এই সাধারণতন্ত্র দিবসে আমরা প্রশ্ন রাখতে পারি ভারতের ইতিহাসে কোন সময়টি ছিল সেরা উৎকর্ষের। এই সূত্রে ভারততত্ত্ববিদ Alexander Dalrymple একটি বিরল দৃষ্ট কিন্তু অত্যন্ত সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ “The Anarchy’উদ্বোধনের সময় তিনি বলেছেন চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীই ছিল ভারতের স্বর্ণযুগ।
এই কালপর্বে ভারতের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ শান্তি, সুস্থিতির বাণী নিয়ে আফগানিস্তান থেকে চীন হয়ে জাপান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকে প্রভাবিত করেছিল। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু মন্দির ও স্মারকস্তম্ভ সেই সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলশ্রুতিতেই তখন নির্মিত হয়েছিল। আফগানিস্তানে বিশ্বখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধের বিশালাকার মূর্তিগুলি, ইন্দোনেশিয়ায় প্রমবানন ও বরবদুরের মন্দির, কাম্বোডিয়ায় ওঙ্কারভাট কিংবা চীনের ডান হুয়াং শহরে বৌদ্ধ গুহাগুলি তারই কয়েকটি নিদর্শন।
এই প্রসঙ্গে ওড়িশার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বহু নাবিক এখান থেকেই ইন্দোনেশিয়া যাত্রা করত। তারা সঙ্গে করে নিয়ে যেত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুষঙ্গগুলি। চতুর্থ শতাব্দীর আগমন লগ্নেই জাভা ও বালিতে হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। শুনলে অবাক হবেন, ইন্দোনেশিয়ায় ওড়িয়া প্রভাবের প্রমাণ স্বরূপ ১৯টি জগন্নাথ মন্দির আজও বিদ্যমান।
অত্যন্ত শক্তিশালী হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়। উল্লেখ্য, ধর্ম দুটি প্রসার লাভ করেছিল শান্তির দূত বণিক ও পুরোহিতদের যুগ্ম অংশগ্রহণে। অবশ্যই পরবর্তীকালে অনেক হিন্দু রাজবংশ সামরিকভাবেও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। রামায়ণ-কাহিনিভিত্তিক নাচ হতে পেরেছে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় নৃত্য, এমনকী পরবর্তী সময়ে দেশটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার পরও এই প্রথার কোনো পরিবর্তন হয়নি। জাকার্তার জাতীয় সংগ্রহশালা হিন্দু শিল্প নিদর্শনে ঠাসা; তুলনায় মুসলমান নিদর্শন হাতে গোনা।
থাইল্যান্ডের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও প্রাচীন শহরের নাম অয়ুথ্যা। বুঝতে অসুবিধে হয় না এটি অযোধ্যারই অপভ্রংশ মাত্র। অয়ুথ্যা সাম্রাজ্যের শাসনকালে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মকে একই ধর্ম বলে মনে করা হতো। শুধু তাই নয়, থাই রাজারা ভগবান বোধিসত্ত্বকে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার বলে গণ্য করতেন। থাইল্যান্ডের জাতীয় মহাকাব্য রামাকিয়েন আদতে রামায়ণ অনুসরণেই লিখিত বা পুরোপুরি গৃহীত। এখানকার বহু মন্দিরেই রামায়ণের ঘটনাবলী চিত্রিত আছে। এমনকী ব্যাঙ্ককের রাজপ্রাসাদেও রয়েছে রামায়ণের ছবির ছড়াছড়ি। অন্যদিকে, বৌদ্ধধর্মকে চীনে নিয়ে যান একজন দক্ষিণ ভারতীয়, যাঁর নাম বোধিধর্ম। তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য কাহিনিটি হলো তিনি ছিলেন দাক্ষিণাত্যের তামিল পল্লবী রাজবংশের রাজা সিংহবর্মার সন্তান। তিনি মল্লযুদ্ধ ও মার্শাল আর্ট প্রদর্শনে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন ও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার মন গ্রামীণ রাজবংশ পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ইচ্ছায় চীন যাত্রা করেছিলেন। কথিত আছে তিনি। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কঠিন কুংফুকে চীনের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত শাওলিন মন্দিরে প্রচলন করিয়েছিলেন। আরও এক ভারতীয় গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার করেছিলেন।
বণিক ও পুরোহিতেরা এই ভাবে প্রাচীন সিল্করুট ধরে ভারত থেকে চীনে, আরও এগিয়ে জাপানে বৌদ্ধধর্ম সম্প্রসারিত করেন। আমরা জানি, ভারতে অজন্তার বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন গুহাচিত্রগুলির কথা। বহু পর্যটকের দর্শনীয় সেগুলি। কিন্তু উল্লেখিত ডান হুয়াং প্রদেশে গোবি মরুভূমি মধ্যে অবস্থিত নিপুণভাবে অঙ্কিত‘মোগাও গুহায়’ বুদ্ধ মূর্তির সংখ্যা ও আকারের কাছে অজন্তা ও ইলোরা নগণ্য ও ক্ষুদ্রকায়। এই গোবি মরুভূমি প্রাচীন বাণিজ্য ও ধর্মপথ ওই সিল্করুটের মধ্যেই পড়ে। এছাড়া সারা পথ জুড়েই আরও অজস্র গুহার মধ্যে হাজার হাজার বুদ্ধ মূর্তি শোভা পাচ্ছে।
যে সময়ের কথা যদি সেই সময়কার বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা কোনও বিশেষ সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে উঠে থাকে তাহলে সেই সংস্কৃতির জন্মদাতা যে কোনও দেশ ছাদের উপর উঠে বুক বাজিয়ে তা প্রচার করত। হায়! আমাদের ভারত এই নিয়ে নীরব; মাঝে মধ্যে হয়তো কিছু কানাঘুসো উঠে আসে। আমাদের ইতিহাস বই, সাহিত্য, বলিউডের তুমুল সাফল্য পাওয়া চলচ্চিত্রগুলি কেবলমাত্র মরণপণ যুদ্ধ ও বিজয়ের সাফল্য বর্ণন ও প্রদর্শন করতেই যেন মশগুল হয়ে থাকে। তারা অতীতের রাজা ও তাদের সেনাধ্যক্ষদের সাফল্য ঢক্কানিনাদের সঙ্গে তুলে ধরে, কিন্তু এই এক সময় পবিত্র সংস্কৃতির যে পুষ্প এশিয়া ব্যাপী বিকশিত হয়ে উঠেছিল তার উন্মেষ যে এই ভারতেই হয়েছিল একথা প্রায় অনুক্তই থেকে যায়।
ভারতীয় জনতা পার্টি একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। বলতে দ্বিধা নেই তারাও কিন্তু ভারতে উদ্ভূত এই মহান হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি কী শান্তিপূর্ণ পথে প্রাচীন বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যাকে প্রভাবান্বিত করে এই সংস্কৃতির অনুরক্ত করে তুলেছিল সে কথা সঠিকভাবে তুলে ধরে না। বিজেপির বৌদ্ধিক চিন্তন অনুযায়ী বুদ্ধ ভগবান বিষ্ণুরই নবম অবতার। কিন্তু তাদের কশ্চিৎ কদাচিৎ এ নিয়ে সেই ধরনের কোনো গর্ব প্রকাশ করতে দেখা যায়। যার ফলে মায়াবতীর দল বিএসপি ভারতে বুদ্ধকে তাদের কুক্ষিগত করে ফেলেছে। বিজেপি অপরপক্ষে প্রাচীন যুদ্ধবিগ্রহগুলিতে হিন্দু রাজাদের সাফল্য ও বীরত্বকে প্রাধান্য দেয়। উঠে আসে বহু সমর নায়ক, চিহ্নিত হন নির্দিষ্ট খলনায়কেরা। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই সম্রাট হিমুর নাম উল্লেখিত হয়েছে বারবার। ১৫৫৬ সালে হিমু মোগল সেনাদের অবশ্যই হারিয়েছিলেন। কিন্তু তার দিল্লির সিংহাসন জয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধ করেও দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ তাঁকে হারতে হয়েছিল। তুলনায় ভারতের সাংস্কৃতিক জয়গুলির আয়ু ছিল অনেক দীর্ঘ।
এ প্রসঙ্গে বিজেপির ইতিহাসবিদরা মার্কসবাদী ইতিহাসকারদের বারংবার ইতিহাস বিকৃতি করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। তা যথাযথ। কিন্তু পূর্ব বর্ণিত ভারতের তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক জনপদ ব্যাপী অর্জিত শান্তিপূর্ণ সাংস্কৃতিক। বিজয়ের পঞ্জীকরণে কি তেমন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে? সমগ্র এশিয়া জুড়ে এই গৌরবময় ভারতীয় সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ এক অর্থে অবহেলিতই রয়েছে।
ইতিহাসে জাতির যুদ্ধ বিগ্রহ ও সামরিক আগ্রাসনকেই বড়ো করে দেখার প্রবণতা আছে। কিন্তু সমর শক্তির বদলে সংস্কৃতির কোমল শক্তি (soft power)-রমাধ্যমে এক ফোটা রক্তপাত ছাড়াই ভারত যে তার। সর্বকালীন বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিল তা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। দোষ দেওয়া যায় না কারণ এটি দৃষ্টিকোণেরই দীনতা। সমস্ত ইতিহাসবিদই আমাদের কেবলমাত্র সামরিক বিজয়কেই গৌরবান্বিত করে দেখতে শিখিয়েছেন।
সদ্য চলে যাওয়া এই সাধারণতন্ত্র দিবসে আমরা সেই স্বর্ণযুগকে স্মরণ করে এমন ভবিষ্যতের খোঁজে উদগ্রীব থাকব যেখানে ভারত আর সামরিক নয়, অর্থনৈতিকও নয়, বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের শপথ নেবে।
স্বামীনাথন আইয়ার
2020-02-05