শুরু হওয়া নতুন দশককে সাদর অভ্যর্থনা ! একজন ব্যক্তির জীবনে ১০ বছর বেশ দীর্ঘ সময় কিন্তু ভারতের মতো বিশাল দেশের কাছে তা এমন কিছু নয়। স্মরণে আসবে অতীতের ২০২০ ভিশান ডকুমেন্টের কথা। সে সময় অনেকে আশা করেছিলেন এই ২০২০-তে ভারত ‘সুপার পাওয়ার দেশগুলির তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। যাইহোক, সেই আশা পূর্ণ না হলেও, গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অনেক কিছুই হয়েছে।
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের অন্যতম ইঙ্গিতবাহী সূচক জিডিপি অনুযায়ী দশ বছরে মাথাপিছু আয় বছরে ১ হাজার ডলার থেকে ২ হাজারে পৌঁছে দ্বিগুণ হয়েছে। বাৎসরিক বৃদ্ধির গড় হিসেবে এই হার ৭.২ শতাংশ। নিশ্চিতভাবে সাধারণ ভারতবাসীর হাতে আসা এই টাকা তার নিজস্ব সম্পদ। অবশ্যই ১০ বছর আগে আমরা যে পরিমাণ খরচ করতাম এখন তার দ্বিগুণ করতে পারি। এই উন্নতির পেছনে কোনো গোপন রাজনৈতিক মতামত বা গৌরব সন্ধান উদ্দেশ্য নয়। বিগত দশকটিতে শাসন পরিচালনায় কংগ্রেসও ছিল বিজেপিও ছিল। তাই এটি যুগ্ম সাফল্য। হ্যা, আমরা হয়তো আরও দ্রুত এগোতে পারতাম।
অবশ্যই একটি উন্নত দেশের তকমা পেতে গেলে আমাদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে— যেমন আমেরিকা (মাথা পিছু ৬০ হাজার ডলার) এমনকী চীন (১০ হাজার ডলার মাথা পিছু)। কিন্তু আমরা তো ২০৩০-এর মধ্যে মাথা পিছু আয় অন্ততপক্ষে ৫ হাজার ডলারে নিয়ে যাওয়ার আশা করতেই পারি। এটি একটি সম্মানজনক স্তর, নিঃসন্দেহে। কেননা এখানে পৌঁছতে পারলে আমরা গরিব দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলতে পারব। আবার ২০৪০-এর মধ্যে গড় আয়কে ১২ হাজার ডলার ছোঁয়াতে পারলে আমরা সেমি ডেভেলপমেন্ট দেশের মান ছুঁতে পারব। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে থাকবে যারা জীবদ্দশায় এটা চাক্ষুষ করবে। সুপার পাওয়ার হওয়ার অত্যন্ত গালভরা আহ্বান ছেড়ে আগামী দু’দশক অর্থাৎ ২০৩০-এর মধ্যে মাথাপিছু ৫ হাজার, ২০৪০-এ ১২ হাজার ডলার আয় যদি জিডিপি-র অংশ হতে পারে সেটিই হবে বলার মতো সাফল্য।
হয়তো, এই হিসেবটা ‘সুপার পাওয়ার’ শব্দদুটির মতো অত ঝংকারময় নয় তবে এই লক্ষ্য পূর্ণ করা ভারতবাসীর জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন এনে দেওয়ার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। মাথাপিছু জিডিপি-তে বৃদ্ধি ২০১০-এর তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার কথা বাদ দিলেও আজ দেশে ভালো রাস্তা, ভালো বিমানবন্দর আর প্রায় প্রত্যেকের কাছে একটা মোবাইল ফোন থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। অধিকাংশ মানুষ মোবাইল যোগাযোগে আজ অভ্যস্ত। নির্মম দারিদ্র্য অনেক কমে এসেছে। শিক্ষা, স্বাস্থের নির্ণায়ক সূচকগুলি বাড়ছে।
এক নজরে দেখলে গত দশকের অগ্রগতিকে ভালোই বলা যায়। কিন্তু ২০২০-র এই নতুন দশকে আমরা কিন্তু খানিকটা ঝিমধরা অর্থনীতির হাত ধরেই প্রবেশ করছি। আগেই বলেছি গত দশকে বাৎসরিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২ শতাংশ। কিন্তু সর্বশেষ ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির পরিসংখ্যান অনুযায়ী তা ৪.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে মাথাপিছু ৫ হাজার ডলার রোজগারে পৌঁছতে গেলে বাৎসরিক গড় জিডিপি বৃদ্ধিকে ৯.৬ শতাংশে পৌঁছতে হবে। এটি অর্জন করা সম্ভব কিন্তু তা বাস্তব করতে গেলে অন্য সবকিছু সরিয়ে রেখে এই লক্ষ্যকেই পাখির চোখ করতে হবে। আগামী ১০ বছরে জাতির যৌথ লক্ষ্য হবে জনপ্রতি আজকের আয়ের চেয়ে ঠিক আড়াইগুণ বাড়ানো (এখনকার ২০০০-কে করতে হবে ৫০০০ হাজার ডলার)।
এই লক্ষ্য পূরণে কয়েকটা বিষয়কে একত্রিত করে এগোতে হবে : (১) বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, (২) শিল্পোদ্যোগ সহায়কনীতি প্রণয়ন, (৩) পদে পদেনিয়ন্ত্রণ বা আমলাদের মাতব্বরি, (৪) আয়কর আধিকারিকদের অকারণ নাক গলানো এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতাদের অনাবশ্যক ক্ষমতা প্রদর্শন একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও একতার বোধ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হারে স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে যতবারই জিএসটি কাউন্সিলের মিটিং হবে প্রত্যেকটিতেই কোনো না কোনো জিনিসের ওপর কর হারে পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের হতচকিত করে দিচ্ছে। গোয়ায় আয়োজিত জিএসটি বৈঠকে এমনটাই ঘটেছিল।
পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দেওয়ার কথা বলাই বাতুলতা, কেননা প্রস্তাবিত বিমানবন্দরগুলি এমন হতে হবে যেখানে তিন মাস ছাড়া মেরামতির কাজ করতে হবে না। একই সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ এমন রাখতে হবে যা খেয়াল খুশিমতো বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। প্রায়শই যাতে সার্ভার ডাউন হয়ে না পড়ে থাকে। বিদ্যুৎ আর অবিচ্ছিন্ন। জলের সরবরাহ ছাড়া কারখানার অস্তিত্ব ভাবাই যায় না। তাই এই দুটিও চূড়ান্ত অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র।
এই বিষয়কেন্দ্রিক বিশ্লেষণ পূর্বেও করা হয়েছে। বিভিন্ন আলোচনা সূত্রে শীর্ষেও উঠে এসেছে। সমাধান নেই এমন নয়। কেননা বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। যেটার ঘাটতি রয়েছে তা হলো অগ্রাধিকার ও দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার সমস্যা। কোনো না কোনো অজ্ঞাত কারণে আমরা ভারতীয় হিসেবে ও আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা দলগুলি সেভাবে কখনই নিজেদের সংকল্পবদ্ধ করেনি যে ভারতীয়দের আয় বাড়ানো একান্ত জরুরি এবং এটিই সর্বাধিক গুরুত্বের মর্যাদা পেতে পারে।
ধর্মকে নিয়ে এগিয়ে চলা চলবে, জাতপাতকে কেন্দ্রবিন্দু করা গ্রহণীয়, নির্দিষ্ট ব্যক্তির ভাবমূর্তি ঘিরে আশা-আকাঙ্ক্ষার পূরণের ইচ্ছেও স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা ভারতীয়রা ও আমাদের নেতাদের মধ্যে ভারতবাসীকে আয়ের ক্ষেত্রে স্বাচ্ছল, প্রাচুর্যময় করে তোলার বিষয়ে কখনই অন্তরে তীব্র আবেগ অনুভব করেছি বা নেতারা করেছেন বলে মনে হয় না। ক্ষমতায় থাকা সরকার হয়তো ভেবেছে মানুষ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাহলে আমাদের অত চিন্তা করার কী আছে।
পাকিস্তানের বেয়াদপির বিরুদ্ধে জোর থাপ্পড় কষানোয় বা হিন্দু হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠতায় গর্ব হওয়া দোষের নয়। তবে প্রত্যেক ভারতীয়ের স্বাচ্ছল্য গৃহ, শিক্ষা ও ব্যাধির ক্ষেত্রে সুচিকিৎসা পাওয়াকে আমরা যদি অগ্রাধিকার না দিই তাহলে চিরগরিব থাকাই হয়তো আমাদের পক্ষে যথাযথ।
অর্থনীতিকে স্বাধীন গতিতে চলতে গেলে সরকারকে নিজের ও তার অমলাতন্ত্রের ক্ষমতাকে কিছুটা ছাঁটতেই হবে। তারা সহজে এটা করতে চাইবে না যদিনা আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা তাদের এদিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাপ দিই। যদি আমরা নাগরিক হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখি সেক্ষেত্রে সরকারেরও অর্থনীতিকে বৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ ছাড়া উপায় থাকবেনা। তাই নতুন দশককে স্বাগত জানানোর সঙ্গে আমরা সংকল্প নিই যে ২০৩০-কে আমরা মাথাপিছু ৫ হাজার ডলার আয়ের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করবই। এই ধরনের লক্ষ্য মানুষকে বোঝানোর পক্ষেও সহজ, কেননা এর মধ্যে একটি ব্যক্তিযোগাযোগের স্পর্শ আছে। ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পূরণ করার লক্ষ্য। ন্যায়সঙ্গত হলেও এই ব্যক্তি-আয়ের বৃদ্ধির প্রোজেকশানটি বেশি আকর্ষক। আজকের ডলার মূল্যে তা জন প্রতি ৩০ হাজার ও পরিবার প্রতি প্রায় ১ লক্ষের কাছাকাছি। এই টাকায় ভারতীয় নাগরিকরা একটি ভদ্রস্থ, মর্যাদাব্যঞ্জক ও ভব্য জীবনযাত্রার অধিকারী নিশ্চয় হতে পারে। আর এই আয়সীমায় পৌঁছনো নিশ্চিত সম্ভব। তাই আমাদের ‘সুপার পাওয়ার’-এর কঠিন স্বপ্ন থেকে সাময়িক সরে এসে প্রত্যেকের পক্ষে হিতকর, অর্জনক্ষম এই লক্ষ্যটিকে সর্বতোভাবে বাস্তবায়িত করার জন্যে সরকারকে সক্রিয় রাখার সবরকম প্রয়াস নিতে হবে।
চেতন ভগত
(লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক)
2020-01-14