প্রেরণাস্রোত শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী


সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা প্রাতঃস্মরণীয়। ডাক্তারজীকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু যে কজন সঙ্ প্রচারক, কার্যকর্তার মধ্যে প্রবলভাবে সদ্য প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজীর ছায়া প্রত্যক্ষ করেছি তার মধ্যে শ্রীকৃষও মােতলগজীর নাম সবার প্রথমে উজ্জ্বল ভাবে অবস্থান করবে। তার শীতল স্নেহের পরশ আজও হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে জাগ্রত হয়ে আছে। হাজার হাজার স্বয়ংসেবককে তার স্নেহ ও ভালােবাসার পরশ গঙ্গার পবিত্রতা দান করেছে। তার পথনির্দেশ প্রতিক্ষণ আমাদের পাথেয়।
শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধীর স্থির দুটি চোখ,শান্ত ও ভাবগম্ভীর একটি উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, জাদুকাঠি ছােয়ানাে অপূর্ব স্নেহময় দুটি হাত। বাঙ্গলার মাটি-জল-বাতাস ভেজানাে এক অপূর্ব কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবনের প্রতিটি আচরণে প্রকাশ পেত দেশ- সমাজ-জাতি ও হিন্দু সমাজ সংস্কৃতির শান্ত শুভ্র রূপ। দর্শনমাত্রই আমাদের মনের মধ্যে এক প্রশান্তি এনে দিত। প্রান্ত প্রচারক হিসেবে ও ক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে তার যে যােগ্যতা, দক্ষতা এবং কঠোর পরিশ্রম আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা এক কথায় অনুপম।
আমরা প্রায়শই বলে থাকি এক দেশ ও এক সংস্কৃতির কথা, আমরা প্রায়শই বলে থাকি ভারতের মাটি আমার মাটি, ভারতের ভাষা আমার ভাষা, ভারতের মানুষ আমার আত্মীয়। কিন্তু আমাদের যদি বলা হয় তােমাকে মহারাষ্ট্র যেতে হবে, তােমাকে মারাঠি ভাষা শিখতে হবে, তােমাকে মারাঠি খাবার খেতে হবে, মারাঠি সংস্কার ও রীতিনীতি রপ্ত করে সফলভাবে মহারাষ্ট্রে একটি জীবন্ত সংগঠন দাঁড় করাতে হবে – তখন কজন বাঙ্গালি যুবক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্মতিসূচক হাত মহাআনন্দে উপরে তুলবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
বিপরীত ভাবে যখন এক মারাঠি যুবককে বঙ্গপ্রদেশ সম্পর্কে এরূপ বলা হয় তখন তিনি সানন্দে হাসিমুখে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শুধু রাজিই হয়ে যাননি, সফল ভাবে সংগঠন ও ব্যক্তি সংস্কার করে দেখিয়েছেন। আত্মবলে বলীয়ান, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, অকুতােভয় এই যুবকটি আমাদের প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী। ১৯৮১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪ বছর বাঙ্গালি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্ঘকাজকে গতি দান করেছেন।
১৯৮১ সালে সহ-প্রান্ত প্রচারক হিসেবে তিনি এখানে আসেন এবং নিজের যােগ্যতা, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও স্নেহ-ভালােবাসা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্বয়ংসেবকদের আপনজনে পরিণত হন খুব দ্রুত। পরবর্তীকালে প্রান্ত প্রচারক হিসেবে বাঙ্গলার সংগঠনকে দিশানির্দেশ করেছেন বেশ কয়েক দশক ধরে। শ্রীকৃষ্ণদা পরবর্তীকালে পূর্বক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে সফলতার সঙ্গে কাজ করেছেন। মূলত রাষ্ট্রবিরােধী, দেশবিরােধী, হিন্দুত্ববিরােধী কমিউনিস্টদের সঙ্গে বৈচারিক লড়াই করে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে আগত আত্মপ্রত্যয়ী এই প্রচারক যেভাবে বাঙ্গলার হাজার হাজার স্বয়ংসেবক ও কার্যকর্তাকে উৎসাহিত করেছেন এবং সঙ্ঘকাজে আত্মনিয়ােগ করবার প্রেরণা দিয়েছেন তা বিশেষ ভাবে বলা প্রয়ােজন। কলকাতা থেকে কোচবিহার দুরন্তগতিতে ছুটে বেড়িয়েছেন, প্রতি জেলা, প্রতি নগর, প্রতি খণ্ডে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি বাঙ্গলা চিরকাল গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করবে। ১৯৮৪ সালে একাত্মতা রথযাত্রার সময়ে তার পরামর্শ ও পরিকল্পনা আমরা সকলে প্রত্যক্ষ করেছি।
ব্যক্তিগত ভাবে ১৯৮৮ সালে প্রথম বর্ষ সঙ্ঘশিক্ষা বর্গে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন আমি সবেমাত্র বালক থেকে তরুণ হচ্ছি। অধিকারী কক্ষে পরিচয় পর্বটি ছিল খুব ছােটো এবং অতি সাধারণ। তার বেশ কয়েকবছর পর মালদা কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা হয় এবং আমার নাম ধরে। আমাকে ডাকেন। জীবনের যেকটি আনন্দের ক্ষণ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে সেগুলির মধ্যে স্বগৌরবে জায়গা করে নিয়েছে শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজীর মারাঠি স্বরে বাংলা উচ্চারণ- ‘রাজু ভালাে আছাে? পড়াশুনা কেমন চলছে? একজন প্রান্ত প্রচারক আন্তরিকতার সঙ্গে স্বয়ংসেবকের ঘাড়ে হাত দিয়ে স্নেহ বিতরণ করে তখন সদ্য যৌবনে পা রাখা এক তরুণের হৃদয়ে। কেমন প্রতিক্রিয়া হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্ষেত্র প্রচারক থাকাকালীনও একাধিকবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। খুব ছােটো ছােটো বিষয় নিয়ে জমিয়ে আড্ডা হয়েছে, জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। ধীশক্তি প্রবল থাকলে অন্য প্রদেশের ভাষা রপ্ত করা যায় কিন্তু খাদ্যাভাস! বেশ কষ্টকর বিষয়। কয়েকবছর পূর্বে এক দক্ষিণ ভারতীয় সন্ন্যাসী আমাদের ঘরে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাংলায় ব্যাকরণ, সংস্কৃতি, মুসলমান ও খ্রিস্টান আগ্রাসন, বঙ্গ রাজনীতিতে মুসলমান তােষণ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। আলােচনার মধ্যে খাবারের কথা আসতেই সন্ন্যাসী আমাকে বললেন— ‘আজ হামারা সবজি ঔর দালর্মে থােড়া নারিয়ল ডালনা, নারিয়ল বিনা খানা দক্ষিণ ভারতীয়কে না পসন্দ। বলাবাহুল্য রান্নার মধ্যলগ্নে হঠাৎ করে নারিকেল খুঁজতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজীর কথা মনে পড়ছিল। ৯০-এর দশকের শেষের দিকে শ্রীকৃষ্ণজী একবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলােচনা চলছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি কী খেতে পছন্দ করেন। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন ১৫ মি. আমাকে একটু চিন্তাভাবনা করবার সময় দাও। আমাকে অন্য স্থানে পাঠিয়ে সেই সময়ের মধ্যে আমাদের বাড়ির খাবারের হাল-হকিকত সব জেনে ফেলেন। মা যেসব জিনিস রান্না করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেই খাদ্যদ্রব্যগুলির নাম আমি ফিরে এলে গড়গড় করে বললেন। ভ্রমণকালে পরিবারের উপর যাতে কোনাে চাপ সৃষ্টি না হয় সেদিকে তীক্ষ নজর থাকত। পরিবারের সঙ্গে কীভাবে একাত্ম হতে হয় শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী আমাদের হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন। আমার মতাে ছােটো ছােটো হাজার কার্যকর্তার কাছে তার জীবনের এক একটি আচরণ এক একটি ছােটো গল্প হয়ে আছে।
বাংলা ভাষাকে আত্মীকরণ করে তিনি বাংলায় যে ভাষণ রাখতেন তা যেমন ছিল তথ্য সমৃদ্ধ তেমনই ছিল হৃদয়স্পর্শী।তার বৌদ্ধিক উপস্থাপনা কৌশল ছিল খুব আধুনিক বিষয়ের সর্বদিকে আলােকপাত করা এবং ব্যক্তিগত অনুভব ব্যক্ত করে বিশেষ করে ডাক্তারজীর জীবনের ছােটো ছােটো উদাহরণ দিয়ে তিনি স্বয়ংসেবক ও সঙ্ঘানুরাগী ব্যক্তির মনে সােনার জাদুকাঠি স্পর্শ করতেন। তাঁর আচার-ব্যবহার, ভাব-ভাষা, সরল দেশপ্রেম বঙ্গপ্রদেশের সংগঠনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। কত বৌদ্ধিক, প্রবচন ও ভাষণে এবং দৈনন্দিন আচরণে তিনি আমাদের প্রেরণাস্রোত হয়ে আছেন।
শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী প্রাকৃতিক নিয়মে ২ আগস্ট করােনা আবহের মধ্যেই অমৃতলােকে যাত্রা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সমাজে ও রাজনীতিতে যে জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী আবহাওয়ার জাগরণ হয়েছে তার পৃষ্ঠভূমি যাঁদের দীর্ঘ ত্যাগ ও তপস্যার ফলে রচিত হয়েছে—তাঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী অন্যতম। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গকে পূর্বগরিমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র গঠনের কার্যে বঙ্গের মানুষ ও বঙ্গের কার্যকর্তাদের যােগ্য করে তুলতে পারি তবেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানাে হবে, তার ত্যাগ ও তপস্যা প্রকৃত মর্যাদা পাবে।
রাজু কর্মকার
(লেখক হিন্দু জাগরণ মঞ্চের উত্তরবঙ্গ প্রান্তের সংযােজক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.