সারা দেশ এখন করোনা জ্বরে কাবু। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বা বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যু ছিনিয়ে নিচ্ছে। একের পর এক প্রাণ। দিশেহারা মানুষ পথ খুঁজছে বাঁচার। একদল সৈনিক এই মারণ মহামারীর সঙ্গে দিনরাত লড়াই করে চলেছে। দেশের সরকার আমাদের সামাজিক দিক থেকে সাহায্য চেয়ে লকডাউন ঘোষণা করেছে। কারণ একটাই, যাতে এই মারণ ভাইরাস গোষ্ঠী সংক্রমণ না ঘটাতে পারে। পরোক্ষে উদ্দেশ্য, এই ভাইরাসের সংক্রমণ শৃঙ্খলটাকে ভেঙে দেওয়া। প্রথমে সবার। কাছে আকুতি করে সচেতন হতে বলেছেন। করোনার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সৈনিকরা। এরপর যখন দেখা গেল এই কথা একটি শ্রেণী শুনলেও একটি বিশেষ শ্রেণীর কানেও ঢুকল না সে কথা। তারা তাদের। মতো করে চলতে শুরু করে দিল। মনে জেদ, মানব না। আবারো তাদেরকে আবেদন করে সচেতন হতে বলল পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু তাদের বেপরোয়া মনোভাব সেই কথায় কান। দিল না। যেসব সৈনিক এই করোনা যুদ্ধে। লড়াই করছেন আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্য তাদের ওপর চড়াও হয়ে মারধোর শুরু করেছে তারা। কয়েকদিন আগে হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডের ঘটনার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। সরাসরি যাদের দিকে চিরকাল আঙুল উঠে এসেছে, সেই মুসলমান সম্প্রদায় যে এর পিছনে, তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু পুলিশকে মারা নয়, স্বাস্থ্য কর্মীদের হেনস্থা হতে হচ্ছে সংখ্যালঘু এলাকায় গেলে। একটু ফিরে গেলে, সেই ১৯৮৪ সালে গার্ডেনরিচে, ডিসি(পোর্ট) বিনোদ মেহতা ও তাঁর দেহরক্ষীর হত্যার প্রসঙ্গ মনে আসে। পশ্চিমবঙ্গে কেন এমন সংখ্যালঘুদের আইন না মানার প্রবণতা? কেনই বা আইনকে তোয়াক্কা না করার মানসিকতা এদের মজ্জায় মজ্জায় বসে গেছে? কেনই-বা অপরাধের পিছনে এদের নাম উঠে আসছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটাই উত্তর আসবে, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। আর এই রাজনীতি করতে গিয়ে মুসলমান তোষণের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ছাড় দিয়ে দিয়েছে স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারিরা।
কেন এই ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে মুসলমান তোষণ। একটু প্রকৃত ছবিটা দেখার চেষ্টা করা যাক। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৯ শতাংশের মতো মুসলমান, আর এই কারণেই রাজ্যের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে এদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েই গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে টানাটানিও অব্যাহত। ভোটের রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে মুসলমানদের সমর্থন পেলে পশ্চিমবঙ্গের ভোটযুদ্ধে জেতাটা মসৃণ হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বামফ্রন্টের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের একটা বড়ো অংশের সমর্থন বামেদের পক্ষে ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকেমুসলমানরা বামফ্রন্টের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। তাদের সমর্থন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে পড়ে, এর ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ভোটব্যাঙ্ক বাড়তে শুরু করে। আর তোষণের মাত্রাটাও লাগামছাড়া আকার নেয়। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, মুসলমান সমাজ কখনই একভাবে কোনো নির্দিষ্ট দিকে ভোট দেয়নি। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বেশি সংখ্যায় বামপন্থীদের ভোট দিলেও মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গের দুই মুসলমানপ্রধান জেলা মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে কংগ্রেসের পাশে থেকেছে। এমনকী তণমূল কংগ্রেসের আমলে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বামপন্থীদের কাছ থেকে সরে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে সমর্থন করলেও ওই তিন জেলায় কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য থেকে সরে আসেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলেছেন, উর্দুভাষী মুসলমান ও বাংলাভাষী মুসলমানদের বেশ ভাগ আছে। এরা দুটি পৃথক সমাজ। লক্ষ্য করে দেখা গেছে। বাংলাভাষী মুসলমানদের সিংহভাগই গ্রামবাসী, কৃষিজীবী নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। অবাঙ্গালি মুসলমানদের অধিকাংশই শহরবাসী, শিল্পাঞ্চলে কাজ করে। এই দুই সমাজের মানুষেরা ভোটও দেয় নিজের মতো করে। ফলে এদের মন জেতার চেষ্টা করার জন্য নানা পথনিতেই হবে। সেভাবেই বর্তমান রাজ্যের শাসকদল এগিয়েছে।
মুসলমান তোষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণ, ইমামদের ভাতা দেওয়া। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিলেই গোটা মুসলমান সমাজের ভোট এসে যাবে, এই ছকের রাজনীতি এসে যায়। মমতা ব্যনার্জির মুসলমান ঘনিষ্ঠতা আজ সবাই জানে।তিনি ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি বা কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতির মতো কিছু ধর্মগুরুর সঙ্গে সঙ্গে এক মঞ্চ ব্যবহার করা বা ইদের আগে তিনি নিজেও রোজা রাখার কথা বলা, ইফতার পার্টিতে গেলে কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকা, এর পিছনেও সেই ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয়দের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়ানোর জন্য যা করতে হয়। সব করছেন। এসব কারণে যখন সংখ্যালঘুরা দেখছে যে হাজার অপরাধ করলেও, তাদের গায়ে হাত তোলার সাহস রাজ্য সরকারের নেই। তাই বেপরোয়া হয়ে তারা পুলিশ পেটাতেও ছাড়ছে না। আর রাজ্যের সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলি রাজ্যের তথাকথিত আইনের বাইরে। এই প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম বেশ কিছু পুলিশ কর্মীর সঙ্গে। তারাও মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না এই হেনস্থা। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তারাও বেশ বীতশ্রদ্ধ তাদেরই সমাজের মানুষদের এই রকম আচরণে। ফলে তাদের মধ্যে একটা অসন্তোষের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে শুরু করেছে। যেটা রাজ্যের প্রশাসনের কাছে ভবিষ্যতে খুব একটা সুখের হবে না। এমনটাই বলছে, রাজনৈতিক মহলের একাংশ। একদিকে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা, যারা হাসপাতালে জীবনপণ করে আমাদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনছেন, আর একদল চেষ্টা করে চলেছেন আমাদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে, যাতে মারণ ভাইরাস আমাদের ছুঁতে না পারে। এইসব জীবনপণ করা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকা। সৈনিকদের যদি এভাবে মার খেতে হয়, হেনস্থা হতে হয়, তাহলে এই ত্যাগের মূল্যটা তারা কি পেলেন? কোথায় তারা কুর্নিশ পাবেন, তা নয় একটি শ্রেণীর হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এটা কোনো ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
বিশ্বপ্রিয় দাস