ফ্রান্সের অদ্বিতীয় সমরানায়ক ও সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, চীন হলো ঘুমন্ত দানবী। ওকে ঘুমতে দাও, ও জেগে উঠলে জেগে উঠলে পৃথিবী কাপিয়ে দেবে। আজ যেন সত্যিই জেগে উঠেছে। আগ্রাসী চীন। করোনার আঁতুড়ঘর চীন আজ বিশ্বের কাছে একঘরে । শান্তিপ্রিয় ভারতবর্ষের বিকাশ এই হিংস্র দানবীর চক্ষুশূল। আগ্রাসী চীনের মোকাবিলা করতে গিয়ে শহিদ হলেন ভারতের একজন কর্নেল-সহ ২০ জন সেনা জওয়ান। অবশ্য ভারতীয় জওয়ানরাও সাহসের সঙ্গে এর যোগ্য জবাব দিয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত ১৬ জুন সোমবার রাতে সেনা প্রত্যাহার করার সময়। দুই পক্ষের সেনা পর্যায়ে আগে যে পরপর বৈঠক হয়েছিল সেই বোঝাপড়া অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সেনা প্রত্যাহার করছিল দুই পক্ষই। সেই সময় পিপলস লিবারেশন আর্মির কয়েকজন ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে ভাঙা ভাঙা হিন্দি এবং ইংরেজিতে উস্কানিমূলক মন্তব্য করছিল। কয়েকজন ভারতীয় সেনা এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে চীনারা রড, কাঁটাতার, শাবল নিয়ে হামলা চালায়। তারপর শুরু হয় তীব্র খণ্ডযুদ্ধ। সংঘর্ষের পরে দেখা যায় ভারতীয় কর্নেল (সন্তোষবাবু), জুনিয়র কমিশনড অফিসার ও এক জওয়ানের প্রাণহীন দেহ পড়ে রয়েছে। উল্টোদিকে পড়েরয়েছেরক্তাক্ত কয়েকজন চীনা সেনার লাশ।।
পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকায় প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে এই সংঘর্ষ যেন চীনের পূর্ব নির্ধারিত এক কৌশলমাত্র। এই ঘটনার নেপথ্য রয়েছেনবনির্মিত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা। লাদাখের দরবুক থেকে দৌলতবেগ ওল্ডি (ডিবিও) পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হতেই চীন অসন্তুষ্ট। এই রাস্তা অত্যন্ত ‘ডিভিকাল্ট টেরেইন’-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন ১৬৬১৪ ফুট উচ্চতায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপ হচ্ছে দৌলতবেগ ওল্ডি। এই রাস্তাটি ‘অল ওয়েদার রোড’। শীতকালে প্রবল তুষারপাত্যে রাস্তা দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে, শুধু জমে থাকা বরফ সরিয়ে নিতে হবে। গত বছর এই রাস্তাতেই শিয়ক নদীর উপরে নির্মিত একটি ব্রিজ উদ্বোধন করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। এই রাস্তার একদিকে আছে চীনা অচল, অন্যদিকে ২০ কিলোমিটার দূরে আছে কারাকোরাম হাইওয়ে ও চীন-পাক ইকোনমিক করিডর। আগে যেখানে আর্মি বেস থেকে দুর্গম অঞ্চলে রিজার্ভ ফোর্সের পৌঁছতে। সময় লাকত ২৮ ঘণ্টা, এখন সেখানে মাত্র ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। চীন ভারতের এই দাপট মেনে নিতে পারছে না।
২০১৭ সালে ডোকলাম কাণ্ডের মূল কারণ ছিল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার সন্নিকটে চীনের তৈরি ১২ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা। ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানায়। দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বজায় থাকে ৭৩ দিন। টানা ৬ সপ্তাহ আলোচনার পর সরে আসে দুপক্ষই।
অতিতে বহুবার চীন তার আগ্রাসী মনোভাবের স্বাক্ষর রেখেছে। ১৯৬২ লালে একাযোগে লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশে হানা দিয়েছিল লালফৌজ। এই যুদ্ধে ৩২৫০ জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হয়েছিলেন। টানা এক মাসের এই যুদ্ধে আকসাই চীন হাতছাড়া হয়েছিল ভারতের। আজও এই ভূখণ্ড ভারত ফেরত পায়নি। এই ভূখণ্ড ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ডব্লিউ এইচ জনসনের সীমারেখা অঙ্কনের মাধ্যমে ভারত পেয়েছিল। যা জনসন লাইন’ লে পরিচিত। ১৯৫১ সাল থেকেই এখানে সড়ক নির্মাণ নিয়ে ভারত-চীন বিরোধ সৃষ্টিহয়। ১৯৬২ সালের এই যুদ্ধের প্রকৃত সত্য জানার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান হেন্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট জমা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। এই রিপোর্ট পড়ে নেহরু রিপোর্টটি তালা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। আজও এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। রাহুল গান্ধী এই রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য সরব হবেন কী?
১৯৬৭ সালে ঘটে লাথুলা সংঘাত। সিকিমে চীনা অনুপ্রবেশ রুখতে কাটাতারের বেড়া দিচ্ছিলেন ভারতীয় জওয়ানরা। তখনই তাদেল লক্ষ্য করে গুলি চালায় লালফৌজ। পাল্টা জবাবে ভারত গুড়িয়ে দেয় চীনা বাঙ্কার। ফলে মারা যায় তিনশোর বেশি চীনা সৈনিক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে চো লা সংঘাতে লালফৌজ পিছু হটলেও মারা যান ৪৪ জন ভারতীয় জওয়ান। ১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর অরুণাচল প্রদেশের টুং লা এলাকায় অসম রাইফেলসের টহলদার বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে চাল জওয়ানকে মেরেছিল চীনা সেনা। ১৯৮৭ সালে অরুণাচল প্রদেশকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতেই চীন ফের ঝামেলা শুরু করল। অরুণাচল প্রদেশে ঢুকে হেলিপ্যাড বানাতে শুরু করল চীন। ভারতীয় বায়ুসেনা বাধা দেয়। এরপর আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত বিরতিতে যায় দুপক্ষ। অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবুও বিভিন্ন অজুহাতে চীন সময়ে সময়ে তার গাত্রদাহ প্রকাশ করে। | সম্প্রতি নেপালের মানচিত্রে পরিবর্তন সংক্রান্ত ঘটনায় উস্কানি রয়েছে চীনের। চীনের এই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এবং আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সত্যিই লজ্জাজনক। ১৯৬২-রযুদ্ধেচীনের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটেছিল তদানীন্তন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। এবার লাদাখের লাল সন্ত্রাস নিয়ে সিপিএম পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে তারই হুবহু প্রতিফলন। দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা প্রশমনে ও শান্তি স্থাপনে কেন্দ্রের কী করা উচিত, সে ব্যাপারে তাত্ত্বিক পরামর্শ থাকলেও চীনা আগ্রাসনের বিষয়টি সন্তর্পণে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটি নিয়ে বঙ্গ সিপিএমের নেতারা একটি শব্দও খরচ করতে নারাজ। মুখ খোলার দায়িত্ব পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপরই ছেড়ে দিয়েছে অলিমুদ্দিন।
প্রশ্ন হলো করোনা আক্রান্ত এই বিধ্বস্ত সময়ে চীন কেন এরকম আচরণ করল ? বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাকে কেন্দ্র করে চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট নয়াদিল্লির ৩৭০ ধারা রদ এবং লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা পাকিস্তানের গালে এক উত্তর চপেটাঘাত। পাকিস্তানের প্রাণসখা চীন নয়াদিল্লির এই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। উত্তরকোরিয়া, দক্ষিণকোরিয়া, ইজরাইল,প্যালেস্তাইন প্রভৃতি বিবদমান দেশগুলি কোথাও ঝামেলা করছেনা কিন্তু চীন ব্যাতিক্রম। আমেরিকা প্রকাশ্যে চীন সম্পর্কে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছ। জাপান সরকার জাপানি ব্যবসায়ীদের চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, করোনা নিয়ে চীনের ভূমিকা তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ঘটনাচক্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত কমিটির প্রধান ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এছাড়া হংকংয়ের পরিস্থিতি নিয়েও সচেতন, সুপরিকল্পিত, ঘৃণ্য পদক্ষেপ। চীনের বহু বর্ষব্যাপী ষড়যন্ত্রের বীজ লুকিয়ে আছে মাও জে দং-এর একটি মন্তব্যের মধ্যে। ১৯৫০ সালে চীন সামরিকভাবে তিব্বত দখলের পর মাও জে দং মন্তব্য করেছিলেন তিব্বত চীনের হাতের তালু, লাদাখ, নেপাল, সিকিম, ভূটান এবং নেফা (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) তার হাতের আঙুল। তাই কড়া হাতে চীনের আগ্রাসনকে রুখতে হবে নয়তো গালওয়ানের মতো সংঘর্ষের ঘটনা ফের হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
অনু বর্মণ