চারদিকে চলছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে-বিপক্ষে মিটিং মিছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অতীতে যারা ধারা ৩৭০, ৩৫(এ)-র পক্ষে ছিলেন, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে সংশয়, তিন তালাক বিলে অনীহা, ইভিএম, রাফাল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে গুজব তৈরির প্রয়াস চালিয়েছিলেন তারাই এখন নতুন ঢঙে CAA, NRC, NPR নিয়ে সংবিধান বিরোধী খেলায় নেমেছেন। প্রত্যেকটি দেশের। নির্বাচিত সরকার নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় জনগণের স্বার্থে বৃহৎ সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ-সহ আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও নাগরিকপঞ্জী আছে। উল্লেখ্য যে মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশ সম্প্রতি নাগরিকপঞ্জী প্রস্তুত করতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে ভারত কি নিজের দেশের সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জী বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করতে পারে না? ২০১৯ লোকসভায় জনগণের আশীর্বাদ স্পষ্টকরেছে গত সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সঠিক এবং সময়োপযোগী ছিল—সেটা জিএসটি হোক কিংবা নোটবন্দি। তেমনিভাবে খুব কম। সময়ের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় সরকারে আমরা দেখতে পেয়েছি তিন তালাক বিল, রামমন্দিরের সুরাহা, সংশোধনী নাগরিকত্ব বিল যা খুবই প্রশংসনীয়। বিশেষত এখন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে রাজপথে যে তাণ্ডব চালানোর প্রয়াস চলছে তাতে স্পষ্টভাবে বলা যায় এক বিশেষ গোষ্ঠীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ, যারা মন থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ, তিন তালাকে নিষেধাজ্ঞা এবং সুপ্রিম কোর্টের রামমন্দিরের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। যাই হোক, উত্তর প্রদেশ সরকার, অসম সরকার কড়া হাতে যেভাবে এই জেহাদিদের দমন করেছে, মমতার ঠিক উল্টো। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের জন্য পশ্চিমবঙ্গে জ্বালানো হয়েছে কয়েকশো কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহীদের ইতিমধ্যে বিদেশি জেহাদি সংগঠন থেকে আর্থিক লেনদেনের স্পষ্ট প্রমাণ সরকার পেয়েছে। এই সিলেক্টিভ বিদ্রোহ দেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক ধাপ এগিয়ে বলে দিয়েছেন সরকার এক চুলও সরছে না। প্রধানমন্ত্রী মোদী বিরোধীদের উদ্দেশে বলতে বাধ্য হয়েছেন তারা যদি এভাবে একবার হলেও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জন্য রাজপথে নামতেন!
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের কিছু পরেই দেখা যায় পাকিস্তানের ঐতিহাসিক নানকানা সাহিব গুরুদ্বারে মৌলবাদীদের আক্রমণ। তাদের দাবি গুরুদ্বারটি বদলে করতে হবে গুলাম-ই-মুস্তাফা, শিখদের বদলে থাকবে এখানে মুসলমানরা। এইশিখ সম্প্রদায়ের শুধু অপরাধ ছিল তারা এক শিখ তরুণী জগজিৎ কৌরের জবরদস্তি ধর্মান্তকরণের প্রতিবাদ করেছিলেন মাত্র। গুরুদ্বার কাণ্ডের পরপরই প্রকাশ্যে দিনদুপুরে রাস্তায় পেশোয়ারে পরবিন্দর নামের এক যুবককে খুন করা হয়। পাকিস্তানে সাধারণ সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে ভিআইপিরাও নিরাপত্তাহীনতা এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে জর্জরিত। সেদিন পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার দানিশ কানেরিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান টিমে। তার প্রতি বৈষম্য করা হতো, এমনকী সতীর্থদের সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়ারও অধিকার। ছিল না যেটা সতীর্থ শোয়েব আক্তার খোদ অকপটে স্বীকারও করেছেন। পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু ক্রিকেটার অনিল দলপতও অভিযোগ করেছেন ১৭ বছর আগে শুধু সংখ্যালঘু হিন্দু হওয়ার অপরাধে ইমরান খানের রোষানলে বিনষ্ট হয়ে যায় তাহার সম্পূর্ণ ক্রিকেট কেরিয়ার। শুধু জাতীয় দলের সংখ্যালঘু ক্রিকেটার নয়, ভালো নেই দেশের সংখ্যালঘু বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীরাও। প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু প্রীতির বার্তায় এবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দলের খাইবার পাখতুনের প্রাক্তন বিধায়ক বলদেব কুমার আশ্রয় নিতে মোদী সরকারের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁর চোখের সামনে পাকিস্তানে প্রচুর সংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অপহরণ, ধর্মান্তকরণ, ধর্ষণ, খুন করা হচ্ছে, সুতরাং এমতাবস্থায় তিনি আর সেখানে ফিরতে চান না। বেনজির ভুট্টোর শাসনকালে পাঞ্জাব প্রদেশের প্রাক্তন সাংসদ দিব্যনাম অত্যাচারিত হয়ে ২০০২ সাল থেকে সপরিবারে ভারতের হরিয়ানায় শরণার্থী হয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। প্রাক্তন এই সাংসদ আক্ষেপের সুরে জানান তিনি সাংসদ হয়েও নিজের এলাকায় সংখ্যালঘু মেয়েদের ধর্ষণ, অপহরণ এবং ধর্মান্তকরণ রুখতে পারেননি। মৌলবাদীরা তার শ্যালকের দুই মেয়েকে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করেছে। সাংসদ বারংবার প্রশাসনকে জানালেও কোনও লাভ হয়নি, কয়েকদিন পর ওই দুই মেয়ের লাশ বাড়ির পাশেই পাওয়া যায়। সাংসদকে যে কাপে চা দেওয়া হতো সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে সেই কাপটা ভেঙে ফেলা হতো এবং কাপের দামটাও তার কাছ থেকে আদায় করা হতো। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যালঘুদের করুণ অবস্থা অব্যাহত। সংখ্যালঘু শিশুদের বিদ্যালয়ে প্রার্থনার বদলে কলমা পড়ানো, শিশুদের কচিকাচা মনে অমুসলমানদের জন্য হিংসার বীজ বপন, নামাজ পড়ানো, হিজাব পরানো প্রভৃতি এখন আরও ক্ষিপ্রতর হয়ে উঠেছে। শাখা-সিঁদুর পরা, হোলি, দীপাবলি উদ্যাপন প্রভৃতি পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুদের মর্জিতেই করা যায়। পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এক জন দলিত ও অবিভক্ত ভারতবর্ষের নেতা ছিলেন। ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করার সাধ মিটলেও দলিত হিন্দু হওয়ার অপরাধে খোদমন্ত্রী হয়েও রাতের অন্ধকারে সপরিবারে আবার ভারতে ফিরতে বাধ্য হন।
পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্মান্তকরণ এবং হত্যার সেই ট্রাডিশন এখনও অব্যাহত। পাকিস্তানের একটি ইংরেজি সংবাদপত্র ‘Express Tribunes’-এর মতে প্রতি বছর প্রায় ১২৫০ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মেয়েকে বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তকরণ করা হয়। সম্প্রতি অনিলা ধাওয়ান নামের ১৭ বছরের এক গরিব নাবালিকাকে তার বাবার সামনে থেকে তুলে। নিয়ে যাওয়া হয়, পরে যথারীতি ধর্ষণ, ধর্মান্তকরণ এবং অবশেষে পঞ্চাশোর্ধ এক বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় যার দুজন বিবি রয়েছে। সেখানকার আরেক সংবাদপত্র Asia News-এর একটি প্রতিবেদন জানায় পুরো একটি খ্রিস্টান পরিবারকে মৌলবাদীরা হত্যা করে, কারণ তারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে চায়নি। পাকিস্তানের ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুসারে শুধু হিন্দু প্রায় ২০ শতাংশ ছিল কিন্তু ১৯৯৮ সালের গণনানুযায়ী সেই সংখ্যা ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ এর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার তালিকায় পাকিস্তানকে ব্ল্যাকলিস্টেড করেছে। ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা পাকিস্তানের অন্যতম জঘন্য আইন। আগে পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ছিল কিন্তু ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে সেনাশাসক জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইনে কয়েকটি নতুন ধারা সংযোজন করে এই আইনকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাবাস করেছে। এখনও পর্যন্ত ব্লাসফেমি আইনে পাকিস্তানে চল্লিশজন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, কয়েকমাস আগে আসিয়া বিবি নামের এক ক্রিস্টান মহিলাকে ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল, এখন আবার জুনাইদহাফিজ নামের ৩০ বছরের এক তরুণ অধ্যাপককে ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তান। আদালত ফঁসির সাজা শুনিয়েছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাস। থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত শুধু সিন্ধ প্রদেশে মোট ৭৪৩০ জন মহিলা যুবতীকে অপহরণ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের লারকানায় হিন্দুযুবতী ডাক্তার নিমরিতা চান্দরানিকে হোস্টেলে ধর্ষণ করে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়। ঠিক তেমনিভাবে ভুগতে হয়েছে রেনো কুমারী, চান্দ্রী কোহলি, বাগরি, অঞ্জলি মেঘওয়ার, কিরণ কুমারী-সহ অগণিত হতভাগীকে। পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জবরদস্তি ধর্মান্তকরণ রোধে নন্দ কুমার নামে সিন্ধু প্রদেশের এক সেনেট সদস্য একটি বিল পেশ করেছিলেন কিন্তু গভর্নর সাইদুজ্জামান সিদ্দিকি বিলটি ইসলামের পরিপন্থী বলে সেটি বাতিল করে দেন। একইভাবে পাকিস্তানের এক খ্রিস্টান সাংসদ ড. নবিদ আমির জীবা সংবিধানের ৪১ এবং ৯১ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে। দেশের অমুসলমানদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পদ প্রশস্ত করার জন্য এক বিল প্রস্তাব করেন। কিন্তু রাজ্যমন্ত্রী আলি মোহাম্মদ সহ সংসদের বাকি সব সদস্য প্রস্তাবটির বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেন, পাকিস্তান একটি ইসলামিক দেশ, তাই কোনও অমুসলমান প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। সংখ্যালঘু বিদ্বেষে। পাকিস্তানে ২০১৭ সালের জনগণনায় শিখদের সংখ্যা কমে আট হাজার হয়েছে যেটি ২০০২ সালে চল্লিশ হাজার ছিল। নিজ দেশের এই সংখ্যালঘু নিধন যজ্ঞের পরেও পাক প্রধান রাষ্ট্রসজ্ঞা দাঁড়িয়ে ভারতকে অসহিষ্ণুতার পাঠ শেখান, ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, এনআরসি, এনআরপি এমনকী জেএনইউ ইস্যুতেও এই নির্লজ্জরা নাক গলাতে দ্বিধাবোধ করে না। ভারত এমন এক অপরিপক্ক প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে যিনি কাশ্মীরের ৩৭০, ৩৫(এ)-র ইস্যুতেও জেহাদের উস্কানি দেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সংখ্যালঘু উৎপীড়ন রোধে। অনেক আগেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন কার্যকরী করা জরুরি ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী বারংবার রাজনৈতিক বিরোধীদের রাজপথে আন্দোলন করার চেয়ে প্রতিবেশী দেশের। সংখ্যালঘুদের জন্য মানবতার স্বার্থে আওয়াজ। তুলতে আহ্বান করছেন।
রঞ্জন কুমার দে