রামায়ণ ও শ্রীরামচন্দ্রের সমালোচকদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি মহার্ঘ্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন—“স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কীরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যত বড়ো সমালোচকই হইনা কেন, একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস প্রবাহিত সমস্ত কাজের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত না হয়, তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়।” রামায়ণ এবং রামচন্দ্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে অপরিসীম শ্রদ্ধা, এই বাক্যে তাই পরিস্ফুট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে নিছক একটি এপিক হিসেবে দেখতে চাননি কখনো। বরং রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, এপিক হিসেবে দেখলে রামায়ণের যে ব্যক্তি তাকেই খর্ব করা হয়। যে কারণে বলছেন, ‘আধুনিক কোনো কাব্যের মধ্যেই এমন ব্যাপকতা দেখা যায় না। মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট-এর ভাষার গাম্ভীর্য, ছন্দের মাহাত্ম্য, রসের গভীরতা যতই থাক না কেন, তথাপি তাহা দেশের ধন নহে— তাহা লাইব্রেরির আদরের সামগ্রী। রামায়ণকে কিন্তু লাইব্রেরির সামগ্রী নয়, দেশের ধন হিসেবে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের কাছে রামায়ণ এক ইতিহাস। এই ইতিহাস কোনো সময় বিশেষের ঘটনাবলীর ইতিহাস নয়। অন্য ইতিহাস কালে কালে কত পরিবর্তন হয়েছে এ ইতিহাসের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ইতিহাস চিরকালীন এবং শাশ্বত। কেন? রবীন্দ্রনাথ বলছেন— ‘ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহাসংকল্প, তাহারইইতিহাস। এই দুই বিপুল কাব্যরহস্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান। বলেছেন, মানুষেরই চরম আদর্শ স্থাপনের জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন এবং সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই। আদর্শরচিত বর্ণনা ভারতের পাঠকমণ্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছেন।
রামায়ণ ভারতের চিরকালীন আদর্শবোধের বর্ণনা করেছে। এবং শ্রীরামচরিত্রের মাধ্যমে এই আদর্শের শিক্ষা দিয়েছে। চিরকালীন আদর্শবোধের কথা বলেছে বলেই রামায়ণ সময় বিশেষের নয়, বরং কালোত্তীর্ণ হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্রও মর্যাদাপুরুষোত্তমের আসনে আসীন হয়েছেন এই চিরকালীন শাশ্বত আদর্শবোধকে নিজের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট করতে পেরেছেন বলেই। শ্রীরামচরিত্র ও রামায়ণ থেকে কী শিক্ষা পেয়েছি আমরা? যদি রামায়ণ কেউ ভালোভাবে অনুধাবন করে থাকেন তো দেখবেন, এক নয়, রামায়ণ ও তার প্রধান চরিত্র আমাদের একাধিক শিক্ষা দিয়েছেন। শ্রীরামচন্দ্র সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি দিয়েছেন, তা হলো জাতীয়তাবোধ। দেশমাতৃকার প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা। অরণ্যে রাক্ষসদের উৎপাত বন্ধ করতে এবং তাদের দমন করতে কিশোর রাম ও লক্ষ্মণকে ঋষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে কি শুধুই রাক্ষসবধের জন্য? তা তো নয়। রামায়ণ পাঠে আমরা দেখতে পাই, এই দেশের সঙ্গে, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে, অধিবাসীদের সঙ্গে, সমাজ জীবনের সঙ্গে, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বামিত্রের। বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণ চলেছেন অরণ্যে। এই যাত্রাপথে বিশ্বামিত্র একের পর এক রাজ্য চেনাচ্ছেন। রামকে। সেইসব রাজ্যের ঐতিহ্য, সমাজজীবন, প্রাকৃতিক গড়ন, শস্য,। রাষ্ট্রনীতি— সবই উঠে আসছে বিশ্বামিত্রের বর্ণনায়। মুগ্ধ শ্রোতা রাম চিনে নিচ্ছেন এই সুবিশাল ভারতবর্ষকে। তার ফলশ্রুতি কী? লঙ্কা বিজয়ের পর যখন স্বর্ণলঙ্কার রূপে মুগ্ধ লক্ষ্মণ সেখানেই থেকে যেতে চাইছেন, তখনই রামচন্দ্র তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ‘জননী। জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী। জাতীয়তাবোধের এই মহান বাণী ভারতবর্ষ কেন, আর কোনো দেশের কাব্যেই ধ্বনিত হয়নি।
রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র চরিত্রের ভিতর দিয়েই আমরা প্রজাকল্পে নিজের সুখ এবং আনন্দ বিসর্জন দেওয়া এক নৃপতিকে খুঁজে পাই। রামচন্দ্র নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে, কঠিন জীবনযাপন করে, স্ত্রী বিচ্ছেদ সহ্য করে, অশুভকে বিনাশ করে ফিরেছেন অযোধ্যায়। তখন প্রজাপালন তার কাছে মুখ্য কর্তব্য। এই পর্বে অযোধ্যায় তার প্রজারা যখন সীতাদেবী সম্পর্কে সন্দিহান হচ্ছেন, তখন প্রজাকল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রাখতে গিয়ে নিজের সুখ এবং আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে স্ত্রী সীতাকে আবার ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন নৃপতি রামচন্দ্র। রামচন্দ্র একজন পরাক্রমশালী নৃপতি হিসেবে প্রজাদের মনোভাবকে গুরুত্ব না দিতেই পারতেন। অবজ্ঞা করতে পারতেন অযোধ্যার প্রজাদের দাবি। কিন্তু তাতে অযোধ্যায় প্রজা বিদ্রোহ হতো। বিনষ্ট হতো অযোধ্যায়। সুখ-শান্তি। শ্রীরামচন্দ্রের কাছে তাই নিজ সুখ এবং আনন্দের থেকেও বড়ো হয়েছিল প্রজার কল্প। ভগবান বুদ্ধ আত্মমুক্তি কল্পে স্বীয় স্ত্রীকে। ত্যাগ করেছিলেন। রামচন্দ্র স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিলেন প্রজাকল্পে। রামায়ণের দৃঢ় সমালোচকরা এটি বুঝতে চান না। কিন্তু নিজের স্ত্রীর প্রতি কি রামচন্দ্রের ভালোবাসা কমে গিয়েছিল কোথাও ? একেবারেই না। প্রজাকল্পে স্ত্রীকে ত্যাগ করে মনোকষ্টে দিন কাটিয়েছেন রাজা রাম। সীতার অনুপস্থিতিতে স্বর্ণসীতামূর্তি প্রতিষ্ঠা করে রাজ্য শাসন করেছেন। সীতার পাতাল প্রবেশের পর সরযূ নদীর জলে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে রামচন্দ্র এবং তার তিন ভ্রাতার চরিত্রের একটি বিশেষ দিকের প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে। প্রাচীন ভারতে বহু বলবীর্যশালী নৃপতিরই বহুবিবাহ ছিল। বহুগামিতায় অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা। স্বয়ং রাজা দশরথেরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু রামচন্দ্র এবং তার তিন ভ্রাতা কারোরই বহুবিবাহ ছিল না। কেউই বহুগামিতায় অভ্যস্তও ছিলেন না। রামায়ণের মাধ্যমে শ্রীরামচন্দ্র চরিত্র বৃহত্তর ভারতীয় সমাজগঠনের শিক্ষাটিও দিয়ে গেছেন। বনবাসকালে রামচন্দ্র বনবাসী-গিরিবাসীমূলনিবাসীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছেন। ভালোবাসা দিয়ে তাদের হৃদয় জয় করেছেন। আশ্রয় গ্রহণ করছেন অরণ্যবাসী রাজা গুহকের, শবরীকে ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছেন, আবার লঙ্কা অভিযানে তার সঙ্গী হচ্ছেন বনবাসী-গিরিবাসী মূলনিবাসীর। মনে রাখতে হবে, কোনো রাজানুগ্রহ দিয়ে নয়। রামচন্দ্র এদের হৃদয় জয় করছেন ভালোবাসা দিচ্ছেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র ভারতকে একসূত্রে গ্রথিত করছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়েছে। পিতা-পুত্রে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি ভক্তির সম্মান, রামায়ণ তাহাই এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গার্হস্থ্য আশ্রম অতি উচ্চস্থান অধিকার করেছিল। প্রাচীন ভারতের গাৰ্হস্থাশ্রম অতি উচ্চ স্থান অধিকার করেছিল। প্রাচীন ভারতের গাৰ্হস্থাশ্রমের শিক্ষা দেওয়া হতো। তা কখনই ব্যক্তিগত সুখ ও সুবিধার লক্ষ্যে ছিল না। বরং সমষ্টির সুখ, সমষ্টির কল্যাণ, সমষ্টির সমৃদ্ধি শিক্ষাই সেই গার্হস্থাশ্রমের শিক্ষা ছিল। রামায়ণ সেই আদর্শ গার্হস্থাশ্রমের শিক্ষাই দিয়েছে আমাদের। পিতৃসত্য রক্ষার্থে রামচন্দ্র বনবাসে গিয়েছিলেন। পিতার প্রতিশ্রুতি পুত্রকে রক্ষা করতে হবে কেন- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি অযোধ্যার সিংহাসন দখল করেননি। বরং নিঃশর্তভাবে পিতার প্রতি আনুগত্য পালনে এগিয়ে এসেছিলেন। ভ্রাতৃপ্রেমের নিদর্শনও আমরা পাই রামায়ণে। কৈকেয়ী চেয়েছিলেন, রাম বনবাসে গেলে ভরত অযোধ্যার রাজ্যপাটে বসুন। সে সুযোগ ভরতের সামনে ছিলও। তবু ভরত সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। বরং রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয় করে ফিরে আসা পর্যন্ত নন্দীগ্রামে রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্য পরিচালনা করেছেন ভরত। তেমনই লক্ষ্মণ। রামের অনুগত হয়ে চোদ্দ বছরের অনিশ্চিত বনবাসের জীবন বেছে নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না তাঁর। তবু নিয়েছিলেন। এবং তা নিছক ভ্রাতৃপ্রেমেরই টানে। এই বনবাসের দিনগুলিতে রামচন্দ্রও কিন্তু পিতার স্নেহে আগলে রেখেছিলেন ভ্রাতা লক্ষ্মণকে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রামায়ণ সেই অখণ্ড অমৃতপিপাসুদেরই চিরপরিচয় বহন করিতেছে। ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, যে সত্যপরায়ণতা, যে পাতিব্ৰত্য, যে প্রভুভক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহার প্রতি যদি সরল শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভক্তি রক্ষা করিতে পারি, তবে আমাদের কারখানা ঘরের বাতায়ন মধ্যে মহাসমুদ্রের নির্মল বায়ু প্রবেশের পথ পাইবে। রামায়ণে বর্ণিত এই চিরকালীন আদর্শেরই প্রতীক শ্রীরামচন্দ্র। অযোধ্যায় যে রামমন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছে, সেই মন্দির নিছক উপাসনাস্থল নয়। সেই রামমন্দির চিরকালীন ভারতীয় আদর্শের প্রতীক।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত