রামমন্দিরের শিলান্যাস ভারতীয় নবজাগরণের সূচনারই প্রকাশ

রাম’ভারতের মানুষের হৃদয় উদ্বেলিত একটি নাম।

এই ‘নাম’ জন্ম-জন্মান্তরের কালপ্রবাহকে অতিক্রম করে বয়ে চলা এক জীবনবােধ। জন্ম-মৃত্যুরহিত এক ব্রহ্মশক্তি রামচন্দ্রের রূপ ধরে কেবলমাত্র জীবের কল্যাণের জন্য এই মর্ত্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। বিশ্বকবি অসাধারণ কথাকে সহজ ভাবে বলেছেন, “বাল্মীকির রামচরিত কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না তাহাকে ভারতবর্ষের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থ ভাবে বুঝিতে পারিবেন। পরিপূর্ণ মানবের আদর্শ চরিত্র ভারতবর্ষ শুনিতে চাহিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত তাহা অশ্রান্ত আনন্দের সহিত শুনিয়া আসিতেছে। একথা বলে নাই যে, বড়াে বাড়াবাড়ি হইতেছে, একথা বলে নাই যে, এ কেবল কাব্যকথা মাত্র। ভারতবাসীর ঘরের লােক এত সত্য নহে— রাম লক্ষ্মণ সীতা তাদের পক্ষে যত সত্য।”

শ্রীরামচন্দ্রের কঠোর আত্মত্যাগ এবং সংগঠন কুশলতা ভারতবর্ষের দুটো যুগের— ত্রেতা, দ্বাপর—মধ্যে এক বিশিষ্ট ইতিহাস ধারার প্রকৃতি

লক্ষ্য করেছেন বিশ্ববাসী। সীতা হরণের পর এক অচেনা অজানা দেশকে জানতে পেরে নারীত্বের মূল্য প্রতিষ্ঠা ও বলদর্পী রাবণের স্বর্ণ সভ্যতার অহংকারকে বিধ্বস্ত করেছিলেন শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ, শুধুমাত্র অরণ্যবাসী বানর সদৃশ মনুষ্যকুলের সাহায্যে। এই অরণ্যবাসী খুবই পণ্ডিত ছিলেন না, তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন না, তবুও তাঁরা দুর্ধর্ষ রাবণের সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। হাতে তেমন অস্ত্র ছিল না, এমনকী গাছের ডাল নিয়ে তারা সমুদ্র পার হয়ে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। বন বন মে ভটকনে’-বালা রাম এই সৈন্যদের একটি পয়সাও দিতে পারেননিযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে। এই সৈন্যদের কণ্ঠে ছিল শ্রীরামের হর্ষধ্বনি আর সীতামাতাকে যে রাবণ হরণ করেছে তাকে হত্যার সংকল্পে।

এর পরেই ভারতবর্ষ কেমন পালটে গেল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম দ্রোণচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণের মতাে বীর তত্ত্বজ্ঞানী বিদ্যাবিশারদের সামনে প্রকাশ্য রাজসভায় কুলবধু দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনা নীরবে সহ্য করেছিলেন। এরাই আবার ‘রাবণ’কে সমর্থন করে যুদ্ধ করলেন ন্যায় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা পাণ্ডবদের বিপক্ষে, এমনকী পরম প্রেমময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিরােধিতা করেও। কোটি কোটি সুবর্ণমুদ্রা যুদ্ধাগ্নিতে ভস্মীভূত হলাে, কোটি কোটি রাজসৈন্য-সহ রথী-মহারথীরা নিহত হলেন। এই অন্যায়বােধ, রামচন্দ্রের পর একটি যুগ বিবর্তনে এমন নৈরাজ্য, এমন হিংস্র পাশবিকতা, ভারতবর্ষকে গ্রাস করল কীভাবে? এই তত্ত্বজ্ঞানীরা কী মনুষ্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠ জীবনবােধের গ্রন্থ রামায়ণের একবারও একটি পাতাও উলটে দেখেননি। জানতেন না? যে রামচন্দ্র সর্বজীবের সর্বকালের আদর্শপুরুষ। প্রেরণা পুরুষ। ধর্মই তার বীরত্বের প্রকাশ।

তাই রামায়ণের রামরাজত্ব এক প্রাণবন্ত রাজ্য পরিচালনার ধারার প্রতীক। এতে সর্বকুলের সমৃদ্ধি। সকলের শান্তি। সকল প্রজারই আধ্যাত্মিক উন্নতি। রামায়ণে কৃষিক্ষেত্রগুলাের এমন সুন্দর বর্ণনা—এ যেন মনুষ্যকুলের আর্থিক উন্নতির সােপান। দেশ রক্ষার্থে শ্রীরামের প্রত্যক্ষযুদ্ধ অসুর ও রাক্ষসকুলের সঙ্গে, সামাজিক সুরক্ষার বিশিষ্ট ঘটনা—রাজাই প্রজাগণের রক্ষার প্রত্যক্ষ অধিকারী—আমলাতন্ত্র নয়।

পূর্ণ ব্রহ্ম শ্রীরামচন্দ্র আদর্শ পুত্র, আদর্শপতি, আদর্শ নৃপতি; তিনিই হিন্দুদের প্রাণপুরুষ পরমারাধ্য দেবতা। পবিত্র নিষ্ঠাবােধই শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি অযােধ্যাকে করেছে পুণ্যতীর্থ, ভক্তজনের পরম পবিত্র দর্শনীয় স্থান রূপে।

ভারতের পল্লীতে পল্লীতে গাওয়া রামায়ণ কাহিনির রামকে পৃথিবীর আপামর দেশ কীভাবে নিজের জীবনাদর্শরূপে গ্রহণ করল— তাতে বিস্মিত হতে হয়।সমগ্র পৃথিবী চেয়েছিল শ্রীরাম, লক্ষ্মণ, সীতার মতাে আদর্শ মানব-মানবী তাদেরও ঘরে জন্মগ্রহণ করুক। এই পৃথিবীতে পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম, পতি-পত্নীর প্রতি অকৃত্রিম ভালােবাসা, মাতৃভক্তি, বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ নিদর্শন, দেশপ্রেম, প্রজার প্রতি রাজার বাৎসল্য— যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই আজও রাশিয়াতে পাওয়া গিয়েছে রামচন্দ্রের জীবন অনুসারে বহু ভাস্কর্য ও চিত্র। রাম-রাবণের যুদ্ধের চিত্র যা আজও লেলিন গ্রাডের ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ অব ইউএসএসআর অ্যাকাডেমি অব সাইন্সেস-এ (: The Image of India, Progress Publishers, Moscow)।রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন রামায়ণ অন্তভুক্ত করা হলাে সেদিন ক্রুশ্চেভকে প্রশ্ন করা হলে ক্রুশেভ বলেছিলেন রাশিয়ায় রাম-লক্ষ্মণের মতাে ভাই, সীতার মতাে পত্নী পাওয়া গেলে দেশের নাগরিক জীবন ধারায় উন্নতি ঘটবে।

রামায়ণে বীর সুগ্রীব সীতার খোঁজে তাঁর অনুগামীদের যবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন। এই যবদ্বীপের বর্তমান নাম জাভা, সুমাত্রা ও বালি। সুমাত্রা, জাভা ও বালিতে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি নিয়েই তাদের শিক্ষাদর্শন। বালিতে সংস্কৃতিক জীবন ‘রামায়ণ’ ময়। পুতুলনাচ থেকে মানবীয় নৃত্যতে ঝংকৃত বালির সভ্যতা। তাদের বাড়িগুলাে মন্দিরের মতাে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সাংস্কৃতিক জীবনের বহমান ধারাই বলাে রামায়ণ। মঞ্চে অভিনীত সীতা, রাম-লক্ষ্মণ, রাবণ, শিব-দুর্গার অভিনয়ে জীবন্ত ভারত প্রকাশিত হয়ে উঠে ইন্দোনেশিয়া থেকে থাইল্যান্ড, শ্যাম-কম্বােজ থেকে যবদ্বীপে।

এই দেশগুলাের অনেকে ইসলামকে গ্রহণ করেছে কিন্তু শ্রীরামকে ক্ষণিকের তরেও ছাড়েনি। রামায়ণ কাহিনির এই নৃত্যগুলাের নাম সেমারায়ানা নৃত্য, তােপেং নৃত্য, তৃণা-জয়া নৃত্য, যুডাপতি (যুদ্ধাপতি) নৃত্য, ওয়ালি নৃত্য, চন্দ্রাংশী নৃত্য ইত্যাদি। আজও বালির উবুদে ও ডেনপাসারে রাজপ্রসাদের সামনে সন্ধ্যায় রামায়ণ নৃত্যানুষ্ঠান হয়। এই দ্বীপময় দেশে অজস্র ভ্রমণকারী যখন বিদেশ থেকে আসছেন তখন তারা রামায়ণ সংস্কৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে নিয়ে চলেছেন ভারতীয় সভ্যতা, হিন্দু শিল্প-সাহিত্যের অমর বার্তার বাণীবদ্ধ রূপ।

Field Museum of National History-60 সংরক্ষিত আছে রামায়ণে বর্ণিত বিভিন্ন ভাস্কর্য মূর্তি। বিশিষ্ট গবেষক। জুয়ান আর ফ্রান্সিসকো ফিলিপাইন্সের মুসলমান মারানাও বাসিন্দাদের। মধ্যে বহুকাল ধরে একটা রামায়ণ প্রচারিত হওয়ার কথা বলেছেন। এই ফিলিপাইনের অবতার বলে শ্রীরাম আজও পূজিত। রামা হরি’ মঞ্চে অ্যালিস রেইস নামে এক কোরিওগ্রাফারের পরিচালনায় মুসলমান যুবক যুবতীদের অংশগ্রহণে রামায়ণের ব্যালে নৃত্য আজও আকর্ষণীয়। তারাও জগতের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দিচ্ছেন রামায়ণের জীবনবােধ।

চীনে ‘রামকথা কী ব্যাপকভাবে প্রচলিত তার বিবরণ দিয়েছেন W.H.D. Rouse (Cambridge 1901) কত দেশে এই ভাবে জনজীবনে প্রকাশিত আছে শ্রীরামের মহান জীবনের কাহিনি।

বাল্মীকি-রামায়ণের পুরুষােত্তম নায়ক দশরথি রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন অযােধ্যায়। কোশল রাজ্যের রাজধানী ছিল অযােধ্যা। যুগ যুগ ধরে এই অযােধ্যায় বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামের জন্মস্থানে ভক্তিভরে পূজা-অর্চনা ও শ্রদ্ধা-প্রার্থনা নিবেদন করে আসছেন আপামর হিন্দুসমাজ। তখন ইসলামের আবির্ভাবও হয়নি সমগ্র বিশ্বে।

প্রাচীনকাল থেকেই অযােধ্যার বিবরণ দেওয়া আছে প্রাচীন গ্রন্ধগুলােতে।

অষ্টাচক্র নবদ্বারা দেবানাং পুরাযােধ্যা।

তস্মত্রং হিরণীয়ঃ কোন স্বর্গেী জ্যোতিষাবৃত॥

অথর্ববেদ : ১০।২।৩১। মূলাধার, নবদ্বারা অষ্টচক্র-সহ অযােধ্যাপুরীর ভিতর স্বর্ণময়। অযােধ্যাকে ব্রহ্মময়ী বৈকুণ্ঠধাম বলে অভিহিত করা হয়েছে। অযােধ্যা। অযােধ্যা কালের বিবর্তনে ও প্রশাসনিক ব্যবহারে শ্রীরামচন্দ্রের প্রাসাদ নিহিত ও সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। প্রতি কার্তিক মাসে অজস্র হিন্দু জণগণ চোদ্দক্রোশী ও পঞ্চদ্রোর্শী। পরিক্রমায় অযােধ্যাকে পরিক্রমণ করেন। কার্তিক পূর্ণিমায় এই পরিক্রমণের অর্থ শ্রীরামের জন্মভূমি অযােধ্যার রাজপ্রাসাদ ছিল চৌদ্দ ক্রোশ লম্বা ও পঞ্চ ক্রোশ চওড়া। অযােধ্যার রামকোটে রামচন্দ্র একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। দুর্গের চারিদিকে কুড়িটি বুরুজ ছিল, যার উপর উঠে সুগ্রীব, হনুমান, জাম্বুমান প্রভৃতি বীরেরা নগর রক্ষা করতেন। দুর্গের মধ্যে ৮টি রাজপ্রাসাদ ছিল।

সরযূর তীরে এই নগরী ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। অত্যন্ত সুদৃশ এই নগর। কুসুম বৃক্ষে সজ্জিত এর রাজপথগুলাে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। অসংখ্য তােরণ দ্বারা নগরীতে প্রবেশ করা যেত।

নারীর চারিপাশে ছিল পরিখা। অযােধ্যা সুউচ্চ নগরী ছিল যার জন্য এখানে প্রবেশ করে কেউ যােধ্যার ভূমিকা গ্রহণ করতে পারত না, তাই। এই নগরী ছিল অযােধ্যা। দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের সময় সমগ্র ভারতবর্ষের রাজারা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই বর্ণাঢ্য রূপের কথা কাল্মীকি দিয়েছেন।

রামচন্দ্রের তিরােধানের পর এই নগরীতে এই রামচন্দ্রের এক ভব্য মন্দির নির্মিত হয়। এই মন্দির বিষ্ণু হরি মন্দির নামেও পরিচিত ছিল।

বিশিষ্ট গবেষক ড. পি.ডি. বর্তক তিনি রামায়ণের উপর দীর্ঘকাল গবেষণা করেন। তার মতে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৭৩২৩-এর ৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। তিনি বনবাসে যান বৃহস্পতি, ২৯ নভেম্বর ৭৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এর ঠিক ছয়দিন পর অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর বুধবার দশরথ দেহত্যাগ করেন। রাবণের মৃত্যু হয়েছিল ১৫ নভেম্বর, রবিবার ৭২৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। রামচন্দ্র ৬ ডিসেম্বর অযােধ্যায় পুষ্পক রথে ফিরে আসেন।

সীতার গৃহাঙ্গণে প্রবেশ ঘটেছিল কুশের ১২ বছর বয়সে। এর পরেই কুশলবের সিংহাসন অভিষেক, ভাইদের পুত্রদের বিভিন্ন রাজ্যে অভিষেকের পর শ্রীরামচন্দ্র সরযূতে বহুজন সমেত সলিল সমাধি গ্রহণ করে স্বর্গারােহণ করেন। এই সব ঘটনার কাল প্রবাহ প্রায় ৩৫ বছর। অর্থাৎ রামচন্দ্রের প্রয়াণকাল ৭২৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অযােধ্যায় রামমন্দির হয় এর পরবর্তী কালেই। শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি মন্দিরের সংস্কার কাহিনিও বিশিষ্টতায় পূর্ণ। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতে রামচন্দ্রের রাজত্বের দীর্ঘকাল পর রাজা ঋষভ অযােধ্যায় রাজত্ব করেছিলেন। মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বেই ঋষভের রাজত্বকাল চলেছিল বলে মনে করা হয়। তার শাসনকালে অযােধ্যা নগরী আবার আলােয় আলােকিত হয়ে উঠে। ঋষভ রামমন্দিরে লক্ষ্মণ হনুমান প্রভৃতি মূর্তি স্থাপন করেন।

মহাভারতের যুদ্ধের পর ভারতবর্ষ নৃপতিহীন, শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এই সময়কালে রাজা পরীক্ষিৎ অযােধ্যারা দেখভাল করতেন। পরে যুগের প্রবাহে অযােধ্যা জঙ্গলে অকীর্ণ হয়ে পড়ে। অযােধ্যার সৌন্দর্য। প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সাতবাহনদের নরপতি বিক্রমাদিত্য উপাধিধারী এক সম্রাট প্রায় ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অযােধ্যা নগরীর সংস্কার । সাধন করেন। রামজন্মভূমি মন্দিরের পুনসংস্কার করেন। শুধু তাই নয় তিনি অযােধ্যাতে শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিকে আকর্ষণীয় করে অযােধ্যার শ্রীবৃদ্ধি করেন। মন্দিরে তিনি সীতা-রামের মূর্তি স্থাপন করেন।

বিক্রমাদিত্য পুষ্যমিত্র পুনরায় অযােধ্যায় জনজীবনকে সমৃদ্ধশালী করেন। রামচন্দ্রের অযােধ্যাকে তিনি দ্যুতিময় করে তােলেন। তিনি তার রাজধানীও অযােধ্যায় প্রতিষ্ঠিত করেন। হরপ্রসাদ রায়ের মতে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে পরবর্তীকালে অযােধ্যা নগরীকে আগের। মতাে নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতে হয়নি। গুপ্ত রাজত্বকালে দ্বিতীয়। চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সময় অযােধ্যা পুনরায় সংস্কারিত হয়। একটি সংস্কৃতের লিপি অনুসারে ২৪৩১ যুধিষ্ঠির সংবতের পৌষ মাসের দ্বিতীয়। অমাবস্যায় রাজা বিক্রমাদিত্য রামের মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করে রামসীতার Fiera pista postali (District Gazeetler Faizabad, 1960, p. 353)। রাজা বিক্রমাদিত্য অযােধ্যায় খনন কার্য শুরু করেন এবং রামচন্দ্রের রাজপুরীর সন্ধান পান। ক্রমে ক্রমে দশরথের চারপুত্র ও হনুমানের মুর্তি ঘােদিত ছিল। তিনি রামচন্দ্রের জন্মস্থান ও রাজপুরী। সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। এছাড়া তিনি অযােধ্যাকে গরিমাময় করে তােলার জন্য বহু মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দিরগুলির সংখ্যা প্রায়। ৩৬০।

স্তম্ভে যে মূর্তিগুলাে আছে এই মূর্তি স্মৃতি শাস্ত্র অনুসারে। শ্রীরামচন্দ্রের ধ্যানমূর্তি –অভিমত হরপ্রসাদ রায়ের। একটি ধ্যানের স্বরূপ— ‘অযােধ্যা নগরে রম্যে রত্ন সৌবর্ণ মণ্ডপে। মন্দার পুষ্পরাবদ্ধ বিতানে তােরান্বিতে সিংহাসন সমারাঢ়ং পুস্পাকোপরি রাঘবম।

পরবর্তীকালে দীর্ঘ বছর ধরে গাড়ােয়ালের নৃরতিরা অযােধ্যায়। শ্রীরামপুরীও রামচন্দ্রের সংস্কার সাধন করে এসেছিলেন।

ভারতবর্ষের এই ঐতিহ্যশালী মন্দিরকে বাবরের অযােধ্যা। অবস্থাকালে ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে তার সেনাপতি মীর বাকী এই মন্দির ধ্বংস করে একে মসজিদে পরিণত করলেন। এর প্রচলিত নাম দিলেন বাবরী মসজিদ।“Min Baqi of Tashkrint Perhaps a better epithet for saadat-nishan than good hearted’ would be one implying his good fortune in being designated to build a mosque on the site of the ancient Hindutemple.” (BaburNama Tr. by A.S. Beveridage, D.K. Publishers and Distributor P. Ltd. Delhi-52 1995, in the Chapter-U-‘The inscriptions on Babur’s Mosque in Ajodhya (Oudh) – Page-xxvii’) 1

ভারতবর্ষ রামচন্দ্রের এই ঐতিহ্যময় মন্দিরের বিলােপ সাধন মেনে নেননি। এই সময় ভীষণ যুদ্ধে প্রায় ১.৭৪ লক্ষ মানুষ প্রাণ বলিদান করেন। পরবর্তীতে মােগল আমলে মন্দির উদ্ধারের চেষ্টা হয় স্বামী মহশ্বেরানন্দের নেতৃত্বে। সংগ্রামীদের শপথ ছিল— ‘জন্মভূমি উদ্ধার করে যা দিন বৈরীভাগ ছাতাপগ পনহী ঔর ন বাঁধাই পাগ—যতদিন না। শত্রুজয় করে আমরা রামমন্দির মুক্ত করতে পারি ততদিন মাথায় ছাতা দেব না, জুতা পরব না পাগড়িও বাঁধব না। এমনকী হিন্দু মেয়েরা দল বেঁধে পুজো দিয়ে যেত ও তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতাে ‘জয়শ্রীরামন বাঁধা পাগ। হুমায়ুনের রাজত্বকালের ইতিহাসে এই মন্দির দখল ও পুনর্দখলের। আকবর তাে সংগ্রামীদের সন্তুষ্ট করতে রাম-সীতার মূর্তিখােদিত রৌপ্য মুদ্রা চালু করেন। নিকোশাে কান্তি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অযােধ্যায় দেবালয়ে হিন্দুদের পুজো অর্চনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। ইংরেজ আমলেও জন্মস্থান আখড়ার মােহন্ত রামকিশাের দাসের নেতৃত্বে লড়াই চলে। এই নিয়ে মামলা হলেও ১৮৮৫-তে বলা 267—“The place where the Hindus worship is in their possession from old and their owner she cannot be questioned.” এই মন্দির নিয়ে এত লড়াই কেন? হিন্দুদের বহু মন্দির ভেঙে এখনও মসজিদ অবস্থায় আছে, সেখানেতে এত সংঘর্ষ হয়নি। তার কারণ ভারতবর্ষের হিন্দুদের অস্মিতার প্রশ্ন স্বয়ং রামচন্দ্রের জন্মস্থানের মন্দিরের উপর। কারও অধিকার মানব না এই স্থানে।

রেনেসাঁসের অর্থ পুনর্জন্ম। এত সংঘর্ষের পর রাম জন্মভূমি রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলাে। এ শুধু জয় নয়— এই মন্দির হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস ও গৌরবের প্রতীক। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী। ভারতে রামায়ণেরপমহত্ত্ব। বিশাল। রামায়ণই যে যুগে যুগে ভারতীয় চিত্ত ও চরিত্রকে নিয়ন্ত্রিত ও রূপদান করেছে তা নয়, ভারতীয় চিত্ত কালে কালে নিজের প্রয়ােজন। মতাে রামায়ণকে নব নব রূপে গড়ে নিয়েছে। এই সত্যের ধারা সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রবাহিত হয়ে এসেছে এবং পূত সলিলা গঙ্গার স্রোতের মতােই ভারতীয় চিত্ত ভূমিকে চির শ্যামল করে রেখেছে। শ্রীরামচন্দ্রের জীবন কাহিনির এই উপাখ্যানই ভারতীয় রেনেসাঁস— ভারতের অস্মিতার নবজন্ম। কারণ মন্দিরের। অধিকার আজ ফিরে এসেছে।

ড. তুষার কান্তি ঘােষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.