মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর দু’টি কাজ আপাতত হয়েছে। প্রথমত, ইভিএমের প্রতি বিরোধীদের আস্থা ফিরে এসেছে। অন্তত বিজেপির জেতা শখানেক আসন বাদ দিলে বাকিগুলির ইভিএম নিয়ে বিরোধীদের আপত্তি থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় আরও একটা কাজ হয়েছে রামমন্দির রায়ের পর ভারতীয় সংবিধান, গণতন্ত্র, সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থার প্রতি যে অনাস্থার জন্ম হয়েছিল, মহারাষ্ট্র বিধানসভা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বিচারের প্রতি আস্থা কিঞ্চিৎ ফিরেছে নিশ্চয়ই। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে সিপিএমের অসামান্য রাজনৈতিক সাফল্য, একটি আসনে তাদের জয়, বিজেপি বিরোধী সরকার গঠনে তার সহযোগ—এই ‘ফিল গুড’ ফ্যাক্টরে আশা করা যায় সুপ্রিম কোর্টে রামমন্দির রায় পাক জনগণ ও সিপিএমের মনে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, তার কিছুটা নিরাময় এবার হবে।
তবে কিনা এই আস্থা বিষয়টি যে কোনও মুহূর্তে বদলে যেতে পারে। নির্বাচনী ময়দানে বর্তমানে বিরোধী পক্ষকে খুব বেশি স্পোর্টিং স্পিরিট’ নিয়ে খেলতে দেখা যায় না। বিজেপিকে ঠেকানোর মহান কর্তব্যে তারা ভোটের আগে জোট বাঁধেন, হিস্লার গণ্ডগোল হলে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’লড়াই করেন, ভোটে গোহারা হলে ল্যাটা চুকে যায়, যত দোষ নন্দ ঘোষ হয়ে যায় ইভিএম-এ যদি একটু ভালো ফল হয় বিশেষত ভারতীয় গণতন্ত্রে আসন সংখ্যার সুবিধা তারা পায় অর্থাৎ বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে শুরু হয় নতুন খেলা। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরের রাখার মহান কর্তব্যে আবার সবাই ঘোঁটে যোগ দেবেন। পারলে ভালো, না পারলে বিজেপি গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করছে গোছের বুলি তো রয়েছেই।
সারা দেশের মানুষ যে বিরোধীদের এই চালাকি ধরতে পারেননি তা নয়, এবারের লোকসভা নির্বাচনেই তার প্রমাণ হিসেবে করলে দেখা যাবে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পরবর্তী কিছু রাজ্যের নির্বাচনে ও উপনির্বাচনে সেরকম ভালো ফল হয়নি। এর একটাই কারণ বিজেপির সাংগঠনিক ত্রুটি যা বিরোধীদের সম্মিলিত অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টা ছিল মহারাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে। ত্রিশ বছর শিবসেনা বিজেপির জোটসঙ্গী। যখন বিজেপির পাশে কেউ ছিল , আর এসএস সংশ্রবকে ভারতীয় রাজনীতিতে অচ্ছুত করে রাখার কৌশলী কংগ্রেসি-কমিউনিস্ট প্রচেষ্টা কার্যকর ছিল তখন বালা সাহেব ঠাকরে বিজেপির হাত ধরেছিলেন নিঃসংকোচে।
কারণ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য। দেশপ্রাণ নিবেদন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মারাঠি অস্মিতা শিবসেনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলেও বিজেপির প্রভাবে তা হিন্দু-অস্মিতা তথা দেশ-অস্মিতায় পরিণতি পায়। শিবসেনার ‘আমুচি মুম্বাই’ স্লোগানকে প্রাদেশিকতা-দোষ মুক্ত করে তাকে জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করতেও বিজেপির সদর্থক ভূমিকা ছিল। শিবসেনার ‘বিহারি খেদাও’মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারেনি বিজেপির সর্বভারতীয় ভূমিকার জন্যই। শিবসেনার প্রাণপুরুষ বালাসাহেব ঠাকরে এসব জানতেন। মারাঠিদের রাজনৈতিক, অধিকার রক্ষায় তার সংগ্রাম মহারাষ্ট্রের মানুষ চিরদিন স্মরণে রাখবেন। বিজেপির সঙ্গে বালাসাহেবের চিরকাল শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল।
শুধু মহারাষ্ট্রেই নয়, ভারতীয় শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসাবে শিবাজী চিরদিনই শিরোধার্য। মোগলদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম, ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শিবাজীর অনবদ্য লড়াই কেবল। মারাঠাদের মধ্যেই নয় সারাদেশেই হিন্দুদের মধ্যে শিবাজীকে বীররসের পূজারি করে তোলে। বাম-কংগ্রেসের চক্ষুশূল শিবাজী সবসময়ই, কারণ হিন্দু অস্মিতার এই প্রতীক একইসঙ্গে ভারতে বহিরাগত শাসকের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ বটে। আর্য অনার্য তত্ত্বের আবিষ্কারক বামেরা কখনই যা মানতে পারে । অর্থাৎ বিজেপি-শিবসেনা জোট ভারতের রাজনৈতিক মঙ্গলের নিমিত্ত তৈরি এবং এই আদর্শগত মেলবন্ধন রামমন্দির ইস্যুতে মহারাষ্ট্র ও দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। নেহরুবাদী কংগ্রেস-কমিউনিস্টরা তাদের পাকি-বন্ধুদের কথা ভেবে এই জোটের কট্টর বিরোধী চিরকাল।
এই ঐতিহাসিক কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য।সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ বালাসাহেবঠাকরে কোনওদিন মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য লালায়িত ছিলেন না। ভারতবর্ষের মানুষ, হিন্দুদের স্বার্থরক্ষা তাঁর একমাত্র কর্তব্য ছিল। ২০১৯-এ মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি- শিবসেনা বনাম কংগ্রেসের আর তার সঙ্গী প্রধানমন্ত্রী পদে লালায়িত শরদ পাওয়ার, যিনি সোনিয়া গান্ধীকে বিদেশিনী আখ্যা দিয়ে যে দল তৈরি করেছিলেন সেই ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) মধ্যে লড়াই ছিল। যেখানে বিজেপি-শিবসেনা জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ । যিনি গতবারও বিজেপির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেবার অর্থাৎ ২০১৪। সালে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আচমকাই বিজেপির হাত ছেড়ে দিয়েছিল শিবসেনা। তাতে বিজেপির তো বটেই, শিবসেনারও কোনও ক্ষতি হয়নি। আলাদা লড়েও বিজেপি ১২২টি, শিবসেনা ৬৩টি। আসন পায়। বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়েছিল ৭৬টি, শিবসেনার ১৮টি। জনমতের এই রায় যে তাদের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের পক্ষে, নবগঠিত মোদী-মন্ত্রিসভার হাত শক্ত করার পক্ষে তা বুঝে আবার দু’দলের দেশপ্রেমী সরকার হয়।
আসলে ২০১২ সালে বালাসাহেবের মৃত্যুর পর শিবসেনার অবক্ষয় শুরু। তার আগেই অবশ্য পারিবারিক ভাঙন ধরেছিল। পুত্রস্নেহে অন্ধ ছিলেন এই পূজনীয় দেশনেতা। ভাইপো রাজ ঠাকরে পুত্র উদ্ধবের সঙ্গে বিবাদে দল ছেড়ে নতুন দল গড়েছিলেন ‘নব নির্মাণ সেনা’। শিবসেনা আর নবনির্মাণ সেনা দুই দলই তাদের আদর্শ করেছে বালাসাহেবকেই। তবুও মহারাষ্ট্রের মানুষ বালাসাহেবের শিবসেনাকেই বেছে নিয়েছে এতদিন, শুধুমাত্র বালাসাহেবের প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধায়। কিন্তু উদ্ধব প্রমাণ করে দিলেন বালাসাহেবের উত্তরসূরি হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। জীবনে কোনওদিন ভোটে দাঁড়িয়েও তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদের লোভে লালায়িত এবং তা দখল করতে কংগ্রেস-কমিউনিস্টদের মতো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কট্টরবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাতেও তার দ্বিধা নেই।
একটা কথা স্পষ্ট করে বোঝা দরকার। শিবসেনা যে কারণে বিজেপির সঙ্গে জোট ভাঙল, তার প্রধান কারণ আড়াই বছর তাদের মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার অর্ধেক অংশ করে ভাগাভাগি যে সরকারি স্থায়িত্বের পক্ষে অন্তরায় তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। বিজেপির মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আসন সংখ্যা শিবসেনার প্রায় দ্বিগুণ। কেবলমাত্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপির নেই বলে শিবসেনা তার সুযোগ নেবে, এটা বিজেপি মানবে কেন? শিবসেনা উদ্ধবের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তার যোগ্য জবাব মহারাষ্ট্রের মানুষই দেবেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন রাজ্যের উত্থান এখন সময়ের অপেক্ষা।
তবে ভারতীয় রাজনীতির এই পট পরিবর্তনে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় ছাগলের তৃতীয় ও চতুর্থ সন্তান কমিউনিস্ট ও তৃণমূলিদের আচার-আচরণ ভারী চমকপ্রদ। বর্তমানে সুযোগ বুঝে তৃণমূলে আশ্রিত চরম কমিউনিস্ট (মাওবাদী বা নকশাল) দ্বারা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক বিকৃত’ সংবাদমাধ্যমের নিধিরাম সর্দার মার্কা সম্পাদক বিধানসভা ভোটের নিরিখে সারা ভারতে বিজেপির ক্ষমতায় থাকা ৭০ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ নেমে এসেছে বলে উল্লাস প্রকাশ করেছে, মহারাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে। মুখেরা এটা ভুলে যাচ্ছে মোদী-শাহকে রুখতে এহেন অনৈতিক জোট-ঘোঁট বিস্তর হচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে। যারা নৈতিকতার বুলি আওড়ে দেশের মানুষকে ষাট-সত্তর বছর ধরে টুপি পরিয়েছেন, আজ তাদের মুখোশটা খুলে গেছে। ২০১৯-এ লোকসভার নির্বাচন দেখেও এদের শিক্ষা হয়নি, মানুষের ওপর আস্থা না থাকলে সম্পাদকমশাই দেখতে পাবেন সারা ভারতেই কেমন যেন গেরুয়া গেরুয়া দেখতে লাগছে। বিস্তর লাল ঝড় উঠবে, কৃষকের ফাটা পা ফেসবুক জুড়ে ছড়াবে। মেকি দরদের রাজনীতি হবে, তার পরও দেশটা হিন্দু সনাতন ভারতবর্ষই থাকবে, চীনের চেয়ারম্যানের আর এদেশের চেয়ারম্যান হওয়া হবে না।
অভিমন্যু গুহ
2019-12-05