেই। এদেশের কমিউনিস্টরা এটা বোঝেন বলেই যেন তেন প্রকারেণ নিজেদের সস্তা পাব্লিসিটি করতে চেষ্টা করেন। ফুটবল মাঠে ব্যানার টাঙিয়ে খেলার স্পিরিটকে মাটি করতেও এরা পিছপা নন।
বামেদের দোসর কংগ্রেস ও কংগ্রেসি ঘরানা রাজনীতিবিদদের এবং বামপন্থীদের এত রাগ কেন জানেন? তাদের সমস্ত নীতি বৈষম্যমূলক। সমাজকে ধর্মের নামে, জাতির নামে, লিঙ্গের নামে তারা এতদিন বিভাজিত করে ভোটে জিতে এসেছে।‘ভাগ করো আর রাজ করো’, এই নীতিই এত বছর চলে আসছিল। মোদীজী এসে এই নােংরামিটা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন উজালা যোজনায় যারা গ্যাস পান তাদের কেউ জিজ্ঞেস করেন না। তারা সংখ্যালঘু বাতফশিলি জাতি কিনা, গরিব হলেই গ্যাস পাবে। আয়ুষ্মন ভারতেও একই ব্যাপার, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে টয়লেট বানানো থেকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহহীনদের বাড়ি বানিয়ে দেওয়া, সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পই এখন বৈষম্যহীন, যাকে ইংরেজিতে বলে non discriminatory। আর একটা কাজ তিনি করেছেন। কোনো ভারতবাসীকে যাতে আর কেউ ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, তার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করেছেন। যে যে সমস্যা এতগুলো বছর ধরে জোর করে জিইয়ে রাখা হয়েছিল, তিনি তার প্রত্যেকটি এক এক করে সমাধান করে দিচ্ছেন। তিন তালাক থেকে ৩৭০ ধারা, রামমন্দির থেকে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব, যে যে ললিপপ দেখিয়ে এতদিন মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোট হাতানো যেত, সব এক এক করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যাদের সর্বনাশ হচ্ছে তাদের ভয়ংকর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই আছড়ে পড়েছে ট্রেনের ওপর, স্টেশনের ওপর, দমকলের ওপর, বাসের ওপর, দোকানপাটের ওপর আর পুলিশের মাথার ওপর। যাদের দিয়ে এই গুন্ডামি করানো হচ্ছে তারা নির্বোধ। তারা এখনো এই বিভাজনকামী নষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর আস্থাশীল। এটাকেই বোধহয় Stockholm syndrome বলে।
সুখের কথা হলো, দেশের অধিকাংশ মানুষ মোদীজীর সঙ্গে আছেন।তাঁর সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ জনসমর্থন পাচ্ছে। যতবার সংবাদমাধ্যম সার্ভে করছে, ততবার এটাই বারেবারে উঠে আসছে।
ইদানীং কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী একটি ‘কাগজ দেখাবো না’ পালায় চুটিয়ে অভিনয় করছেন, অবশ্যই ওই ব্যানারের শেষ অংশটি তার দ্বারাই অনুপ্রাণিত। যারা বলছেন কাগজ দেখাবেন না, না দেখানোটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বটে। কিন্তু গোটাকয়েক প্রশ্ন থেকে যায়। স্কুলে ভর্তি করতে গেলে বার্থ সার্টিফিকেট দেখান কেন? ট্রাফিক পুলিশ ধরলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখান কেন ? চাকরির সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেখান কেন? ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে। আইডেন্টিটি আর রেসিডেন্স প্রুফ দেখান কেন? ভোট দিতে গেলে ভোটার পরিচয়পত্র। দেখান কেন? বিদেশ যেতে গেলে ভিসা লাগানো পাসপোর্ট দেখান কেন? শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট দেখান কেন? কারণ এসব দেখানো নিয়ম।
যারা ‘কাগজ দেখাবো না’ নামক ভিডিয়োটির স্পনসর, তারা আসলে হিন্দুদের সর্বনাশ করতে চায়। এরা নিজেরা চিরকাল মুখে সর্বহারার কথা বলে বেড়ায় অথচ নিজেদের ছেলে-মেয়েদের নামি দামি স্কুলে পড়ায়, উচ্চমানের জীবনযাত্রা ভোগকরে আর মানুষকে খেপিয়ে দিয়ে সপরিবারে বিদেশে ছুটি কাটাতে চলে যায়। এদের বিশ্বাস করে ক্ষমতায় এনে আজ পশ্চিমবঙ্গের কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর চাকরি নেই। এদের বিশ্বাস করে পশ্চিমবঙ্গের চাষজমি খণ্ডিত হতে হতে এত ছোটো ছোটো হয়ে গেছে যে তার থেকে আর কৃষকের পেটভরার মতন আয় হয় না। এরা চিরকাল গরিবের সর্বনাশ করে নিজেরা নির্লজ্জের মতন বড়োলোকি করেছে, এখনো তাই করছে। এদের কথা শুনে আবার নতুন। করে ঠকবেন না। যখন কাগজ দেখবার সময় আসবে, গর্বের সঙ্গে দেখাবেন। আপনি-আমি ভারতের নাগরিক, এটা তো গর্বের কথা। তার প্রমাণ চাইলে দেব না? কেন দেব না? একশোবার দেব, হাজারবার দেব। বিদেশিরা দিতে পারবে না, সেটা তাদের সমস্যা, আমার নয়। এই প্রচুর টাকার পাহাড়ের উপর বসে থাকা অত্যন্ত ক্ষমতাবান বাবু-বিবিরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিদেশিদের বাঁচাতে আমাদের গরিব অক্ষম আত্মজনের সর্বনাশ করতে চাইছেন। সুখের কথা এই যে, দেশের মানুষ ওদের খেলা ধরে ফেলতে শুর করেছেন।
আজ এই গোটা নাগরিকপঞ্জী বিরোধী ইকোসিস্টেম বা ব্যবস্থাতন্ত্রটিকে আয়না দেখানোর সময় এসেছে। বাংলাদেশের মাটির জন্য, বাংলাভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে ওখানকার অসংখ্য হিন্দু বাঙ্গালি আর ভারতের সৈন্যবাহিনী, যার এক কণা দামও বাংলাদেশের মুসলমানরা দেননি। নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত সেই উদ্বাস্তুদের এত বছর কোনো সরকার নাগরিকত্ব দেয়নি, এইবার নরেন্দ্র মোদী সরকার দিয়েছে। কেন বাংলাদেশি মুসলমানদেরও সেই সঙ্গে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না সেই প্রশ্ন তুলে এতদিন সংখ্যালঘুর ভোটব্যাঙ্ক ভাঙিয়ে তোষণের রাজনীতি করা দলগুলি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে রাস্তায় নেমেছে।ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থকদের উচিত এদের মাত্র দুটো প্রশ্ন করা :
১. পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তো পয়সার জোরে অথবা প্রভাব খাটিয়ে এতদিনে নিজেদের নাগরিকত্ব জোগাড় করে নিয়েছেন, পড়ে আছেন গরিব নিম্নবিত্ত অবহেলিত হিন্দুরা। তাদের নাগরিকত্বের বিরোধিতা করতে লজ্জা করে না?
২. যে ২৩ শতাংশ মুসলমান নিজেদের জন্য দেশের ২৮ শতাংশ জমি ভাগ করে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা তো দেশভাগের আগে অখণ্ড ভারতেরই নাগরিক ছিলেন। এখন যদি তারা আবার ভারতের নাগরিক হতে চান, তাহলে দেশের বিভাজন ঘুচিয়ে দিয়ে আবার ভারতে বিলীন হয়ে গেলেই তো হয়। সেটা কেন চাওয়া হচ্ছে না?
সঞ্জয় সোম
2020-02-05