ভারতবাসী সবাইকে সুখী দেখতে চায়। সকলের শান্তি চায়। তাই সেবার মধ্য দিয়ে তা করবার চেষ্টা করে। আর এই সেবার পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। এটাই সঙ্ঘের পরম্পরা। এই পরম্পরাকেই স্বয়ংসেবকরা বহন করে চলেছেন।
ভারতীয় জীবনের ধর্ম হলো সেবা। ভারতবর্ষ প্রাচীনকাল থেকে এই ধর্ম পালন করে আসছে। এই দেশ বহু ধ্বংসলীলা দেখেছে। দেশের বুকে বারেবারে নেমে এসেছে বন্যা, খরা, মহামারী। ভেঙে গেছে বুকের পাজর আর পিঠের মেরুদণ্ড। তবু এই দেশ প্রতিবার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আর এই উঠে দাঁড়ানোর মূলে রয়েছে সেবা। এখানে কেউ কারও দুঃখ সহ্য করে না। এখানে একজনের বিপদে আর একজন এসে পাশে দাঁড়ায়। বিপদের সময় সকলে একসঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে পছন্দ করে। আত্মব্রহ্ম ভাব ভারতবাসীর সকলের মধ্যে বিরাজ করে। রবীন্দ্রনাথ আত্মব্রহ্ম বলেছেন- ‘সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তিনি সবার মধ্যেই বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সেই মানব হয়েই মানুষের সেবা করে চলেছে। রাষ্ট্রের সেবা করার জন্য যে সংগঠনের জন্ম, সেই কাজ করে চলেছে সঙ্ঘ। ভারতের বুকে যতবারই। কোনো বিপর্যয় নেমে এসেছে ততবারই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে। মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন, একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। স্বামী বিবেকানন্দের ‘ভারতবাসী আমার ভাই’এই ধ্যেয় বাক্যকে কখনও ভুলে যায়নি।
তাই ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় মুসলিম লিগের অত্যাচারে দুই। পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু হিন্দুদের । সেবা, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছে সঙ্ঘ। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে “বাস্তুহারা সমবায় ও সমিতি’। পঞ্জাবে ‘পঞ্জাব রিলিফ ফান্ড। ১৯৬২ সালে চীনা আক্রমণের সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করে দেশের সেবায় এগিয়ে আসে। স্বয়ংসেবকরা দেশের একতা ও অখণ্ডতাকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের পরিত্রাতার ভূমিকা বারবার গ্রহণ করেছে সঙ্ঘ। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা পীড়িত মানুষের সেবা করবার জন্য। সবার আগে ছুটে গেছে। নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে পীড়িত আর্তের সেবা করেছে। তা ১৯৬৬ সালে বিহারের প্রচণ্ড খরা এবং দুর্ভিক্ষ হোক বা ১৯১৯ সালে ওড়িশার সুপার সাইক্লোন হোক, গুজরাটের ভূমিকম্প (২০০১) হোক বা ২০০৪ সালের সুনামি হোক, ২০০৯ সালের আয়লা, উত্তরাখণ্ডের বন্যা (২০১৩,২০১৭), কেরলের বন্যা (২০১৮) বা উত্তরপ্রদেশ-বিহারের বন্যা (২০১৯) সর্বত্র সবার আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকেরা ঝাপিয়ে পড়েছে। বর্তমানে করোনা মহামারী সময়েও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকেরা সবার আগে।
এই সেবার মানসিকতা ভারতের চরিত্রের মধ্যে রয়েছে। সেবা ভারতের পরম্পরা, ভারতের সংস্কৃতি। সঙ্ঘ সেই পরম্পরা, সেই সংস্কৃতিকে বহন করতে আগ্রণী ভূমিকা নিয়ে চলেছে। সেবা পরমো ধর্ম’– পূর্বপুরুষদের কাছে সকলে শুনেছে। প্রাচীন ভারতে মুনি ঋষিরা ভ্রমণ করতে করতে কোনো গৃহস্থ বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালে, কেউ তাদের ফিরিয়ে দেয় না। নর রূপে নারায়ণ জ্ঞানে তাদের সেবা করে। ভারতবর্ষের মানুষ আর্তের সেবা করাকে পুণ্য মনে করে। মানব জীবনে ঈশ্বরের পূজার একটি অঙ্গ সেবা। সে কারণে কোনো প্রতিদানের আশা না করে দীন-দুঃখীর সেবা করে। এর জন্য কোনো প্রেরণার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় হৃদয়ের টান। যা ভারতীয়দের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে পরম্পরা অনুসারে চলে আসছে। তাই যে সেবা করে সে অভিনন্দনের আকাঙ্ক্ষা করে না। আমাদের গৃহস্থ বাড়ির দরজায় যদি কোনো পীড়িত ব্যক্তি এসে মাকে জানায়— ‘মা আমার খিদে পেয়েছে। সে খালি পেটে ফিরে যায় না। মা কোনো শাস্ত্র পড়েননি, লেখাপড়া জানেন না। তবুও সেই ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে দুটো খেতে দেন। কারণ আমাদের মা ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে বড়ো হয়েছেন। এই সমাজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ দিয়ে। রামায়ণের রামচন্দ্রের মতো পরমবীর সেবাকর্মে নিজরাজ্যকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে তুলেছিলেন। রামায়ণের মধ্যেই পরিচয় পাওয়া যায় দানবীর রাজা হরিশ্চন্দ্রের। অষ্টাদশ পুরাণের সার হিসেবে বেদব্যাস বলেছেন— পুণ্য আর পাপ। পরের উপকার। করাই পুণ্য আর পরপীড়নই পাপ।
‘অষ্টাদশে পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্। পরপোকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্। গোস্বামী তুলসীদাসও বলেছেন— ‘পবহিত সরিস ধর্ম নহি ভাই। পরপীড়া সম নহি অধর্মই।
আসলে ভারতের স্বভাবের মধ্যে রয়েছে সেবা। এই বোধই আমাদের সর্বদা সেবাকর্মে প্রেরণা দেয়। আর সেই প্রেরণার টানেই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রথম থেকেই সারা ভারতবর্ষে সেবা কর্ম করে চলেছে। কোনো বাধাবিপত্তিতে পিছপা হয়নি। আত্মীয়তার ভাব নিয়ে কাজ করে চলেছে নিরলস ভাবে। ভারতমাতার পিছিয়ে পড়া সন্তানদের ভাই বলে বুকে টেনে নিয়েছে বারবার। কোনো অভিনন্দন প্রাপ্তির জন্য নয়। আর্তের সেবা করাকেই সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা পরম কর্তব্য বলে মনে করে। এর জন্য কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। পরম পূজনীয় শ্রীগুরুজীর কথায়— ‘সেবার মানসিকতা আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। তাদের ব্যবহার, আচার-আচরণ, মানসিকতা আমাদের ভিতরে। সেবার প্রেরণা কখন তৈরি করে দেয় আমরা বুঝতেই পারি না। আর এর প্রথম সূচনা হয় বাড়ির মধ্যে। বাড়িতে কোনো ভিখারি ভিক্ষা করতে এলে ভিখারিকে নিজে দান না করে নিজের শিশু সন্তানকে দিয়ে দান করান। যেন তার সন্তানের মধ্যেও সেবার মানসিকতা তৈরি হয়। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির এই পরম্পরা আজও প্রবাহমান। সেবা-সংস্কৃতির এই পরম্পরার কথাই করোনা মহামারীর সময়ে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেন সঙ্ঘের সরসঙ্চালক মোহনরাও ভাগবত। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল তিনি তাঁর বক্তৃতায় জানান—“মহামারীকে ভয় পেলে চলবে না। ঠাণ্ডা মাথায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে যোজনা পরিকল্পনা করতে হবে। অসুখটা নতুন, যেটুকু জানা যাচ্ছে সেই মতো চলতে হবে। সেবার কাজ মাঝপথে ছাড়লে চলবে না; ক্লান্ত হলে চলবে না। সবাইকে আমরা সেবা করবো এবং অন্যকে সেবার কাজে উৎসাহিত করব। যে চাইবে ওষুধ ও পথ্য তাকেই দেব। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য, আমাদের ঐতিহ্য। পীড়িত মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ করবো না। সেবার মধ্যে থাকবে শ্রদ্ধা, কারণ এটা উপকার নয়।
এই মানসিকতা নিয়েই সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা করোনা মহামারীর মধ্যেই দেশজুড়ে সেবাকাজে নেমেছে। সঙ্ঘ অনুপ্রাণিত – সেবা ভারতী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, আরোগ্য ভারতী, জাতীয় সেবিকা সমিতি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈখিক মহাসঙ্ঘ প্রভৃতি সংগঠন দিনরাত সেবাকাজ করে চলেছে। বিদেশের স্বয়ংসেবকরাও সেখানে এই সেবাযজ্ঞে শামিল হয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে ২ মে পর্যত সর্বভারতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষের ৮৫৭০১টি স্থানে সেবা কাজ করা হয়েছে। এতে অংশ গ্রহণ করেছে ৪৭৯৯৪৯ জন স্বয়ংসেবক। মোট এক কোটি ১০ লক্ষ ৫৫ হাজার ৪৫০টি পরিবারে রেশন সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। রান্না করা খাদ্যের ৭ কোটি ১১ লক্ষ ৫৬ হাজার ৫০০টি প্যাকেট প্রদান করা হয়েছে। ২৭ লক্ষ ৯৮ হাজার ৯১ জন পরিযায়ী শ্রমিককে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করা হয়েছে।
৩৯,৮৫১ ইউনিট রক্তদান করা হয়েছে। ৬২ লক্ষ ৮১ হাজার ১১৭টি মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ১,৩১৪৪৩ জন গৃহহীনের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাইরের রাজ্যের ভ্রমণ, শিক্ষা, তীর্থদর্শন করতে গিয়ে আটকে পড়া ১৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৩৩০ জনকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘের সেবা কাজ চলছে। সমানভাবে। সঙ্ঘের দৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গ দুটি প্রান্তে বিভাজিত। দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ। আন্দামান নিকোবর নিয়ে যে দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত তাতে ১৫,৭৪০ জন স্বয়ংসেবক কঠোর পরিশ্রম করে সঙ্ঘের সেবাকাজ সর্বত্র পৌঁছানোর চেষ্টা করে চলেছে। এখনও পর্যন্ত মোট ৫৭৫০ স্থানে সেবাকাজ করা হয়েছে।১ লক্ষ ৯১ হাজার ৪৬৫টি পরিবারে রেশন সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সেবা, শিশুখাদ্য, পাচন, হোমিওপ্যাথি ওষুধ ইত্যাদির বিশেষ ব্যবস্থা প্রদান করা হচ্ছে। মোট ৮০ জন। ডাক্তার এখনও ফ্রি হেল্পলাইনের মাধ্যমে তাদের সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। ৫০ হাজার লোকের কাউন্সিলিং করা হয়েছে। দু’লক্ষ মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ৪০০ ইউনিট রক্তদান করা হয়েছে। তাছাড়া সঙ্ঘের যে বিবিধ সংগঠন তারা মোট ৪ হাজার স্থানে ১২ হাজার কার্যকর্তা মোট ৩ লক্ষ পরিবারের সাহায্য পৌঁছে দিয়েছেন।
সিকিম সহ উত্তরবঙ্গের স্বয়ংসেবকরাও সমাজের সর্বত্র সেবাকাজ পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরন্তর প্রয়াস করে চলেছেন। এখনো পর্যন্ত ৬৫৬০ জন স্বয়ংসেবক ২ হাজার ৮১১ স্থানে সঙ্ঘের সেবাসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। এর ফলে উপকৃত হয়েছে মোট ৮৬ হাজার ৯৮৮টি পরিবার। ৬১ হাজার ১৬৬টি শুকনো রেশন কিট এবং ২০ হাজার ৬০৮টি খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। ৩৮ হাজার ৫৯০টি মাস্ক, ১৪ হাজার ৫০৯টি সাবান ও স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। এই কঠিন মহামারীর মধ্যেও ৬০টি রক্তদান শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা স্যানিটাইজ করা, শিশুদের জন্য শিশুখাদ্য প্রদান, সাফাই কাজ, সাফাইকর্মীদের সংবর্ধনা দান ও অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে করে চলেছে।
ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে সেবা কাজ করে চলেছেন সেখানকান স্বয়ংসেবকরা। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর অনুযায়ী ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বড়ো সেবাকাজ পরিচালনা করেছে। এই সেবাকর্মে আমেরিকার ২২৫০০ স্বয়ংসেবক অংশ গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ংসেবক পরিচালিত সেবা ইন্টারন্যাশনাল আমেরিকা-সহ সারা বিশ্বে ৮ লক্ষ ৯০ হাজার আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করে সেবাকাজে ঝাপিয়ে পড়েছে। ১৫০ ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রকে তাদের থাকা খাওয়া এবং দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ৪৬ হাজারেরও বেশি এন-৯৫ মাস্ক ও ৫০০ লিটারের বেশি স্যানিটাইজার বিলি করেছে। সারা বিশ্বে সেবা ইন্টারন্যাশনাল ও হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ যেখানেই প্রয়োজন পড়েছে, বিশ্ববাসীর সেবায় নিজেকে উজার করে দিয়ে চলেছে।
ভারতবাসী সবাইকে সুখী দেখতে চায়। সকলের শান্তি চায়। তাই সেবার মধ্য দিয়ে তা করবার চেষ্টা করে। আর এই সেবার পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে রাষ্ট্রীয় । স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। এটাই সঙ্ঘের পরম্পরা। এই পরম্পরাকেই স্বয়ংসেবকরা বহন করে চলেছেন।
বিনয় বর্মন