নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে তা আইনে পরিণত হয়। যাকে আমরা বলছি সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এই আইন তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ কেন্দ্রীয় সূচি বা লিস্টের অন্তর্গত এই নাগরিকত্ব। রাজ্যের কোনো অধিকার বা ভূমিকা নেই। অথচ কিছু রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব— এরা এর বিরোধিতায় নেমেছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে সংখ্যালঘু ও অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে। শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কের জন্য। এই আইনে নাগরিকত্ব দেবার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয় বা সামাজিক কারণে নিগৃহীত সেই সব সংখ্যালঘু মানুষদের যারা পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে দীর্ঘ দশক ধরে। শরণার্থী বা উদ্বাস্তু হয়ে আছে।
যেহেতু মুসলমানরা এইসব দেশে সংখ্যাগুরু, তাই রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা শরণার্থী নয় এবং সিএএ তাদের জন্য নয়। এতে সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদকে অমান্য করা হয়নি। কারণ এরা এখনো ভারতের নাগরিক নয়। ভারতের সংবিধান শুধু ভারতের নাগরিকদের অধিকারের কথা বলেছে ধর্মমত নির্বিশেষে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে এর বিরুদ্ধে ৫৯টি পিটিশন দাখিল হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তুলে। যার মধ্যে মূলত আছে কংগ্রেস, ডিএমকে, মুসলিম লিগ,তৃণমূল ইত্যাদি দল। যারা চাইছে সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ বা স্টে-অর্ডার দিক। ইন্দিরা জয়সিংহ ও কপিল সিব্বাল এই স্থগিতাদেশ নিয়ে দীর্ঘ সওয়াল করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কোনো রকম স্থগিতাদেশ না দিয়ে তার থেকে বিরত থাকা এবং পরবর্তী শুনানির দিন ২২ জানুয়ারি ২০২০-তে ধার্য করেন। বিরোধী পক্ষের আইনজীবীগণ চাপ দিতে থাকেন এই স্থগিতাদেশ দেবার পক্ষে। কারণ একবার এই স্থগিতাদেশ যদি কোর্ট দিয়ে দেয় তবে তা কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনের শক্তিকে দুর্বল করে দেবে। অর্থাৎ এই আইন, কোর্ট মনে করছে ত্রুটিপূর্ণ। সুতরাং শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত একে কার্যকরী করা যাবে না।
কিন্তু বিরোধী আইনজীবীদের হতাশ করে সুপ্রিম কোর্ট এই স্থগিতাদেশ দেননি। অর্থাৎ এই আইনের ব্যাখ্যা না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট কিছু জানাবে না। এটা কেন্দ্রের। পক্ষে প্রথম জয় বলে বিশিষ্টজন মনে করছেন।
ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। নেহরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী। ভারত ও পাকিস্তান অঙ্গীকারবদ্ধ হয়— দু’দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবার ব্যাপারে। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান, বাংলাদেশে ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন) ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরও অধিকার আছে বাঁচার এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার।
ভারত যদি তাদের নাগরিকত্ব দেয়, অন্য ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত না করে বা কারোর নাগরিকত্ব হরণ না করে তাহলে এর বিরোধিতা কেন? আসলে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ রয়েছে এইসব বিরোধী দলের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে। তাই তারা আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক বিরোধিতায় নেমেছে।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বিরোধীদের কথায় কর্ণপাত না করে কোনো স্থগিতাদেশ না দেওয়ায় আজ তারা কিছুটা হতাশ। একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই শেষ আশা-ভরসা এই বিরোধীদের। কারণ এই আইন নাকচ করার অধিকার এখন আর কারোর নেই।
সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত তথ্য পেশ করবে এবং আশা করা যায় বিভিন্ন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ওপর ভরসা করে করবে। যাতে এই আইন আগামীদিনে বলবৎ হতে কোনো অসুবিধা না হয়।
ভাস্কর ভট্টাচার্য্য
(লেখক একজন বিশিষ্ট আইনজীবী)
2019-12-27