পৃথিবীতে যেখানেই কমিউনিস্টশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানেই গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, মানবাধিকারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃত ফ্যাসিবাদী হলাে এই কমিউনিস্ট দেশগুলােই। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও যেখানেই কমিউনিস্টরা প্রবেশ করেছে সেই জায়গাটাকেই বিষিয়ে দিয়েছে। গােটা ভারতবর্ষে মাত্র তিনটি রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা হয়—কেরল, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ। এই তিনটি রাজ্যেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এইগুলিতে একটি বড়াে সময় ধরে কমিউনিস্টরা রাজত্ব করেছে। বা এখনও করছে (কেরলের ক্ষেত্রে)। কারণ এটাই কমিউনিস্ট ‘সংস্কৃতি। পৃথিবীর যে দেশেই কমিউনিস্টরা রয়েছে সেখানেই এক দলীয় শাসনব্যবস্থা, অন্য কোনাে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নেই।ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতাই কমিউনিস্ট নীতি। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস কমিউনিস্ট ‘আদর্শে’ নেই। এই কারণেই ভারতের
প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল এই কমিউনিস্টদের কঠোর হাতে দমন করার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ কমিউনিস্ট দলগুলি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু নেহরু বাধা হয়ে দাঁড়ান। কাশ্মীর সমস্যা, চীন সমস্যার মতাে ভারতবর্ষে এই কমিউনিস্ট সমস্যারও জনক হলেন নেহরু।
সিপিএমের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি টানা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ লক্ষ্য করেছেন ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করে কীভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা যায়। বিরােধী রাজনৈতিক দল করলেই জমির ফসল কেটে নিয়ে চলে যাওয়া, পুকুরের জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া, পরিবারের মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া, বাড়িতে সাদা থান পাঠানাে, চাকরি বা ব্যবসা করলে কর্মক্ষেত্রে নানারকম অসুবিধার সৃষ্টি করা ইত্যাদি চলত। এছাড়া মারধর করা, খুন করা ইত্যাদি তাে চলতই। হাজার হাজার মানুষকে তাদের রাজনৈতিক মতবাদ না মানার জন্য হত্যা করা হয়েছে সিপিএম শাসনে। নানুর, ছােটো আঙারিয়া, সাঁইবাড়ি, নন্দীগ্রাম, নেতাই-সহ অসংখ্য রাজনৈতিক গণহত্যা হয়েছে। নির্বাচনের সময় শুরু হতাে আরেক প্রহসন। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে প্ল্যান করে তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন অঞ্চলের বিরােধী দলের গুরত্বপূর্ণ সংগঠক-নেতাকে হত্যা করা হতাে। গ্রামে গ্রামে বিরােধী রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দেওয়া হতাে ভােট দিতে না যাওয়ার জন্য। ভােটার তালিকায় বহু বিরােধী ভােটারের নাম কাটা পড়ত। অনেক ভুয়ে ভােটার ঢােকানাে। হতাে। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে বহু বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকিয়ে তাদের রেশন কার্ড ইত্যাদি করে দিয়ে ভােটার তালিকায় নাম তােলা তাে ছিলই। এরপর ভােটের দিন বিরােধী দলের এজেন্টকে বুথ থেকে প্রথমে হুমকি দিয়ে, তাতে কাজ না হলে মেরে বের করে দেওয়া হতাে। কিছুক্ষণ ভােট চলার পর শুরু হতাে দেদার ছাপ্পা। বিরােধী দল কোথাও প্রতিরােধ করলেই চলত মুড়ি-মুড়কির মতাে বােমা, গুলি।
২০১১ সালে পরিবর্তনের পর রাজ্যের মানুষ আশা করেছিলেন যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল রাজ্যে ‘পরিবর্তনের সরকারের বদলে সত্যিই ‘উন্নততর বামফ্রন্ট সরকার স্থাপিত হয়েছে। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেন রাজ্যের আপামর জনতা ২০১৮-র পঞ্চায়েত। দেশের অন্যান্য রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলে একটা মশা পর্যন্ত মারা যায় না, কিন্তু এ রাজ্যে ১০০-র ওপর মায়ের কোল খালি হয়ে গেল পঞ্চায়েত নির্বাচনের পুরাে প্রক্রিয়াতে। ১৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে (অবশ্য মাত্র ৬৬ শতাংশ পঞ্চায়েত আসনে, বাকি ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদল । পূর্বেই পকেটস্থ করেছিল) এক দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া শুধুমাত্র রাজ্যপুলিশ ও সিভিক পুলিশ দিয়ে ভােট সম্পন্ন হলাে। শুধু ওই দিনই ভােট হিংসায় রাজ্যে ২০-র বেশি মানুষ মারা যান। এমনকী যা পূর্বে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে কখনাে ঘটেনি, তাও ঘটে। প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ভােট পরিচালনা করতে গিয়ে উত্তর দিনাজপুরের স্কুল শিক্ষক রাজকুমার রায়ের মৃত্যু হলাে। ভােটের পরের দিন ভােটগ্রহণকেন্দ্র থেকে বেশ দূরে রায়গঞ্জ স্টেশনের কাছে তার খণ্ডবিখণ্ড দেহ পাওয়া গেল। রাজ্য সরকার এটাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও অনেকেই তা মানতে নারাজ। এছাড়া বিরােধীদের অভিযােগ ভােট গ্রহণের দিন অধিকাংশ ভােট গ্রহণ কেন্দ্রেই শাসক দলের দুষ্কৃতীরা অবাধে ছাপ্পা দিয়েছে। যার বহু চাক্ষুষ প্রমাণ সারদিন ধরেই টেলিভিশনের পর্যায় পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনগণ প্রত্যক্ষ করেছেন।
১৭ মে ছিল ভােটের ফলাফল ঘােষণার দিন। এদিনটাও ছাপ্পামুক্ত হলাে না। টিভির পর্দায় নদিয়ার মাজদিয়া কলেজের ভােট গণনকেন্দ্রে শাসকদলের এক নেতাকে দেখা গেল ছাপ্পা দিতে। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আমাদের মাথা আরেকবার বাকি ভারতবর্ষের কাছে লজ্জায় নত হয়ে গেল। বিরােধীদের অভিযােগ বহু জায়গায় তাদের কাউন্টিং এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয় গণনায় কারচুপি করার জন্য। ২০১৮-র পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন সবদিক দিয়েই ছিল অনন্য। শুধু এখানে ত্রিস্তর মানেটা একটু আলাদা। প্রথম স্তরে রাজ্যের সমস্ত বিডিও, এসডিও এবং ডিএম অফিসের সামনে ‘উন্নয়ন’ (পড়ুন শাসকদলের সশস্ত্র দুষ্কৃতীবাহিনী)-কে দাঁড় করিয়ে রেখে বিরােধীদের মনােনয়ন তুলতে ও জমা দিতে বাধা দেওয়া, দ্বিতীয় স্তরে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া শুধুমাত্র রাজ্য পুলিশ ও সিভিক পুলিশ দিয়ে ভােট করিয়ে নির্বাচনের দিন অবাধ ছাপ্পা ও সন্ত্রাস এবং তৃতীয় স্তরে ভােট গণনার দিন গণনায় ব্যাপক কারচুপি। বামফ্রন্ট আমলেও সন্ত্রাস, বহু মানুষের মৃত্যু, ছাপ্পা সবই হতাে, কিন্তু ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতাে নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসন বানাতে তারাও কখনাে পারেনি তাদের ৩৪ বছরের শাসনকালে।
রাজ্যের ৮২৫টি জেলা পরিষদের মধ্যে ভােট হয়েছিল ৬২২টিতে। অর্থা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল ২৪ শতাংশ জেলা পরিষদ আসন দখল করেছিল। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে বিজেপি বেশ কিছু জায়গায় ভালাে ফল করলেও জেলা পরিষদে সর্বত্রই তৃণমূলের জয়জয়কার হয়। এর কারণ জেলা পরিষদ আসনের ভােট গণনাতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল। অধিকাংশ জেলা পরিষদ আসনেরই ভােট গণনা হয়েছিল গভীর রাত্রে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির গণনার পর। বহু জায়গায় বিরােধী কাউন্টিং এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। উত্তরবঙ্গে শাসকদলের এক বুদ্ধিজীবী তদানীন্তন সাংসদ সারা রাত ধরে ভােট গণনা কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি ও গণনাকেন্দ্রের ভেতরে কারচুপিতে নেতৃত্ব দেন জেলা পরিষদ আসনে ভােট গণনার সময়। এগুলিই মােটামুটিভাবে জেলা পরিষদ স্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বগ্রাসী সাফল্যের কারণ।
এ রাজ্যে বিগত বছরগুলােতে বিধানসভা বা লােকসভা নির্বাচন ৫-৬ দফা ধরে হয়ে আসছে, যা ভারতবর্ষের আর কোনাে রাজ্যে হয় না। একটা সময় ছিল যখন বিহারে নির্বাচনের সময় গণ্ডগােল হতাে। কিন্তু বর্তমানে বিহারও সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মধ্যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে অবাধ নির্বাচন না হওয়া শুধু বাঙ্গালিদের পক্ষেই একটা বড়াে লজ্জার কারণ তাই নয়, ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষেও একটি বড়াে বিপদ। বিগত দু’ বছরে ভারতীয় জনতা পার্টির একশাের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকী কিছুদিন আগে উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের এক বিজেপি বিধায়ককে হত্যা করে সেটাকে আত্মহত্যা হিসেবে দেখানাের চেষ্টা চলেছে। যে রাজ্যে এক গজন বিধায়ককেই এইভাবে খুন করা হতে পারে সেখানে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলির গ্রামাঞ্চলের কর্মী-সমর্থকদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গের একটি থানার আইসি আটক বিজেপি সমর্থকদের মাংস-ভাত খাইয়েছিলেন এই ‘অপরাধে’ তাকে তৎক্ষণাৎ বদলি করা হয়। সিপিএমের আমলে প্রশাসন ব্যবস্থার যে রাজনীতিকরণ শুরু হয়েছিল এ রাজ্যে তাই বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। রাজ্যের সচিব ,সরকারি আধিকারিক থেকে শুরু করে জেলাশসক, পুলিশ সুপার থেকে থানার ওসিদের সঙ্গে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের কোনাে অমিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিগত লােকসভা নির্বাচনে বিজেপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বভারতীয় নেতা-মন্ত্রীরা পর্যন্ত অনেক সময় সভা করতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গে। কখনাে তাদের হেলিকপ্টার নামবার অনুমতি দেওয়া হয়নি আবার কখনাে বা তাদের সভাস্থলের অনুমতি মেলেনি। শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে পুলিশ এই কাজগুলি করেছিল। লােকসভার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও অনেকক্ষেত্রেই তাদের কোনাে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় বা উত্তেজনাপূর্ণ বুথগুলি বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে শান্ত। এলাকার বুথগুলিতে দায়িত্বে পাঠনাে হয়। ২০১৯ থেকে রাজ্যে কোনাে পুরনির্বাচন হয়নি। কারণ এগুলিতে ঠিক সময়ে ভােট হলে অধিকাংশতেই শাসকদলের হেরে যাবার ভয় ছিল। এই পৌরসভাগুলিতে এখন কমিশনার বসানাে রয়েছে। এমনকী গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে কোনাে সরকারি আধিকারিক নন, বরং পৌরসভাগুলিতে পূর্বতন শাসকদলের চেয়ারম্যানকেই কমিশনার পদে বসানাে। হয়েছে।
এই আলােচনা থেকে একথা পরিষ্কারই বােঝা যাচ্ছে যে, এই রাজ্যে রাজ্য সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই। কারণ এ রাজ্যে প্রশাসন ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই যদি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে প্রত্যেক বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করা যায়,তবেই একমাত্র আগামী বছর রাজ্যে সুষ্ঠুভাবে বিধানসভা নির্বাচন করা সম্ভব। যেখানে আপামর মানুষ তার নিজ নিজ গণতান্ত্রিক অধিকার অবাধে প্রয়ােগ করতে পারবে। ফলস্বরূপ রাজনৈতিক হিংসা সমাপ্ত হয়ে রাজ্যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে।
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
(লেখক অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, মৌলানা আজাদ কলেজ, কলকাতা)