দেশভাগের পর সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত জাতি বােধ হয় সিন্ধিরা। বাঙ্গলা বা পাঞ্চাবের মত সিন্ধুদেশ ভাগ না হওয়ায়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভাগ ভাগ হয়ে থাকতে বাধ্য হন তারা। গুজরাটের জুনাগড়, মহারাষ্ট্রে উলহাসনগর, অন্ধের সেকেন্দ্রাবাদের মতাে নানা জায়গায় গড়ে উঠে সিন্ধি কলােনি। এই কলােনিগুলাে বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর। একের পর এক ব্যবসায়ী প্রতিভা উঠে এসেছে এসব কলােনি থেকে। সিনেমা, ভারী শিল্প, ওষুধ, সফটওয়ার ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলেছে। ভারতের প্রতিটি বড়াে শহরে সিন্ধিরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব স্কুল ও কলেজ। যাতে সিন্ধি বাবা-মায়েদের কোনাে অসুবিধা না হয়। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে। এই দেশের সব থেকে শিল্পোদ্যোগী জাতি এরাই। হিন্দুজা থেকে রহেজা, হিরননি থেকে ওয়াধওয়ানি; ভারতীয় বিলিওনেয়ারদের বেশিরভাগই সিন্ধি। বিলিওনেয়ার, অর্থাৎ একশাে কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।
| এত সাফল্য, এত সমৃদ্ধি সত্ত্বেও সিন্ধিরা হারিয়েছেন অনেক কিছু। মােহনদাস গান্ধীর কথায় বিশ্বাস করে সিন্ধুর মাটি ভাগ বাটোয়ারা করেননি তারা। এই ঐতিহাসিক ভুলের পরিণাম সিন্ধিরা বুঝতে পারেননি। ভারতবর্ষে এলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের সকলকে এক রাজ্যে থাকতে দেওয়া হলাে না, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে বিতরণ করে দেওয়া হলাে। যাতে একটা রাজ্যের ওপর বেশি চাপ না পড়ে। ফলে জনসংখ্যা দিয়ে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা চিরকালের মতাে হারালেন তারা। একজন সিন্ধি যতই ক্ষমতাবান হােন, কোনােদিন কোনাে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না। রাজ্যস্তরে নেতা, মন্ত্রীও না। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজ্যে খণ্ড খণ্ড ভাবে থাকার ফলে একটি সিন্ধি সিনেমা শিল্পও গড়ে তােলা সম্ভব হয়নি। টাকার কোনাে অভাব নেই তাদের। কিন্তু সিন্ধি সিনেমা তৈরি হয় ৫ বছরে একটা। গুণমানে সেসব সিনেমা হয়তাে ভােজপুরীর থেকেও নীচুস্তরের। ভালাে সিনেমা করেই বা লাভ কী? এ রাজ্যে, সে রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা সিন্ধিদের মধ্যে সেই সিনেমা প্রচার করবে কে? এসব সিনেমা কোন সিনেমাহল চালাবে? হিন্দি সিনেমায় আসরানি, রাজকুমার হিরানি, আফতব শিবদাসনি, রণবীর সিংহ (ভাবনানি)-র মতাে কিছু সিন্ধি থাকবেন। কিন্তু হাজার পয়সা। ফেললেও এমন কোনাে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে না, যেখানে কেবল সিন্ধিরাই ছড়ি ঘােরাতে পাবেন। | বাঙ্গালি আর সিন্ধিদের মধ্যে একটা বড়াে মিল হলাে, সিন্ধিরাও মিষ্টি খেতে যথেষ্ট ভালােবাসেন। উলহাসনগরের আনাচে কানাচে মিষ্টির দোকানের সংখ্যা অনেক। এ ওয়ান সুইটসউলহাসনগরের সব থেকে বড়াে মিষ্টির দোকান। প্রায় সমস্ত বিখ্যাত সিন্ধি মিষ্টিই এখানে পাওয়া যায়। ঘিয়ার, লাডওয়া লাড্ড, সিঙ্গার মিঠাই, মালপুরা, সাতপুরা, লােলা আর মােহন থাল। মােহন থাল নামটা পড়ে অনেকেই অবাক হবেন। কারণ এটা গুজরাটি মিষ্টি বলেই পরিচিত। অথচ উলহাসনগরের সিন্ধিদের কাছে এটা সিন্ধুর মিষ্টি। বাকি মিষ্টিগুলাে দেখতে চেনা লাগলেও একটু অন্য রকম। মালপুরা হলাে ওপরে সুজির হালুয়া বা রাবড়ি লাগানাে মালপুয়া। ঘিয়ার-টা দেখতে আড়াই প্যাঁচের জিলিপির মতাে। তারও উপরে ছড়ানাে আছে। খােয়াক্ষীর। লাডওয়া লাড়ু হলাে আটার লাড্ড, অথচ খালি চোখে বেসন লাডুর সঙ্গে খুব একটা তফাত টের পাওয়া যায় না। এই দোকানে বাঙ্গালি মিষ্টি এবং উত্তর ভারতীয় মিষ্টিও পাওয়া যায়। সেগুলাে অন্যান্য শহরে এমনকী বিদেশেও বিক্রি হয়। যায় না কেবল সিন্ধি মিষ্টি। কারণ উলহাসনগরের বাইরে এসব কে চিনবে আর কেই বা কিনবে? সিন্ধিদের যদি একটা নিজস্ব রাজ্য থাকত তাহলে হয়তাে সেই রাজ্য সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারত। রাজ্য সরকারি উদ্যোগে এসব মিষ্টির জন্য GI (Geographical Indication) আদায় করতে পারত। GI হলাে একটা ভৌগােলিকমার্কা যে এই রাজ্যের বা এই অঞ্চলের এই পণ্যটি খুব বিখ্যাত। এটা পেলে বিদেশে নিজের পণ্য বিক্রি করতে খুব সুবিধা হয়। মােহনথালের কথা চিন্তা করলেও একটা অদ্ভুত সম্ভাবনা মাথায় আসে। মােহনথাল যদি সত্যি সত্যিই সিন্ধি মিষ্টিও হয়, তাহলেও কিছু করার নেই। গুজরাটিদের কাছে একটা আস্ত রাজ্য আছে। মােহনথালের যদি কখনাে GI হয়, তাহলে সেটা গুজরাটই নেবে। শুধু জুলজুল করে চেয়ে দেখা ছাড়া সিন্ধিদের আর কোনাে রাস্তা নেই। | সিন্ধিদের নিশ্চয়ই আরও অনেক রকম শিল্পকলা ছিল। বিশেষ রকম গয়না, কাপড়, রং, চিত্রকলা। যেমন, বাঙ্গলার আছে নিজস্ব তঁত, দেব দেউল, টেরাকোটা, পটচিত্র। স্রেফ একটা ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তাতেই সিন্ধি সভ্যতা সংস্কৃতির সব শেষ। বাঙ্গলার শিল্পীরা তবু রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করতে পারেন। ছৌ অ্যাকাডেমি হয়েছে, অনেক বাঙ্গালি কুটিরশিল্পী মাসােহারা। পাচ্ছেন। বাঁকুড়ার মেচা প্রস্তুতকারকরা, মেদিনীপুরের গয়নাবড়ি শিল্পীরা রাজ্য সরকারের কাছে দাবি করতে পারেন এসব পণ্যের GI এনে দেবার। যারা প্রায়ই বলেন—“অমুক রাজ্য বাঙ্গালির সব কিছু চুরি করে নিল”; তারা কি আন্দাজ করতে পারেন, যে জাতির কাছে কোনাে রাজ্যই নেই, তাদের সমস্ত সাংস্কৃতিক সম্পদ কীভাবে অন্যান্য রাজ্যের দ্বারা লুট হতে পারে বা চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হতে পারে ?
সিন্ধিরা এক কথায় গােটা সিন্ধের দাবি ছেড়ে এসে শুধু ভাষা-সংস্কৃতিই হারাননি। হারিয়েছেন নিজেদের ইতিহাসের প্রতি অধিকার। করাচী, হায়দরাবাদ (পাকিস্তান) ইত্যাদি শহরগুলােতে রীতিমত সিন্ধি রাজত্ব চলত। সিন্ধু রাজ্যের রাজধানী ছিল করাচী। সেই স্মৃতি বহন করে এখনাে সিন্ধিরা নিজেদের বহু প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন করাচী দিয়ে। উলহাসনগরে গেলে বহু করাচী হিন্দু হােটেল, করাচী রেস্টুরেন্ট, করাচী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। সেরকমই ভারত বিখ্যাত একটা নাম হল করাচী বেকারি। ভারতের হায়দরাবাদে উদ্বাস্তু হয়ে আসা খানচঁাদ রমনানি প্রতিষ্ঠিত কেক বিস্কুটের দোকান। গত বছর যখন পাকিস্তান পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনার ওপর হামলা চালায়; আমেদাবাদ, বেঙ্গালুরুর মতাে শহরে করাচী বেকারির দোকানগুলােয় ভাঙচুর চালানাে হয়। ঢেকে দেওয়া হয় দোকানের বাইরে করাচী বেকারি লেখা করাচী’অংশটা। করাচী যে কখনাে হিন্দুদের শহর ছিল এবং সিন্ধিরা সেই স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে চেয়েছিল; এক বিরাট ভুল বােঝাবুঝি এসে সেই সমস্ত কিছু ধামাচাপা দিয়ে দিল। | সিন্ধিদের ভাষা হারানাে শুরু বহু আগে। শুরটা হয় লিপি দিয়ে। সিন্ধি লিপি প্রাচীনকালে লেখা হতাে হাতবাকি লিপিতে। পরে জনসংখ্যা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী লিপির জায়গা নেয় আরবি লিপি। স্কুল। কলেজ ও অন্যান্য সরকারি কাজে সিন্ধি ভাষা আরবি লিপিতে লেখা শুরু হওয়ায় সিন্ধুর হিন্দুরাও ধীরে ধীরে ওই লিপি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। আর দেশভাগের পর তাে সিন্ধিভাষার চর্চাই কমে গেছে। সিন্ধুদেশ কেমন ছিল, তারমাটির রং কেমন, সেখানকার প্রকৃতি কেমন, এসব কিছুই আজকের সিন্ধিদের মনে নেই। ওই উদ্বাস্তু কলােনিটুকুই তাদের কাছে সিন্ধ। সেজন্য উলহাসনগরের নাম পাল্টে ‘সিন্ধু নগর’ করার চেষ্টা করেছিলেন সিন্ধিরা। সঙ্গে সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ে শিবসেনা। উলহাসনগর মহারাষ্ট্রের অংশ। মারাঠীরা দয়া করে থাকতে দিয়েছে, ব্যবসা করতে দিয়েছে; তাই বলে উলহাসনগরকে সিন্ধিদের নামে দানছত্র লিখে দেয়নি। নিজের মাটি যারা ছেড়ে এসেছে, অন্যের মাটিতে তাদের ভিখারির মতােই থাকতে হবে। আর ভিখারির কাছে যতই পয়সা থুকক, সে চিরকাল ভিখারিই থাকে।
নিজে উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান হওয়ায় বহু উদ্বাস্তু অঞ্চলে ঘুরতে গেছি। উলহাসনগরও ঘুরে দেখেছি। নতুন সিন্ধি প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘুরতে ঘুরতে অদ্ভুত একটা উপলব্ধি হয়েছিল। ওরা জানেও , ওরা কী হারিয়েছে। আমরা জানিও না, আমরা কী পেয়েছি। এমনিতে সিন্ধিদের সাথে। বাঙ্গালিদের কোনাে তুলনাই হয় না। ওদের নাম, যশ, অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির কাছে আমরা কিছুই না। কিন্তু আমাদের একজন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন। লােকটা সম্ভবত জ্যোতিষী ছিলেন, বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। অনেক লড়াই, অনেক ঝগড়া করে লােকটা একটা রাজ্য রেখে গেছেন আমাদের জন্য। ওই রাজ্যটা আছে বলেই আমরা এখানাে ছড়ি ঘােরাই। পশ্চিমবঙ্গে আমরাই মন্ত্রী, আমরাই ভােটার। সাংসদ সংখ্যার জোরে রাজনৈতিক দলগুলােকে চোখ রাঙাই। বাঙ্গলার প্রাপ্য না দিলে, বাঙ্গালিদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী না করলে ভােটে হারিয়ে দেব বলে ধমকাই। এক টুকরাে মাটি আছে বলে সেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি করতে পারি। এখানে আমরাই নয়াক, আমরাই নায়িকা, আমরাই গায়ক, আমরাই গায়িকা। | ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আমরা লবির কথা বলি। মুম্বাই লবি, দক্ষিণী লবি বাঙ্গালি | ক্রিকেটারদের সুযােগ পেতে দিচ্ছে না। তবে | ক্রিকেটটা বাদ দিলে রাজ্য থেকে অন্যান্য | খেলায় বাঙ্গালি খেলােয়াড়রা সুযােগ পান। সাঁতার, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলায় বাঙ্গালিরা যতই খারাপ হােক না কেন, জাতীয় ক্রীড়ায় অন্তত রাজ্যের প্রতিনিধিত্বটুকু করতে পারেন। কিন্তু সিন্ধিরা এই সুযােগটাও কখনাে পাবে না। সাধারণ প্রতিভা না হলে কেনাে সিন্ধি খেলােয়াড়ের সেই রাজ্যের হয়ে খেলা মুশকিল আছে। ফুটবল যে বাঙ্গালির প্রাণ, রাজ্যটা না থাকলে কোথায় হতাে এই ক্লাব সংস্কৃতি? অন্য রাজ্যে গিয়ে বাঙ্গালি থাকতেই পারে। তবে সেই রাজ্যের লােক বাঙ্গালিকে তার সংস্কৃতি নির্বিঘ্নে পালন করতে দেবেনা অসহিষ্ণু হয়ে অসহযােগিতা করবে, এটা বাঙ্গালির নিয়ন্ত্রণে নেই।
চাকরি-ব্যবসার ক্ষেত্রে এখন ভারতের বহু রাজ্যই ভূমিপুত্র সংরক্ষণের কথা ভাবছে। সেক্ষেত্রে সিন্ধি এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতরা, যাদের হাতে কোনাে রাজ্যই নেই, তারা কী করবে? এরা তাে কোনাে রাজ্যেরই ভূমিপুত্র নয়। তাই বলে আমি রাজ্যগুলােকে দোষ দিই না। মানুষ নিজের কর্মের বােঝা বয়। জাতিকেও নিজের অতীত মূখামির দায়িত্ব নিতেই হয়। সিন্ধি ও কাশ্মীরি পণ্ডিতরা নিজের রাজ্য ধরে রাখতে পারেননি, এই দায় একান্তই তাঁদের। যদি কোনাে জাতি ধনগর্বে অন্ধ হয়ে ভেবে নেয়, যে তাদের নিজস্ব ভুমির দরকার নেই। কেবল। টাকার জোরেই তারা বেঁচে থাকবে, তাহলে তাদের সঙ্গে ঠিক সেটাই হচ্ছে, যেটা তাদের প্রাপ্য। সিন্ধিদের মতাে সারা দেশে বাঙ্গালিরাও ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা জানি, ভগবান না করুন, যদি কখনাে এমন দিন আসে সারা ভারত থেকে বাঙ্গালিদের খেদিয়ে দেওয়াও হয়, তাহলেও আমাদের যাবার মতাে একটা জায়গা আছে। অসমের বাঙ্গাল খেদা বা মণিপুর, মিজোরাম থেকে তাড়া খাওয়া বাঙ্গালিরা জানত, পশ্চিমবঙ্গ নামে একটা রাজ্য আছে। সেটা বাঙ্গালিদের। সেই রাজ্য তার কথা শুনবে, তাকে আশ্রয় দেবে। এই রাজ্যটা আছে তাই দর্পভরে কোনাে এক পক্ষ বলতে পারে — “অন্য রাজ্য থেকে বাঙ্গালিদের তাড়ানাে হলে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেও তার পালটা দেওয়া হবে। আর সিন্ধিরা? তাঁরা তাে উলহাসনগরেরও নাম পালটে সিন্ধুনগর করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ না থাকলে বাঙ্গালির যে কী হতেী! ভাগ্যিস, আমাদের একটা পশ্চিমবঙ্গ আছে।।
পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটা মাথার ওপর ছাদের মতাে। ওটা আছে তাই, ইস্টবেঙ্গল-মােহনবাগান, রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎ করতে পারি। প্রবাসী বাঙ্গালিরা এখান থেকে ছেলের বউ বা জামাই খুঁজে এনে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের বাঙ্গালিত্ব বজায় রাখতে পারেন। প্রবাসে বাঙ্গালি সংস্কৃতি ঝালাই করে নিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের সাহায্য নিতে পারেন। এত কিছু পেয়েও যেসব বাঙ্গালি পশ্চিমবঙ্গকে দূর ছাই করেন, তাদের উচিত সিন্ধি ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবস্থাটা একবার চাক্ষুষ করা। আমাদের রাজ্যটা ভালাে হােক, খারাপ হােক, সেটা আমাদের। কোনাে রাজ্যই নিখুঁত হয় না, তার খুঁতগুলাে দুর করার দায় ভূমিপুত্রদেরই। পশ্চিমবঙ্গ থাকতে থাকতে বাঙ্গালির নিজ রাজ্যের মর্যাদা বুঝলে ভালাে। সাতচল্লিশে একজন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন, হিন্দু বাঙ্গালিকে নিজের বাসভূমি এনে। দিয়েছিলেন। কিন্তু আর কোনাে শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুদের বাঁচাতে আসবেন না।
এই বিষয়ে একটা ছােট ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। হাইওয়ের ধারে একটি ধাবায় খেতে গিয়েছিলাম। নাম -সিন্ধ, পাঞ্জাব ধাবা। দোকানটা যিনি চালান, ভদ্রলােক বয়স্ক। তবে বেশ সৌম্যদর্শন, খুশি খুশি চেহারা।তারই আগ্রহে প্রথঢ় সিন্ধুদেশের খাবার চেখে দেখেছিলাম। ডাল পাকোয়ান, সাই ভাজি আর সিন্ধি কিমা। অপূর্ব রান্না, খাওয়া শেষে ভদ্রলােকের সঙ্গে সামান্য আলাপের সৌভাগ্য হয়েছিল। কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম, উনি সিন্ধি এবং ওনার পরিবারে কেউ পাঞ্জাবি নেই। জিজ্ঞেস করলাম—“তাহলে ‘সিল্ক-পাঞ্জাব ধাবা’ নাম রেখেছেন যে”!
‘সিন্ধের নামে চলে না তাে। সিন্ধুকে আর কে চেনে?’ কঠোর হয়ে এল বৃদ্ধের গলা।
কী উত্তর দেব, বুঝতে পারলাম না। বৃদ্ধ বলে চললেন, ‘একদিন, সিন্ধের পাশে বলে পাঞ্জাবকে চিনত। পহলে সিন্ধ, ফির পঞ্জাব। ভদ্রলােকের চোখ দুটো মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার নিভে গেল। আর আজ? আর আজ সিন্ধ হিন্ কে বাহার হাে গয়া!’
কথাগুলাে হঠাৎ করে ফিরিয়ে আনল সাতচল্লিশের স্মৃতি। বিল মিটিয়ে চলে এলাম। এই অভিমানের কোনাে উত্তর সত্যিই আমার জানা নেই। ওনার বলা লাইনটা বহুদিন কানে। বাজত—-“আজ সিন্ধ হিন্দকে বাহার হাে গ্যায়া”! ভারতের জাতীয় সংগীতের পঙক্তিতে পঞ্জাব, সিন্ধু আর গুজরাট পাশাপাশি আছে; কিন্তু সিন্ধুদেশের এতটুকুও আর ভারতভূমির মধ্যে নেই। দেশভাগ সিন্ধিদের জন্য অভিশাপ আর বাঙ্গালিদের। কাছে শাপে বর। মাটিহারা হবার থেকে বােধ হয় মাটি ভাগ ভালাে।
স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী