ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি চলে গেলেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন তিনি। তার শােকে বাঙ্গালি শােকাভিভূত। তিনি নড়াইলের জামাই, ভারতের রাষ্ট্রপতি হলে নড়াইলের মানুষ আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছিল। পিতা-পুত্রী সম্পর্ক। জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্যে তিনি ছিলেন আশীর্বাদ। শেখ হাসিনা এই সম্পর্কটি সুন্দর, সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতে প্রথমবার বিজেপি ক্ষমতায় এলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে।
অনেকে চিন্তিত ছিলেন, প্রণব মুখার্জি এ সম্পর্ক অটুট রাখতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন।
হয়তাে বাঙ্গালি বলে এই সজ্জন ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। গত দুই দশক তার সঙ্গে বহুবার দেখা করার সুযােগ হয়েছিল। বাংলাদেশের বেশ কিছু নেতাকেও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে সাহায্য করেছিলাম। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মন্ত্রী হবার পেছনে প্রণব মুখার্জির আশীর্বাদ ছিল। সজীব ওয়াজেদ জয় আমাদের সঙ্গে ছােট্ট একটি বৈঠকে বলেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী হবেন না। এরপর জয়কে রাজি করাতে পারতেন দু’জন লােক, এর একজন প্রণব মুখার্জি। ২০০৮ সালে ২৭ জুলাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভার্জিনিয়ার বাসায় জননেত্রী শেখ হাসিনা আমায় বলেছিলেন, দাদার সঙ্গে সু সম্পর্ক বজায় রাখতে। আমি তা রেখেছিলাম।
দাদার সঙ্গে প্রথম ও শেষ দেখার কথা আমার মনে আছে। প্রথম দেখা সুখকর হলেও শেষ দেখাটি তা ছিল না। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯-এর ২৮ নভেম্বর দিল্লিতে। দাদার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। তাঁর পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি কলকাতা থেকে দিল্লিতে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ২০১৪-র এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের পর ২০১৯-এর শেষ বৈঠক। ২০১৭-তে আমি ৪ দিনের জন্যে দিল্লি গেলেও দাদার সঙ্গে দেখা হয়নি বা দেখা করার জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইনি, তখন দাদার প্রতি আমাদের কিছুটা অভিমান, ক্ষোভ জমা হয়েছে। কারণ দাদা আমাদের, মানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্যে কিছু করেননি।
তিনি ছােটো-বড়াে সবার দাদা। তিনি বিদেশমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে যতবার নিউইয়র্কে এসেছেন বা আমি দিল্লি গেছি, প্রায় প্রত্যেকবার দাদার সাক্ষাৎ পেয়েছি। নিউইয়র্কে একবার দাদার। সঙ্গে দেখা করার জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলাম, তখন তিনি বিদেশমন্ত্রী। মন্ত্রীর অফিস জানালাে মাত্র ৩ জন? আমরা গেলাম ৮ জন। অফিস ৩ জনের বেশি দেবে না। বললাম, দাদাকে বলুন, আমরা সবাই আসবাে। অফিসার গেলেন, ফিরে এসে। জানালেন দাদা অনুমতি দেননি, একটু পর হেসে বলেন, আপনি প্রথা ভেঙে দিয়েছেন, স্যার সবাইকে যেতে বলেছেন, আমরা গেলাম।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তাঁর সঙ্গে বৈঠকের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অনেক কষ্ট করে অতীত বহু মিটিংয়ের প্রসঙ্গ টানার পর সাক্ষাতের অনুমতি পাই। আমরা প্রায় এক ডজন দেশের এক কুড়ি জন নেতাকে নিয়ে যাই। বিশাল ব্যবস্থা, বৈঠকের শুরু ও শেষে আপ্যায়নের সুব্যবস্থা। ভারতের সুবিশাল রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢােকার সুযােগ হলাে। শুরুতে রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারি আমায় ডাকলেন। বললেন, পা ছুঁয়ে প্রণাম করা যাবে না। সময় বিশ মিনিট। বললাম, ঠিক আছে। আমরা সবাই অপেক্ষমান, দাদা মিটিং ঘরে ঢুকলেন, সবাই দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে দাদাকে নমস্কার জানালেন। দাদা প্রত্যুত্তরে একই কায়দায় সবাইকে নমস্কার জানালেন।
দাদা বসলেন। প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার ছবি তুললেন। আমাদের সঙ্গে চার-পাঁচ জন মহিলা ছিলেন। তারা অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা জানালেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং আবেগে আপ্লুত হলেন।তিনি সবার কথা গভীর মনােযােগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, আমি দেখছি কী করা যায়। কেউ কেউ তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। মিটিং চললাে ৪৫ মিনিট। দাদা চলে গেলেন। আমরা তখন স্ন্যাক্স খেতে শুরু করলাম। সবাই খুশি। খানিক পর একজন এসে প্রশ্ন করলেন, ‘হু ইজ শিতাংশু। বললাম, আমি। জানালেন, প্রেসিডেন্ট আপনাকে ডেকেছেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি আমায় ডেকেছেন, আমি খুশি, আপ্লুত। ভারতের প্রেসিডেন্টর সঙ্গে একান্ত বৈঠক। আমার মতাে সাধারণ মানুষের সঙ্গে, অভাবনীয়। তবে আমি অপ্রস্তুত ছিলাম না, দাদার সঙ্গে আগেও আমি একা কথা বলেছি। প্রেসিডেন্টের অফিসে ঢুকলাম। দাদা সােফাতে বসা, আমায় পাশের আর একটি সােফায় বসতে বললেন। বসলাম। দাদা ডেকেছেন তাই প্রথম কথা তিনিই বললেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ব্যাখ্যা দিলেন কেন আমাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে নিষেধ করা হয়েছে। জানালেন, গণতন্ত্রে পা-ধরাটা’ অশােভন। বুঝলাম। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একা অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। বােঝা গেল তিনি বৈঠক নিয়ে সন্তুষ্ট।
বললাম, দাদা, আপনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমাদের জন্যে কিছু একটা করে যান, বাংলাদেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুরা আপনাকে আজীবন মনে রাখবে। সামনের টেবিলে অনেক রঙের ফোন। সুযােগ পেয়ে বলেই ফেললাম, দাদা, একটু চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন। ইতিমধ্যে ৮-৯ মিনিট পার হয়ে গেছে। দাদা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি। এই সংক্ষিপ্ত স্বল্প সময়ের বৈঠকের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
দাদা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমাদের ফাইলটি তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের সেই কথা জানানাে হয়েছিল। আমাদের বৈঠকের সংবাদ ও ছবি সেদিন ভারতের টিভিতে এসেছিল। সরকারিভাবে আমাদের কাছে ছবি পাঠানাে হয়েছিল। বাংলাদেশে সরকার বিষয়টি ভালােভাবে নেয়নি। তারা কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। যদিও আমাদের চাওয়া ছিল দাদাকে দিয়ে অন্তত একটি দাবি আদায় করা, আমরা পারিনি।
২০০৮ সালের ১ অক্টোবর, দাদা নিউইয়র্কে ছিলেন। সম্ভবত তখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি জানতে চাইলেন, তােমার নেত্রীর খবর কী? বললাম, নেত্রী তাে ৩-৪ দিন আগে জানালেন যে তিনি নিশ্চিত নন, আওয়ামি লিগ সামনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসছে। কিনা? প্রণব মুখার্জি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কবি সুকান্তের মতাে গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসবে। আমি সজীব ওয়াজেদ জয়কে জানালাম। তিনি বললেন, দাদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
নভেম্বর ২০১৯-এর মিটিং খুব একটা সুখপ্রদ ছিল না। দাদার বয়স হয়েছে। সবাইকে চেনেন না, কানে যন্ত্র থাকলেও কথা খুব কম শুনেন। তার অফিসে তিনজনের বেশি ঢুকতে দেবে না। আমরা সাতজন ঢুকলাম। নমস্কার সেরে বললাম, বাইরে আরও চারজন আছে, দাদা একবারে সবাইকে ডেকে নিলে ভালাে হতাে। দাদা রাজি হলেন, সবাই ঢুকলেন, আরও চেয়ার আনাতে হলাে। এক পর্যায়ে দাদাকে আবার বলালাম, দাদা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে একটু ফোন দিলে ভালাে হতাে। তিনি একটু রাগলেন, তাকে আগে কখনাে রাগতে দেখিনি। বললেন, এখন আমার কোনাে প্রটোকল নেই! অবশ্য তিনি বলেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কাছে তিনি বিষয়টি জানতে চাইবেন।
দাদার সঙ্গে প্রথম মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে, সন তারিখ মনে নেই? তবে তখন বিএনপি ক্ষমতায়। ২০০১-এ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিশ্ব উদ্বিগ্ন। দাদা তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তার বাড়ির দরজায় সেনা মােতায়েন ছিল। ঢুকতেই প্রশ্ন, ‘কিসকো মিলেগা। বললাম, মাইজিকো। আসলে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বৌদির সঙ্গে। বৌদি বলেছিলেন, আমি দাদাকে বলে দেব, ১০ মিনিট সময় পাবেন।ঠিক আছে। অতিথি কক্ষে ঢু কলাম, মাত্র একজন মানুষ অপেক্ষমান। অবাক হই, এতবড়াে মন্ত্রী, অথচ বাসায় ভিড় নেই! আমাদের মন্ত্রীদের বাড়িতে তাে ক্যাডারদের জ্বালায় ঢােকার সুযােগ থাকে না।
একটু পরে ডাক পড়লাে। ভেতরে ঢুকলাম। মনটা খুশিতে ভরে গেল। একজন বাঙ্গালি দিল্লিতে অনেক উঁচুতে। বসতে বললেন, বসলাম। নমস্কার দিলাম। তিনি প্রতি-নমস্কার দিলেন। কথা শুরু করলাম। ঠিক কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে বিএনপি-জামাতের অত্যাচার তাে ছিলই। তিনি জানতে চাইলেন, শেখ হাসিনা আমাকে চেনেন কিনা? আমার সঙ্গে ডাঃ টমাস দুলু রায় ছিলেন, তিনি কথা বলেননি। তখন আমেরিকা আফগানিস্তানে ঢুকে গেছে।
সাউথ-সুদান, টিমাের বা ইরাক আমাদের আলােচনায় এসেছে। বিএনপির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গােলাম মােরশেদ এর আগে প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে কিছু একটা কটুক্তি করেছিলেন, আলােচনায় তাও এসেছে।
দাদা বেশ উৎসাহের সঙ্গে আমার কথা শুনছিলেন। দশ মিনিটের জায়গায় এক ঘণ্টা প্রায়। আমার আর বলার কিছু নেই, উঠতে পারলে বাঁচি। দাদাকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনজন এক সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘দাদা, আপনি ব্রাহ্মণ, তদপুরি প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, আপনার পায়ের ধূলি নিতে চাই’। দাদা সানন্দে রাজি হলেন, দাদাকে প্রণাম করলাম। মা-বাবার মৃত্যুর পর আমি কাউকে পা-ছুয়ে প্রণাম কললাম। টমাসদাও প্রণাম করলেন, টুকটাক কথা বললেন। খুশি মনে বেরিয়ে এলাম। দাদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করা সেই শুরু। সেটি বন্ধ হয় তিনি যখন প্রেসিডেন্ট। দাদা নেই, তাঁর স্মৃতি থাকবে। দাদাকে শেষ প্রণাম,
শিতাংশু গুহ
(লেখক নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি)
2020-09-07