সরকারি ক্ষমতা হাতে পেয়ে যাঁরা হিন্দুর সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন তারা যেন মনে রাখেন সমস্ত অশুভ শক্তির অবসান ঘটিয়ে এখানে একদিন রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে।
প্রত্যাশা মতোই সমস্ত ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে নির্ধারিত দিন এবং সময়ে রামমন্দিরের ভূমিপুজো ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাই ৫ আগস্ট ২০২০ তারিখটি ভারতীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বাবরের আমলে শুরু হওয়া পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে অগণিত সাধু-সন্ত ও রামভক্তদের ৫০০ বছরের লড়াইয়ের শেষে ভগবান শ্রীরামের মন্দির তৈরির সূচনা হলো। এর সঙ্গে শুরু হলো মহাকবি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের রামেরই বিজয় যাত্রা।
আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়া গ্রামের কৃত্তিবাস মুখোপাধ্যায় (ওঝ) ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি।
আনুমানিক ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন তিনি। সেই রামচন্দ্র সম্পর্কে পরবর্তীতে কে কী বলেছেন তা জানতে হলে আমাদের পিছন ফিরে দেখতে হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ মাদ্রাজে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, এই প্রাচীন বীরযুগের আদর্শপরায়ণতা ও নীতির সাকার মূর্তি — আদর্শ পতি, আদর্শ পুত্র, আদর্শ ভ্রাতা, সর্বোপরি আদর্শ রাজা রামচন্দ্রের চরিত্র অঙ্কন করিয়া মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের সম্মুখে স্থাপন করিয়াছেন।
অন্তত্য ছোটো বয়স থেকেই রামায়ণ ও ভগবান রামচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের জীবনে কবিসত্তায় প্রভাব ফেলেছিল। তারই প্রমাণ আমরা পাই তাঁর কবিতার মাধ্যমে। বাবা যদি রামের মতো পাঠান আমায় বনে, যেতে আমি পারিনাকো তুমি ভাবছ মনে? কিন্তু আমি পারি যেতে ভয় করিনা তাতে/ লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। রামচন্দ্রের প্রভাব আরও পাওয়া যায় কবির ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে, ‘ছেলেবেলা’ প্রবন্ধে, শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে, গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ বা ‘কালমৃগয়া’ গ্রন্থে। রবীন্দ্র ভাবনায় সর্বত্র রামায়ণের ছাপ।
কাজি নজরুল ইসলামের একাধিক গানে-কবিতায় উঠে এসেছেন মর্যাদা পুরুষোত্তম। শ্রীরামচন্দ্র। বিদ্রোহী কবির ভাষায়, ‘অবতার শ্রীরামচন্দ্র, যে জানকিপতি/ তারও হলো বনবাস, রাবণ করে দুর্গতি।
এস ওয়াজেদ আলির বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ভারতবর্ষ। তাতে তিনি লিখেছেন‘একজন যুবক মুদি দোকানের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার বৃদ্ধা মাকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠ করে শোনাচ্ছে, সেই যুবকের স্ত্রী তার কোলের ছেলেকে নিয়ে গৃহকার্যের মাঝে এসে পাশে বসে রামায়ণ শুনছে, আবার উঠে যাচ্ছে। লেখক বহু বছর পর এসে দেখলেন অবিকল সেই দৃশ্য। সেই যুবক মুদি, বৃদ্ধা মা, ছেলে কোলে গৃহবধু আর সেই কৃত্তিবাসী রামায়ণের বইটি পাঠ করা হচ্ছে। লেখক প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। শেষে বুঝলেন, সেদিনের কোলের শিশু আজকের যুবক মুদি, সেদিনের তরুণী বধুই আজকের বৃদ্ধা, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
গান্ধীজী স্বয়ং রামরাজ্যের কথা বলেছেন। তিনি যে বিখ্যাত ভজনটি গাইতেন, তা হলো— “রঘুপতি রাঘব রাজারাম, পতিত পাবন সীতারাম। সুন্দর বিগ্রহ মেঘশ্যাম, গঙ্গা তুলসীশালীগ্রাম। ভদ্র গিরিশ্বর সীতারাম, জগ-জনপ্রিয় সীতরাম। জানকী-রমণী সীতরাম, জয় জয় রাঘব সীতারাম।
বর্তমানে বিজেপি বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক বা রাজনীতির আঙ্গিনায় টিকে থাকার লোভেই হোক রামের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। যেমন, ইতিপূর্বে সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মন্তব্য করেছিলেন, কেরলে আমরা রামগান শুরু করেছি এবং রামসপ্তাহ পালন করা হবে।
অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাসের আগের দিন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী (বঢ়ড়া) বলেছেন— ‘ভূমিপুজো জাতীয় ঐক্যের উৎসব হয়ে উঠুক। সরলতা, সাহস, সংযম, ত্যাগ এবং প্রতিজ্ঞা ছিল দীনবন্ধু রামের মূলকথা। ভগবান শ্রীরাম সবার সঙ্গে রয়েছেন। আশা করি এই ভূমি পুজো। জাতীয় ঐক্য ও সংস্কৃতিকে আরও দৃঢ় করবে।
মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা মধ্যপ্রদেশের বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি কমলনাথ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন—“মন্দির তৈরির জন্য তারা অযোধ্যায় ১১টি রুপোর হঁট পাঠাবেন। এছাড়াও সোমবার কংগ্রেসের অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের নিয়ে তিনি ভোপালের বাড়িতে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ উপলক্ষ্যে হনুমান চালিশা পাঠ করেছেন।
অথচ এ রাজ্যে ইতিপূর্বে শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে গেছে তা স্মরণ করতে যেমন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে তেমনি ঘৃণা জন্মে। তা হলো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং গাড়ি থেকে নেমে তেড়ে যান শ্রীরামের নামে জয়ধ্বনি দেওয়া যুবকের দিকে। উপরন্তু রকের ভাষা ব্যবহার করেন সেই যুবকের প্রতি, যা মুখ্যমন্ত্রীর পদের সঙ্গে বড়োই বেমানান। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, কোনো
এক সম্প্রদায়কে খুশি করার জন্য তিনি ইচ্ছা করে অযোধ্যায় ভূমিপুজোর দিনকে রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করেছেন। আগস্ট মাসের লকডাউনের দিনগুলি মুসলমানদের সুবিধার্থে চারবার বদল করা হয়েছে। কিন্তু বিজেপি দলের অনুরোধ সত্ত্বেও পাঁচ আগস্ট দিনটিকে লকডাউনের বাইরে রাখা হয়নি। পাঁচ আগস্ট টিভি নিউজে আরও দেখা গেছে মেদিনীপুরে ভগবান শ্রীরামের ছবি সংবলিত ফ্লেক্স কে বা কারা ছিড়ে মাটিতে ফেলে রেখেছে। এ সম্পর্কে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন—বিজেপির বিরোধিতা করতে গিয়ে এ রাজ্যে যেভাবে হিন্দু এবং হিন্দুধর্মের বিরোধিতা শুরু হয়েছে তা সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে হতে পারে। যদি সত্যিই তা হয় তাহলে আগামীদিনে মুখ্যমন্ত্রীকে হয়তো বড়োরকমের মূল্য চোকাতে হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গ আজ এক চরম অরাজকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আইনের ক্ষমতাকে বেআইনিভাবে শুধু শান্তিপ্রিয় হিন্দুদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ জেহাদি, দাঙ্গাবাজরা এ রাজ্যে সরকারি প্রশ্রয়ে একের পর এক জেহাদি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে আজ এ রাজ্যে হিন্দুর অস্তিত্ব বিপন্ন। স্বাধীনতার পরে এরকম হিন্দু-বিদ্বেষী সরকার এর আগে আর আসেনি। সরকারি ক্ষমতা হাতে পেয়ে যাঁরা হিন্দুর সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন তাঁরা যেন মনে রাখেন অশুভ শক্তির অবসান ঘটিয়ে এখানে একদিন রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবেই হবে। রামমন্দিরের ভূমিপূজা বিরোধী রাজনীতিতে শেষ পেরেক পুঁতে দিল।
মণীন্দ্রনাথ সাহা