রামমন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় অস্মিতার পুনর্জাগরণ

রাম, দুই, তিন, চার… আমার এক কাকা গুনতেন। এভাবে। ছেলেবেলায় নানান আয়ােজনে ছাত্র গােনা হতাে স্কুলে, পাড়ায়, ক্লাবে। যারা “রাম’ দিয়ে গােনা শুরু করতেন, সেখানে ‘রাম’ হয়ে নিজেকে গােনা হলে ভারী আনন্দ-অনুভূতি হতাে। তাই সারির সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম, সেটা যদি শীতকালের স্নানযাত্রা হতাে, তবুও। রাম’ মানে ‘এক’, এক তখনই বিশাল হয় যখন তা একমেবাদ্বিতীয়ম্রামের নামে উচ্চারিত হয়। ভারতের অনেক লােকায়ত মানুষ সংখ্যা গােনার ক্ষেত্রে এক শব্দ ব্যবহার না করে ‘রাম’শব্দটি ব্যবহার করতেন। একের যাবতীয় ক্ষুদ্রতাকে হারিয়ে দেয় ‘রাম’। শ্রীরাম একজনই হতে পারেন। রাম মর্যাদাপুরুষােত্তম। শ্রীরামকৃষ্ণ সব সময় ষােলােআনা বা এক টাকার হিসেবে আত্মনিবেদনের কথা বলতেন। এক বা রাম মানে অখণ্ড। রাম মানে পূর্ণ, রাম মানে ঐশী আনন্দরূপের অনবদ্য প্রকাশ।

ভারতের লােকায়ত সংস্কারে যেখানে এক ক্ষুদ্রত্ববাচক শব্দ, নিতান্তই শুরুর কথা, সেই শুরুর মাহাত্ম্যকেমহীয়ান করতে চেয়েছে ভারতবাসী। একলা চলার পথ রমণীয় করে তােলে রামবন্দনা। স্কুলের যে পাহারাদার রামুদা গুনগুন করে শ্রীরামের ভজন করতেন। আর রাতের নির্জনতা একলা পায়ে খানখান করে ভেঙে দিয়ে ঊষার আলােয় উদেঘাষিত করতেন, ‘শােনাে ওই রামা হৈ’, তাকে টীকাটিপ্পনীতে নাজেহাল করতাে সেই সময়ের শাসকদলের ছাত্র-যুবরা। তবুও একক গীত গেয়ে রামনামে মুখরিত করতেন রামুদা। রামনামকে অন্তরে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন মনসেবকরা, তারাও করসেবকের চাইতে কমতি নন। তাদের মনের মধ্যে অহরহ। রামশিলা পূর্জিত হতাে, তাকে ‘ইট’ আখ্যা দিয়ে কোনাে শাসক-মন্ত্রী মন থেকে বার করে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অনেক ব্যবসায়ী সারাদিনে বারবার হিসেবের কাজে সংখ্যা গােনেন এবং প্রতিবার গােনার ক্ষেত্রে ‘রাম উচ্চারণ করেন। দিনে বহুবার রামনাম করা হয়ে যায় এক সহজ সরল প্রচেষ্টায়। আবার কেউ কারণে-অকারণে ‘বাবর’ নামটি উচ্চারণ করেন। শঙ্খ ঘােষের নাম স্বভাবত অনেকের মুখে থেকে শােনা যায়। কারণ তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বাবরের প্রার্থনা। কেন যে তিনি কাব্যগ্রন্থের নাম দিলেন ‘বাবরের প্রার্থনা, শিক্ষকেরা পড়াতে গিয়ে হিমসিম!

হ্যা, তখন একটা সময় ছিল বটে! বাবর’, ‘বাবরি’, এইসব নামগুলি খুব প্রচার পেতাে! কাব্যে, কথা সাহিত্যে, বক্তৃতায় যে যত মুসলমান আসঙ্গ টানতে পারবেন, তিনি তত নামি সাহিত্যিক, নামি শিক্ষাবিদ, ততটাই সেকুলার। হয়তাে সেই সময়ের সাহিত্যিক অবদান ‘বাবরের প্রার্থনা। কাব্যগ্রন্থের জন্য লেখক পেয়ে গেলেন আকাদেমি পুরস্কার। কবি হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি, নামকরণের মধ্যে যথেষ্টমুনশিয়ানা ছিল তাঁর। গ্রন্থেরমণিকর্ণিকা’অংশের একটি কবিতা ‘বাবরের প্রার্থনা এবং তা দিয়েই গ্রন্থের নামকরণ হলাে। তাতেই কিস্তিমাত! গ্রান্থের আর কোথাও মুসলমান আসঙ্গ নেই। কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে- “এই তাে জানু পেতে বসেছি পশ্চিম/ আজ বসন্তের রুদ্ধদ্বার”, শুধু এইটুকুই মুসলমান আসঙ্গ।। বাকিটা পুরােটাই একজন অসুস্থ সন্তানের জন্য পিতার উদ্বেগ অথবা অসুস্থ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পূর্ববর্তী প্রজন্মের আক্ষেপ। বাবরের প্রার্থনার চতুর্থ পঙক্তি হলাে “ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” কোনাে মুসলমান আসঙ্গ যে কবির মনের মধ্যে ছিল না, তা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি প্রমাণ করে। এ পর্যন্ত পর্যুদস্ত সন্ততিকে দেখে অসহায় পূর্ববর্তী প্রজন্মই প্রকাশিত শঙ্খ ঘােষে। কিন্তু ছােট্ট, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা কাব্যগ্রন্থটির নামকরণে ব্যাপৃত রইল। কারও কারও মতে বিশেষত ‘বাবর’ নামটিকে ‘এনক্যাশ করলেন তিনি। কাব্যগ্রন্থে অন্য উপযুক্ত কবিতাও ছিল— ‘মহানিম গাছ’, ‘হাতেমতাই’ইত্যাদি। কিন্তু এই নামেই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করলেন, হাতে হাতে পুরস্কার পেলেন! সাতের দশকে জুটল আকাদেমি। কখনও আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। অলােকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বনফুল সবাইকে অতিক্রম করে গেলেন। কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ! তাই না! ‘বাবরের প্রার্থনা। কবি ঘােষেরও কী পুরস্কার প্রার্থনা?

কাউকে কাউকে বলতে শুনি যথার্থ ‘বুদ্ধিজীবী’তিনি। অথচ তাকে ছাড়তে হয়েছিল বংশানুক্রমিকভাবে পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামের বাস। বাংলাদেশের বর্তমান চঁাদপুরে জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি, বড়াে হয়েছিলেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল পাবনায় অবস্থান করেছিলেন, সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। তারপর চলে এলেন কেন ভারতে?

অযােধ্যায় তাে রামমন্দিরই ছিল আগে। যথাযথ ঐতিহাসিক বিচার করে রামমন্দির করাই বাঞ্ছনীয় এবং তা হয়েছে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারে। মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে রাম কে তা বিচার্য নয়। ইতিহাসের বিচার্য সেখানে রামমন্দির ছিল কিনা। খনন কার্যে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রমাণিত হয়েছে বিতর্কিত কাঠামাের নীচে মন্দির সৌধ ছিল। যে ইতিহাসবেত্তারা গবেষণা শুরুর আগেই তার প্রতিপাদ্য বিষয় বলে দেন বা বলে দিতে পারেন, তারা আর যাই হন, ইতিহাসবেত্তা নন। তাদের গল্পগাছার সম্রাট বলা যেতে পারে বলে তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

এবার প্রশ্ন আসবে ‘রাম’ অবতার না মহাপুরুষ? রাম ঐতিহাসিক না পৌরাণিক ?

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপােলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে অযােধ্যার ভূমিপুজোর প্রসাদ তুলে দেওয়া হলাে বাংলাদেশের ওড়াকান্দিধাম থেকে আসা মতুয়া মিশনের মিন্টু বালার হাতে। তুলে দিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পূর্বক্ষেত্রের সম্পাদক অমিয় সরকার ও অন্যান্য কার্যকর্তারা।

‘পুরাণ’ মানে হলাে অতি-প্রত্ন, পুরাণ’ মানে হলাে পুরনাে। রাম ঐতিহাসিক নন, প্রাগৈতিহাসিক। প্রাগৈতিহাসিক বিষয় সেটাই, যা ইতিহাসবেত্তাদের আবিষ্কারের পরিসীমার বাইরে। আর্য সভ্যতার (জাতিবাচক নয়, গুণবাচক) অনেক কিছুই প্রতিভাত নয়, কিছু দাপানাে ইতিহাসবেত্তাদের জ্ঞানের বাইরে, তার মানে এটা প্রমাণিত হয় না, এটার অস্তিত্ব নেই। কারও জ্ঞানের সীমানার বাইরে তিনি ইতিহাসের নামে জোরজুলুম চালাতে পারেন না। রামায়ণ সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে বলেই না রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয়, কবি, তব মনােভূমি রামের জন্মস্থান, অযােধ্যার চেয়ে সত্য জেনাে। যে অযােধ্যায় যুগ যুগ ধরে মানুষ শ্রীরামের নামে পূজন করে এসেছে, যে অযােধ্যার সরযু নদীতে অবগাহন করাটা পবিত্র কৃত্য বলে মেনে এসেছে, সেখানে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নামে বিদেশি শাসকের উচিত হয়নি, তা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া। যা হয়েছে তার জন্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা না করে বুদ্ধিজীবী তাকে মহিমান্বিত করার অপচেষ্টা করছেন। শ্রীরাম পূজনীয় চরিত্র ছিলেন, তিনি পূজিত হতেন ভারতবাসীর দ্বারা। অযােধ্যায় এমন দেবালয় ছিল। সেজন্যই ওই মন্দিরটি থাকবে। হিন্দুর হাজারাে মন্দির লুণ্ঠন হয়েছে, হাজারাে দেবালয় ভাঙা হয়েছে, এটা ইতিহাস। মন্দির বদলে অন্য ধর্মের উপাসনালয় হয়েছে।

অনেকে বলেন, ইতিহাস যেটা ঘটে গেছে, সেটা সংরক্ষণ করা উচিত। বিতর্কিত সৌধকে সেজন্যই সংরক্ষিত করা উচিত ছিল। এখন যে কোনাে দেশের গৌরবান্বিত অধিবাসী নিজের রাষ্ট্রের গৌরব গাথার কথা বলতে চান, নিজস্ব ঐতিহ্যের অধিকারী বলে নিজেকে বিবেচনা করতে চান, সমস্ত রাষ্ট্রের চাইতে নিজের রাষ্ট্রকে অগ্রগামী করে তুলতে চান, তার মধ্যে স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বই প্রকাশিত হয়, এরই নাম স্বদেশী জাগরণ, এরই নাম জাতীয় অস্মিতা। শত শত বছরের ভাঙন ও পীড়নের ইতিহাস কখনও কোনাে জাতির অস্মিতা হতে পারে না। ভারতবর্ষের মানুষ চেষ্টা করেছে, ভারতভূমের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। যে জায়গাটা চাপা পড়ে গেছে, তা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে, এই স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব বাধা দেওয়ার নয়, যেখানে আইনি খুঁটিনাটি বিচার করেই দীর্ঘ সময়ের পর একটি রায় এসেছে। কোনাে সভ্যতা যদি বারে বারে ধ্বংস হয়, বার বারই আবার গড়ে ওঠে, ঐতিহ্য বার বার ফিরিয়ে আনা হয়, তার মধ্যে অন্যায় কোথায় ? রামমন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতবাসী ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ করেছে। রিফর্মিং বলা যায় একে। এটা ভারতবাসীর দিক থেকে এক স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক আচরণ। ভারতবাসী চেষ্টা করবে দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরার। সুপ্রিম কোর্টের অত্যন্ত ভাবনাচিন্তার ফসল রামমন্দির সংক্রান্ত রায়দান। তাছাড়া সমপরিমাণ জমি তাে সেখানেই অন্যত্র দেবার কথা বলেছে। পৃথিবীবাসীর কাছে ভারতবাসীর জানানাের বিষয় এটাই। অযােধ্যায় একটি রামমন্দির ছিল, তা ভেঙে ফেলেছিল বিদেশি শাসকের রক্তচক্ষু, আবার তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে, এরমধ্যে গর্হিত অপরাধ কোথায় ?

ভারতবাসী তাে ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়ালের মতাে ব্রিটিশ সৌধকে ভেঙে কোনাে সৌধ নির্মাণ করেনি। এই রকম অনেক ব্রিটিশ সৌধই তাে গড়ে উঠেছে। কারণ এই ধরনের সৌধ কোনাে হিন্দুধর্মের সৌধকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নির্মাণ করা হয়নি। যেখানে যেখানে মন্দির ছিল, সেখানে সেখানে তা গুঁড়িয়ে মসজিদ তােলা কী গর্হিত কাজ নয় ?নিশ্চয়ই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আপন ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।কিন্তু কখনােইশাসক অস্ত্রের জোরে শাসিতের ঐতিহ্য ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তােমারে পশ্চাতে টানিছে। কোনাে বিদেশি শাসক যদি আগ্রাসন করে থাকেন, তবে পরবর্তী মানুষ তা সংশােধন করতে পারবেন না কেন? ইতিহাসের ভুলের কী সংশােধন হবে না? দেশবাসীর অপমানের জায়গাটার প্রতিশােধ এবং প্রতিকারের জায়গাটি হলাে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ। তখনকার অপমানিত মানুষ যা করতে পারেননি, চুপ করে মুখ বুজে থাকতে বাধ্য ছিলেন, আজকে তা আইন মেনে করাতে পারলেন। রামমন্দিরের ভূমিপূজন তাই দেশবাসীর দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.