পুরাণ ও সাহিত্য ভিন্ন স্তরে কাজ করে। অধ্যাপক ক্লদ লেভি স্ট্রাউস লিখেছিলেন, অতি ভালো অনুবাদকের হস্তক্ষেপেও কবিতার রস ঠিক থাকে না। অন্য দিকে অত্যন্ত খারাপ করে বললেও পুরাণের আখ্যান কিছু না কিছু বার্তা বহন করে শ্রোতাদের মনে আবেশ সঞ্চার। করে। এর কারণ বিচার করেছেন লেভি স্ট্রাউস, কবিতা মানব সভ্যতার যে স্তরে নির্মিত হয়, পুরাণ সেই স্তরের সৃষ্টি নয়। ভারতে পুরাণ মহাকাব্য একাকার। দুটিই ধর্ম পালনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। পৃথিবীর অন্যত্র এমন নেই। ফলে আমাদের দেশে পুরাণপ্রবাহ জীবন্ত।
কথাগুলি মনে এল বর্তমান করোনা-কালে গৃহবন্দি পরিস্থিতিতে দূরদর্শনে প্রচারিত রামায়ণ ও মহাভারতের ব্যাপক জন সমর্থন। অনেক তথ্যাভিজ্ঞ মহল জানাচ্ছেন— এটা একটা বিশ্বরেকর্ড। ভারতের আত্মা এই তথ্যের মাধ্যমে স্পষ্ট জলছাপ নিয়ে এসেছে। কেন রামায়ণ ও মহাভারত এতো জনপ্রিয় হলো? সাধারণভাবে কিছু কারণ পাওয়া সম্ভব।
ওখন পর্যন্ত অতিমারী করোনার কোনো নিরাময় পাওয়া যায়নি। আমরা সমগ্র বিশ্ব এর সঙ্গে যুদ্ধে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি। বিজ্ঞানের কাছে আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। বিজ্ঞান এতদিন এইরকম জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব উৎসাহ দেখায়নি। এ অবশ্য অভিযোগ নয়। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান রাজনীতি ও অর্থনীতির অধীন। বিজ্ঞান-গবেষণা অদৃশ্য মারণ জীবাণু তৈরি করতে পারে কিন্তু সেই মারণাস্ত্র সংবরণের উপায় তার আজও অনায়। ফলে বিশ্বব্যাপী ভয় ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞান যেখানে নিশ্চপ বা অপেক্ষাতুর—তখন মানুষ আত্মরক্ষার অনভ্যস্ত উপায় অবলম্বন করছে। পৃথিবীর অন্য দেশের মতো নয়, আমাদের দেশের মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো অবস্থাতেই নেই। দরিদ্র তারা, খেটে খাওয়া মানুষ। অতিরিক্ত ঘর বিছানা কি তাদের আছে? এ অবস্থায় আধ্যাত্মিক নিরাময় ছাড়া উপায় নেই। তাই কি এই ব্যাপক গণ মানুষের সমর্থনে রামায়ণ ও মহাভারত পুনঃ প্রকাশের এমন অদ্ভুত বিশ্বরেকর্ড সম্ভব হলো?
এভাবে ভাবলে বলতে হবে সরকার দেশবাসীকে ধর্মের দিকে আকর্ষণ করতে চাইছে। এই কথাই বলেছেন বিরোধী দলের আইনজীবীরা। এসব কেঠো, মেঠো যুক্তি ছেড়ে অন্য কিছু কথার দিকে দৃষ্টি ফেলতে হবে। এস ওয়াজেদ আলীর গল্পটি আমরা সবাই এক সময় পড়েছি। লেখক এক গ্রামবাসী মুদিকে দেখেছিলেন, তার নাতিকে রামায়ণের গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন। বহুদিন পর সেই গ্রামে। তিনি একই দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন! একই ভঙ্গিতে মুদি তার নাতিকে রামায়ণ শোনাচ্ছেন। একই ছবি কীভাবে ফিরে এল ? খবর নিয়ে জানলেন, ইনি সেই মুদির উত্তরপুরুষ। উক্ত ভদ্রলোক আগে দেখা মানুষটির বংশধর। আগের মানুষটি এখন বেঁচে নেই! মন্তব্য করেছিলেন এস ওয়াজেদ আলী ‘সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে—কোথাও কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। গল্পের নাম ‘ভারতবর্ষ। সেটা জানা না থাকলে এই আখ্যানের তাৎপর্য বোঝা যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ পরিব্রাজক প্রবন্ধে লিখেছেন, ভারতবর্ষে যা আছে তা থেকে যায়। এই আকর্ষণমূলক সংস্কার ও জীবনবোধ এদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একে কেউ কেউ ভারতের প্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলে সমালোচনা করেন। তারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলেন, তাদের কাছে ধর্ম ‘আফিম’ (কেননা সেটা তাদের বিদেশি গুরুঠাকুররা বলে গেছেন!), আর সেজন্যই রামায়ণ-মহাভারত বর্জনীয়। এদের জনবিচ্ছিন্নতা সীমাহীন। তা না হলে এই গৃহবন্দি অবস্থাতেও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তারা সর্বোচ্চ বিচারালয়ে উপস্থিত হতেন না।
রামায়ণ ও মহাভারত আমাদের দুই সর্বজনমান্য অবতারের জীবন ও কর্মানুষ্ঠানের বিবরণ। এ কাহিনি ভারতের সাধারণ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে জনেন। এ কাহিনি পিতৃ-পিতামহের কাছ থেকে আমরা শুনি, মনে রাখি। পরের প্রজন্মকে শেখাই। ঘরবন্দি পরিস্থিতিতে দূরদর্শন সেই কাহিনিই আবার শোনাচ্ছে—ভারতবাসীদেখছে।
নাট্যকার বেটোল্ড ব্ৰেণ্ট একটি তত্ত্ব। দিয়েছিলেন— ‘Epic Eliment. তার তত্ত্বটি নাট্যশাস্ত্রে অভিমত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি থেকে নির্বাসিত এই নাট্যকার মনে করতেন, নাটক তো মানুষের কৌতুহল মোচন করে। কোন কৌতূহল? মানুষ তো জানে জীবনে তেমন কোনো কৌতূহল অবশিষ্ট নেই। অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র-অসহায়। তারা কি জানেন না দারিদ্র্য অসহায়তার ছাড়া কিছুই নেই—এটা জানা কথা।তবে নাট্যকার কী করবে? ব্রেশটের মতে মানুষের কাছে নাটক যা হয়েছে তাকে বলে —যা হয়েছে তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে চায়। এটাই, তার মতে মহাকাব্যিক উপাদান। তার তত্ত্ব কাঠামোতে একেই বলে ‘Eipic Theatre’l
মহাভারতের কথাই ধরুন। যুদ্ধকালের বর্ণনায় বার বার সঞ্জয় বলছেন, ধৃতরাষ্ট্র শুনছেন। কর্ণ নিহত হলেন! সঞ্জয়ের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র জানতে চাইলেন—সে কী ? কীভাবে বীরশ্রেষ্ঠ সূর্যপুত্র কর্ণের মৃত্যু হলো? সঞ্জয় বলে গেলেন। সাধারণ নাটক সাহিত্য। তা ক্রমে ক্রমে পরিণতির দিকে যাত্রা করে। মহাকাব্য পাঠক দর্শক জানেন—এরপর কী হবে। জানেন ‘যথাধর্ম তথা জয়। কিন্তু সেই জানা কথাগুলিই ফিরে ফিরে শুনতে বুঝতে চান তারা। ভারতবাসীর এই প্রবণতা চিরন্তন। পাশ্চাত্য শিক্ষার বহিরাবরণ খসে পড়েছে, বিজ্ঞান তার সক্ষমতার সর্বাতিশয়ী অহংকারে সাময়িক অভিঘাতের মুখে পড়েছে। বিশ্বের শাসন ও অর্থনীতিতে মহাশক্তিরা আজ হাঁটু মুড়ে পড়েছে মৃত্যুর মিছিল চোখে দেখা যায় না। দূরদর্শন না দেখালেও ঘরবন্দি মানুষ এই চিরকালের জীবননাট্যে স্পষ্ট ও পরিত্রাণের মহাকাব্যই হয়তো কোনো না কোনোভাবে বলতেন। দূরদর্শন ঘরে ঘরে সেই মনোভাবটিকেই সঞ্চারিত করেছে। এখানেই ভারতবর্ষ বেঁচে আছে—থাকবে।
মহাভারতের শেষে ‘স্বর্গারোহণ পর্ব, ‘মহাভারতের মাহাত্ম (আগেও আছে) উচ্চারিত হয়েছে সেখানে। বলা হয়েছে, যিনি পর্বে পর্বে এই গ্রন্থ পাঠ করে শোনান তিনি পাপমুক্ত হয়ে ব্রহ্মলাভ করেন। যিনি শ্রাদ্ধকালে এর কিছু অংশও ব্রাহ্মণদের শোনান, তার পিতৃগণ অন্ন ও পানীয় লাভ করেন। শুধু কি তাই, ‘সূর্যোদয়ে যেমন তমোরাশি বিনষ্ট হয়, মহাভারত শুনলে সেইরূপ কায়িক, বাচিক ও মানসিক সমস্ত পাপ দূর হয় (রাজশেখর বসু ও ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত’ সারানুবাদ’, এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাঃ লিঃ; কলকাতা, অষ্টম মুদ্রণ, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ, ৬৮৪ পৃ)। এই পুণ্য লাভ, পাপ দূরীকরণ শুধু একজনের নয়, মহাভারত কথা ব্রাহ্মণদের শোনালে (বিষয়টি আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। কারণ ব্রাহ্মণরাইতো জ্ঞান বিদ্যার আদি!) পূর্ব পুরুষ অন্ন জল পাবেন! যেকোনো সংকট কালে এই বোধই আমাদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। স্বতন্ত্র স্বধর্মনিষ্ঠ আর জয়ী।
রামায়ণ-কে বলা হয়েছে কাব্য। মহাভারত হলো ইতিহাস। রামায়ণ বটবৃক্ষের মতো। মহাভারত পর্বে পর্বে বিন্যস্ত জটিল অরণ্য। মহাকাব্যই ভারতের প্রাণ-তপস্যার নির্যাস। মহাকাব্য বৃত্তান্তমূলক নয়। এখানে অনিঃশেষের আদল আছে। উত্তরকাণ্ডের ৯৩-৯৪ সর্গে আছে অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষে উদ্যাপনের সময় লব-কুশ এসে শ্রীরামচন্দ্রকে রামায়ণ – গান শুনিয়েছেন। উপস্থিত মুনি-ঋষি-রাজারা অবাক। তাদের মনে হলো ঃ ঊচুঃ পরস্পরং চেদং সর্ব এব সমাহিতাঃ।
উভৌ রামস্য সদৃশৌ বিশ্ববিম্বমিবোদ্ধৃতৌ।। (উত্তরকাণ্ড, ৯৪ সর্গ, ১৩শ শ্লোক)
এরা উভয়েই রামের সদৃশ, যেন বিম্ব। থেকে উদ্ভূত দুটি প্রতিবিম্ব। এরা ২৪ হাজার শ্লোক আর একশত উপাখ্যান যুক্ত আদি থেকে ছয় কাণ্ডে বিস্তৃত ৫০০-র মতো সর্গযুক্ত রামায়ণ কথা শোনালেন। জানা গেল উত্তরকাণ্ডও আছে। (রাজশেখর বসুঃবাল্মীকি রামায়ণ, সারানুবাদ; এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাঃ লিঃ; কলকাতা; মুদ্রণ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ; ৩৯৯ পৃ.)। এই বিন্দুটি নিশ্চয় সূচনা নয়। রাম না জন্মাতে রামায়ণ লিখলেন বাল্মীকি। কাহিনির শেষের সামান্য অংশ রামায়ণের মধ্যেই রামায়ণ শোনালেন কুশ আর লব। জানা কাহিনির এই আবর্তনই মহাকাব্যের আসল রহস্য। রামায়ণ ও মহাভারতের এই আবর্তন যুগে যুগে ভারতীয় মহাজাতি নির্মাণ করেছে।
বলা হয়েছে ‘পণ্ডিতগণ শ্রাদ্ধকালে এই আয়ুষ্কর সৌভাগ্যজনক পাপনাশক বেদসম রামায়ণ শোনাবেন। এই গ্রন্থ পাঠ করলে পুত্রহীন পুত্র পায়, ধনহীন ধন পায়। (উক্ত; ৪১১ পৃ.)। আচার্য রমেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন, যা পড়তে হয় না তাই মহাকাব্য। কথাটি মজাদার। আসলে ভারতবর্ষ যতদিন রামায়ণ-মহাভারত ততদিন আমাদের মনোজগতে স্রোতোদ্বতী হয়ে ছিল, আছে—থাকবে। দূরদর্শনে প্রচারিত রামায়ণ ও মহাভারত সেই চিরসত্যকেই আরেক বার প্রমাণ করল— এই যা।
ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস