কবিগুরু দেশের মানুষের ঘুম ভাঙাতে এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে গান বেঁধেছিলেন— ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’! আর আজ রবীন্দ্রনাথের সেই কালজয়ী গানের প্রায় একশো বছর পর রাজ্যের নেত্রীর ডাকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উপাচার্যরা পড়াশুনার কাজ বন্ধ। রেখে দৌড়চ্ছেন নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বেতন বৃদ্ধির কথা শুনতে। নেত্রীও টোপ ফেলছেন সমবেত অধ্যাপকদের, উপাচার্যদের উদ্দেশে। কোথায় উপাচার্য ত্রিগুণা সেন, উপাচার্য গোপাল সেন, উপাচার্য সত্যেন সেন, উ পাচার্য অম্লান দত্ত’র গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার ? রাজ্যের শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের মঞ্চে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্যেন সেনের। সত্যেন সেন পিছু হঠেননি। লক্ষণীয়। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় ছিলেন অতি উচ্চমানের ব্যারিস্টার। সত্যেন সেনও ছিলেন অসাধারণ মেধাবী অধ্যাপক। পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণীদের যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা পেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় সভা করতে পারেননি। আর এখন ডাক শুনলেই হলো! নেত্রী ডাক দিলেন আর সবাই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দৌড়লেন! নেত্রী ছিপ ফেললেন আর সবাই টোপ খাওয়া শুরু করলেন। উপাচার্যদের পাশে বসিয়ে (উপাচার্যরা অবশ্য নেত্রীকে ঘিরে দাঁড়িয়েই থাকেন) নেত্রী চিৎকার শুরু করলেন—“তাহলে এখন ঘোষণা করছি। এই ঘোষণা করছি কথাটা তিনি আরও পাঁচবার বললেন। আর ওদিক থেকে সমস্বরে চিৎকার অধ্যাপক, আধা-অধ্যাপক, সিকি-অধ্যাপক, কিঞ্চিৎমাত্ৰ-অধ্যাপক, কণামাত্র অধ্যাপক সকলের। নেত্রী বলছেন— ‘তাহলে ঘোষণা করি। কণামাত্ৰ-অধ্যাপকরা সিটি মারা শুরু করলেন। নেত্রী বলছেন, ‘ঘোষণাটা করেই দিই। ঘোষণা হলো— এখন থেকে অধ্যাপকদের চাকরির বয়স ৬২ হয়ে গেল। অধ্যাপকদের মুখ গম্ভীর। সিটিওয়ালাদের সিটি স্তব্ধ। আর নেত্রী বলছেন, “কি খুশি তো, কি খুশি না? কিন্তু হাততালি নেই কেন?
শিক্ষাক্ষেত্রে লুম্পেনদের দাপাদাপি। দিন। দশেক আগে নেত্রী কৃষ্ণকলি বসু মালদায় কলেজ অধ্যাপকদের ডাকলেন। সবাই কলেজ ছেড়ে দৌড় লাগালেন। নেত্রী ভাষণ দিলেন— ‘যারা দিনে টিএমসি আর রাতে বিজেপিতাদের মুখোশ টেনে ছিড়ে দেব। অধ্যাপকদের সমাবেশে লুম্পেনের ভাষা!
আজ কলেজগুলো শাসন করছে গুন্ডা, লুম্পেন, চোর, দাগি আসামিরা। কলেজের ক্লাসরুমে দুষ্কৃতী সমাজবিরোধীরা নির্দ্বিধায় ঢুকে যাচ্ছে। দুষ্কৃতীদের ভয়ে কলেজে ছাত্রীরা যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী একবার খবর নিয়ে দেখুন কলেজ ছাত্রীদের বাবা-মায়েরা কলেজের গুন্ডাদের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাতে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ছাত্রীরা গুন্ডাদের এতটাই ভয়ের ও ঘৃণার চোখে দেখছে যে তারা দক্ষিণ ভারতে চলে যাচ্ছেনার্সিং কোর্স করতে। পশ্চিমবঙ্গের ডিগ্রি কলেজে ছাত্রীরা আর উচ্চশিক্ষার দরজায় পৌঁছতে পারছেনা। কলেজগুলোতে ঘোরতর অন্ধকার নামিয়ে নিয়ে এনেছে সমাজবিরোধীরা। পড়াশুনা বিদায় নিয়েছে। আর অধ্যাপকরা দৌড়চ্ছেন স্যালারি হাইকের কথা শুনতে। গুন্ডার আস্ফালন চলছে আর অধ্যাপকরা টাকা গুনছেন। অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরী, অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু, অধ্যাপক তারক মোহন সেন, অধ্যাপক তারক মোহন দাস, সুশোভন সরকারের মতো অধ্যাপকদের আজ পাওয়া যাবে না। ছাত্রনেতারা, শয়তানরা মেয়েদের লাঞ্ছনা করছে। কেউ ছাত্রীদের বাঁচানোর জন্য নেই। গুন্ডারা ঘুসের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে। আর এই ঘুসের টাকা দিয়েই দল চলছে। কালিয়াচক কলেজ, চাঁচল কলেজ, সামসী কলেজ, শিলিগুড়ি কলেজ সর্বত্রই গুন্ডাদের দাপাদাপিতে শিক্ষার পরিবেশ। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কালিয়াচক কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশত বর্ষ অনুষ্ঠানে গুন্ডারা সভাকক্ষের আলো নিভিয়ে দেয়। গুন্ডারা চিৎকার করে প্রিন্সিপ্যালকে বলে ডিপিআই থেকে প্রাপ্ত টাকার হিসাব না দিলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত বর্ষ অনুষ্ঠান করতে দেবে না। প্রিন্সিপ্যাল টিএমসিপি গুন্ডাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশ যে, রাজ্যের শাসকদলের ছাত্রসংগঠন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি কর্মীর সহায়তায় ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকা নিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের থেকেও অনেক বেশি নম্বর পাইয়ে দিচ্ছে। আর রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ামক ছেলে ভুলানো গল্প শোনাচ্ছেন যে মার্কশিট অনলাইনে হয়। কতিপয় দালাল, শাসকদলের গুন্ডা বদমাইশদের মদতে পরীক্ষার নম্বরকে এদিক ওদিক করে দেওয়ার ঘটনাকে আড়াল করতে রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ামক সংবাদমাধ্যমে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছেন। আর উপাচার্য চুপ। এমনকী এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে লোক দেখানো তদন্ত কমিশন গঠনের কথাও উচ্চারিত হয়নি।
শুভ্র সান্যাল
2020-02-05