শরণার্থী ও উদ্বাস্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সিএএ ২০১৯-এর ভূমিকা

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কণ্ঠে ঘোষিত হলো ভারতের স্বাধীনতা। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়া ভারতবর্ষ ভাগ হলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। ১০০০০ বছরেরও বেশি সময়ের সাক্ষী আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ তার অতীতের অস্তিত্ব হারিয়ে দ্বিখণ্ডিত হলো ভারত ও পাকিস্তানে। সেদিন জাতিসত্তার নতুন সংজ্ঞা নিরূপিত হয়েছিল মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও তার মুসলিম লিগের রাজনৈতিক দর্শনের ভেতর দিয়ে। আধুনিক জাতিসত্তার জনক আর্নেস্ট রেনানের সংজ্ঞা সেদিন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আর্নেস্ট রেনান বলেছিলেন, “একই সভ্যতা-সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, আনুভূমিক ভাষা এবং জীবনধারার সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর কল্পিত ভূখণ্ডের সমষ্টিগত আত্মপ্রকাশের নাম হলো জাতি”। সেখানে নতুন করে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটল। সিন্ধুসভ্যতা, হরপ্পা সভ্যতা, বৈদিক সভ্যতার জননী ভারতবর্ষে সেদিন ভাগ হয়ে। গিয়েছিল উগ্র ইসলামি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদে। মাত্র ২৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী সেদিন ২৬ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গড়ে তুলেছিল তাদের কাঙ্ক্ষিত পাকিস্তান। পাকিস্থান অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য পবিত্র ভূমি। আর তাদের তথাকথিত বিদ্বেষ ভূমি যা আমাদের কাছে পবিত্র হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষ, আপামর ভারতবাসীর ভারতমাতা।
৭১২ সালে মহম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু প্রদেশের রাজা দাহিরকে পরাজিত করার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় তেরোশো বছর একই ভূমিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একসঙ্গে বসবাসের পরেও যারা ভারতীয় জাতিসত্তায় লীন হতে পারলেন না, যারা ধর্মীয় ভাবধারা এবং বিশ্বাসের মধ্যে জাতিসত্তার খোঁজ পেলেন তা বোধহয় ইতিহাসের লজ্জা মানব সভ্যতার লজ্জা। আর এই ভারত ভাগের পর থেকেই শুরু হলো উদ্বাস্তু শরণার্থী শ্রেণীর আবির্ভাব। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শুরু হলো সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি জনগোষ্ঠীর নিজ দেশ ত্যাগ করে ভারত ভূমিতে আশ্রয়ের অধ্যায়। যেহেতু ওটা পাক ভূমি, সুতরাং সেখানে অপাক (অমুসলিম) জনগোষ্ঠীরা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক ভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ঘোষিত হলো। যদিও তৎকালীন পাকিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২২.২৩ শতাংশের কাছাকাছি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সেটা ২৮ শতাংশের কাছাকাছি যা আজকে পাকিস্তানে ১.৭৮ শতাংশ আর পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশে ৮শতাংশেরর কম। কিন্তু কোথায় গেল পাকিস্তান এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা? এই হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ আজ ভারতবর্ষে উদ্বাস্তু তথা শরণার্থী। সংখ্যাগুরু মুসলমান জনগোষ্ঠীর সামাজিক রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ভাবাবেগের পীড়নজনিত কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ তারা মান-সম্ভ্রম ভিটেমাটি সম্পত্তি হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে ২১২টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই প্রলয়ংকারী দাঙ্গার সমাধান হিসেবে ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল নেহরুলিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয় দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজনিজ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যার পূর্ণমাত্রিক ব্যবহার হয়েছিল ভারতে এবং ভারতীয় সংবিধান সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে তখনো বিধিবদ্ধ সংবিধান রচিত হয়নি। চৌধুরী মহম্মদ আলি তখন সবেমাত্র পাকিস্তান সংবিধানে তৈরির খসড়া নির্মাণে ব্যস্ত যা পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিকভাবে গৃহীত হয়। অর্থাৎ একটা সংবিধান বিহীন দেশের সঙ্গে সেদিন নেহর-লিয়াকত চুক্তি হয়েছিল যা সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তানে প্রয়োগযোগ্য ছিল না। তাহলে এই ঐতিহাসিক ভুল কি পণ্ডিত নেহরর রাজনৈতিক অপরিপক্কতা না। অপরিণামদর্শিতা? নাকি তিনি পাকিস্তানে থাকা হিন্দু এবং শিখদের চিরকালের জন্য বিসর্জন দেওয়ার আইনি বন্দোবস্ত করেছিলেন ? পাকিস্তানে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি কার্যকর না হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষ অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করল আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে আশ্রয় নিল পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, উত্তরপ্রদেশ ও কাশ্মীরে। একথা উল্লেখ করা দরকার কেবলমাত্র কাশ্মীরে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু এবং শিখরা ৩৭০ ধারার কারণে পাকিস্তান ত্যাগের পরেও ভারতের নাগরিকত্ব পাননি এবং কেবলমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণী বসবাসকারী নাগরিকে পরিণত হন। প্রমাণস্বরূপ বাল্মীকি সম্প্রদায় ও জম্মু-কাশ্মীর সরকার মামলা দ্রষ্টব্য।
সিএবি-২০১৯ পাশের মধ্য দিয়ে সেই সমস্ত কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষদের সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের আইনি ব্যবস্থা করা হয়। এই সিএবি পাশের মধ্য দিয়ে বিগত ৭২ বছরের উদ্বাস্তু এবং শরণার্থী (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন এবং পার্সি) সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো। ইউএন হাই কমিশন ফর রিফিউজি ১৯৫১ গাইডলাইন অনুযায়ী ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ভাবে অত্যাচারিত, শোষিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, প্রকৃতপক্ষে সর্বহারা নির্যাতিত মানুষদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান অখণ্ড ভারতবর্ষের অঙ্গ ছিল। তাই ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রজন্মগত দায়বদ্ধতা থেকেই এই তিন দেশের সংখ্যালঘু ৬টি সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ভাবনা। এক্ষেত্রে মুসলমানদের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই এজন্য যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের অংশ তারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আদায়ের মাধ্যমে পেয়ে গেছে, উপরন্তু এই সকল দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর অত্যাচারের ফলে যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলো সেই অত্যাচারীদের পুনরায় ভারত ভূমিতে নাগরিক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো মানবিকতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। যদিও বর্তমানে কিছু তথাকথিত মুখোশধারী অতি উদারবাদী দল মানুষকে ভুল বোঝাবার জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে চলেছেন। আসলে এরা বিদেশি মদতদাতাশক্তির স্টাইপেন্ড পাওয়া রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী। এই সমস্ত দল যে পেট্রোডলার মদতপুষ্ট আর পাকিস্তানি রাজনৈতিক দর্শনে চালিত হয় তা ক্যাব ২০১৯ পাশের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত। যেখানে সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পরিষ্কার বলেছেন ১৯৪৭-এর পর ভারতে আসা মুসলমান এবং তাদের বংশধরেরা ভারতের নাগরিক সেখানে উলুবেড়িয়া, বেলডাঙ্গা, মালদা, শিলিগুড়ি, বীরভূম, ভালুকা, সল্টলেক, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় রেলস্টেশন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মানুষকে হত্যা করার চেষ্টা চালানো লুটপাট চালানো এই অপচেষ্টাকারীরা কারা? কী তাদের পরিচয় ? কোন রাজনৈতিক শক্তি এদের পিছনে? রাজ্য প্রশাসন কেন এখনো নিশ্চপ? রাজ্য সরকার ঠিক কী চাইছে? সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে নিরীহ যাত্রীদের আহত করে কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? বর্তমান রাজ্য সরকার একটি সাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পরোক্ষভাবে উগ্রপন্থাকে ইন্ধন দিচ্ছে— এ তো সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপ। আর সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৯ তো শরণার্থীদের নাগরিকত্বের কথা বলছে, কারো নাগরিকত্ব হরণের কথা বলছে না। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ বিশেষ জায়গায় কেন এই পাথরবাজি? সেই কাশ্মীরের পাথর ছোড়া বাহিনী যারা ভারত সরকারের দেওয়া (৩৭০ ধারা) সস্তা রেশনের চাল-ডাল-তেল-লবণ খেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাথর ছুড়ে মারতো তারা কি এখন পশ্চিমবঙ্গেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ? এখন । ভাবার সময় এসেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতেও তাদের নতুন কলেবরে উৎসাহিত করে তুলছে। তিনি বলছেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে একটা নির্দিষ্ট দাবি থাকে। এদের দাবি কী? কোন সে দাবিতে তারা পাথরবৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর,ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে জনজীবন অচল করে তুলছে? সিএবি পাশের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী উদ্বাস্তু মানুষকে আশ্রয় এবং নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে এটা কি অপরাধ? উত্তর দেবেন কি মাননীয়া?
গত তিনদিনের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে এ পর্যন্ত ১৬ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে তার দায়ভার নিচ্ছেন তো? স্মরণে রাখা দরকার, যা ধ্বংস করা হলো তা জনগণের প্রদত্ত করের টাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ। মননীয়াকে জিজ্ঞাস্য আপনি কি এই কোটি কোটি উদ্বাস্তু শরণার্থী মানুষকে নাগরিকত্বের স্থায়ী সমাধান চান না? শুধু মিথ্যা অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে তাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার ও হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের নামে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করা কি আপনার রাজনৈতিক দর্শন? নাকি নতুন করে আরেকটি পাকিস্তান কিংবা মুঘলস্থান তৈরির স্বপ্নে মশগুল হিংসাশ্রয়ী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আপনিও গোপন ষড়যন্ত্রে শামিল? তবে মনে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গের মাটি মহান দেশপ্রেমিক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আত্মবলিদানের ফসল। আর প্রাণের বিনিময়ে হলেও আমরা ড. শ্যামাপ্রসাদের আত্মবেদী রক্ষা করব। শ্যামাপ্রসাদের রক্তস্নাত পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে জিন্নাবাদীদের উত্থান রাজ্যের মানুষ মানছে না, মানবে না। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন পশ্চিমবঙ্গে মানুষ আগামীতে তার জবাব দেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই।
সুদীপ সিকদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.