আমাদের সংবিধান ও নাগরিক কর্তব্য

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে, আমাদের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে ১০ থেকে ৩৬ নং অনুচ্ছেদে সাত ধরনের নাগরিক অধিকারের উল্লেখ থাকলেও নাগরিক কর্তব্য নিয়ে কোনও কথা ছিল না। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতি বা Directive Principles-এর শেষে ৫১-ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে কতকগুলো নাগরিক কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে।
তাৎপর্যের বিষয় হলো—আমাদের সংবিধান মূলত ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করলেও এক্ষেত্রে বিরাট ব্যতিক্রম ঘটেছে। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত। প্রচলিত প্রথাই সেখানে প্রায় সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আমাদের সংবিধান লিখিত এবং পৃথিবীতে বৃহত্তম। এখানে অনেক কিছুর মতো নাগরিক অধিকারও লিখিত।
অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা আছে— ‘Rights and duties are corelative’—অর্থাৎ অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং অধিকার থাকলে কর্তব্যও থেকে যায়।
কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে, আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকারগুলো লিখিত ও বলবৎযোগ্য (enforcable) থাকলেও ১৯৭৬ সালের আগে কর্তব্যগুলো নির্দিষ্ট ছিল না। অধিকার ছিল সাতটা—(১) সাম্যের অধিকার; (২) স্বাধীনতার অধিকার; (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার; (৪) ধর্মীয় অধিকার; (৫) শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার; (৬) সম্পত্তির অধিকার ও (৭) সাংবিধানিক প্রতিকারের অধিকার। তবে ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের দ্বারা সম্পত্তির অধিকারকে বাদ দেওয়া হয়েছে—বর্তমানে অধিকার ছয় ধরনের।
তবে, আগেই বলেছি—নাগরিকের কর্তব্য বিষয়ে সংবিধানে কোনও কথা ছিল না। অবশ্যই এটা অত্যন্ত জরুরি ব্যাপার ছিল— কারণ নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার আদায় করবেন কর্তব্য পালন না করেই—এটা হতে পারেনা। ড. এ.সি. কাপুর মন্তব্য করেছেন, Incorporation of a charter of Fundamental Duties in the constitution is one of the important features of the constitution. —(দ্য ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেম, পৃ. ১৫৭)। ড. এম. ভি. পাইলির মতে, এগুলো হলো ‘a code of conduct —প্রাপ্ত অধিকারের বিনিময়ে নাগরিকদের এগুলো পালন করতে হবে–(অ্যান্ ইনট্রোডাকশন টু দ্য কনস্টিটিউশান’অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১৫৩)।
এই কর্তব্যগুলো হলো—
(১) সংবিধানকে মান্য করা ও আমাদের পুরনো ঐতিহ্য, প্রতিষ্ঠান, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা,
(২) যেসব মহান আদর্শ আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে পরিচালিত করেছে, তাদের মান্য করা;
(৩) দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা;
(৪) দেশের সুরক্ষায় সাহায্য করা ও প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে সাড়া দেওয়া;
(৫) ঐক্যবোধ ও জাতীয়তাবোধে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা ও সকলের মধ্যে ধর্মীয়, ভাষাগত, আঞ্চলিক পার্থক্যের মধ্যেও ঐক্য সঞ্চার করা;
(৬) ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করা;
(৭) প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে, বনভূমি, হ্রদ, নদী ও জীবন্ত প্রাণীদের সুরক্ষা দেওয়া;
(৮) বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, নাগরিক মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করা এবং জ্ঞান ও প্রগতির পথে প্রবৃত্ত হওয়া;
(৯) জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করা ও হিংসাকে দমন করা; এবং
(১০) ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করা।
অবশ্যই এই ধরনের কর্তব্যের কথা সংবিধানে থাকা দরকার। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি সব মানুষেরই কিছু অবশ্য কর্তব্য আছে। এগুলো রয়েছে ‘with a view to inculcate a sense of responsibility in the people’— (জি. এস. পাণ্ডে — কনস্টিটিউশনাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১৯৫)। তার মতে, ইতিপূর্বে আমাদের দেশে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস, জাতীয় পতাকা পোড়ানো, কিংবা প্রচার, দাঙ্গা, কুৎসা প্রচার, অন্তর্ঘাত ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে অবাধে। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, কর্তব্যের উল্লেখ আমাদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়— These duties are not peculiar to Indian Constitution. Constitutions of U.S.S.R. Chaina, Czechoslavia, Hungary. Japan, Koria, Labanon, Poland, Rumania, Thailand, Mongolia and many other countries provide for duties of their citizen.’
১৯৭৬ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এইচ. আর. গোখেল মন্তব্য করেছিলেন, এই ধরনের ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে Sobering effect of those restless spirits who have led host of anti-nationalist, subversive and unconstitutional agitation in the poat’. — (Tzala অব ইন্ডিয়া, ২৭.৩.৭৬)। স্মরণ সিংহ কমিটিও এই ধরনের কিছু করার পরামর্শ দিয়েছিল।
আসলে, আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ স্বার্থপর, অসহিষ্ণুও, ধর্মান্ধ ও রাজনীতি-নিমজ্জিত ও আদর্শহীন। তারা শুধু নিজেরটা বোঝেন এবং আবেগে বলেন। সেই জন্যই তাদের সুপথে টানার জন্য কিছু নৈতিক শিক্ষাদানের দরকার ছিল।
অবশ্য প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল পি.কে. দপ্তরী মনে করেন আমাদের দেশের মানুষ আইন-অনুসারী ও শান্তিপূর্ণ আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু আগেই বলেছি— অধিকার ও কর্তব্য অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সেই জন্যই ড. বিদ্যাধর মহাজন জানিয়েছেন, কর্তব্যবোধটা নাগরিক-চেতনা জাগরিত করবে, গড়ে তুলবে উন্নত চেতনার পরিবেশ—(দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১৫৭)। গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ দেশ।
কিন্তু এই প্রসঙ্গে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও মনে আসে।
প্রথমত, ৫১-ক ধারাকে রাখা হয়েছে ‘নিদের্শমূলক নীতি’অধ্যায়। সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সমগ্র অধ্যায়টাই বলবৎঅযোগ্য—অর্থাৎ এগুলো কেউ অমান্য করলে তাকে আইনত কোনও শাস্তি দেওয়া যায় না। ড.হরিহর দাসের ভাষায়—As there is no legal force behind them, the Direc tive Principles are dulled as mere pious ambitions’—(ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ১৩৭)। প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু মন্তব্য 2616901— “The legal utility of the Fundamental Duties is similar to that of the Directive Principles’- ulcs পেছনে ‘legal sanction’ নেই— (কনস্টিটিউশনাল ল’ অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১২৯)। অনুরূপভাবে ড. এস. সি. কাশ্যপ মন্তব্য 76516991, the duties of citizns also cannot be enforced by courts. There is no provision for ensuring their compliance on for punishing their violation- (আওয়ার কনস্টিটিউশান, পৃ. ১৪০)।
দ্বিতীয়ত, অনেকে মনে করেন, সংবিধান কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক কর্তব্যের কথা উল্লেখ করলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ গিয়েছে। যেমন ফ্যামিলি প্ল্যানিং, সন্তানকে শিক্ষাদান, কর দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। বলা উচিত, ৫১-ক ধারাটা পর্যাপ্ত নয়।
তৃতীয়ত, নাগরিক কর্তব্যগুলো লিখে দিলেই হয় না। সেগুলো পালন করার জন্য দরকার সচেতনতা সৃষ্টি, আর তার পেছনে থাকা উচিত উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের দেশে। শিক্ষার বিস্তার তেমন হয়নি। কোনো কোনো গোষ্ঠী অর্থাভাব ও অশিক্ষার কারণে অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত। সেক্ষেত্রে কর্তব্যগুলোর অধিকাংশই লিখিত আকারে থেকে যাবে—আর অধিকাংশ মানুষ সংবিধানের মলাটই দেখেননি।
চতুর্থত, এক নাগরিকত্ব, ঐক্যবোধ, জাতীয় সংহতি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, আঞ্চলিকতা, ঐতিহ্য নিয়ে বহুধাবিভক্ত। এই সব নিয়ে মাঝে মাঝে হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে।
এই কারণে ড. এস. এল. সিক্রি মনে করেন, সমস্যাটা অত্যন্ত জটিল। এগুলোকে দূর করা এক দুরূহ ব্যাপার– (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৫৯)।
পঞ্চমত, আরও রয়েছে বহু দলীয় সমস্যা। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছেন– ২০০৫টা দল তাদের নাম নথিভুক্ত করেছে। যে দেশে এতগুলো রাজনৈতিক পক্ষ থাকে, সেখানে উচ্চাঙ্গের নাগরিকত্ববোধ আশাই করা যায় না। দায়িত্ববোধহীন ও সস্তা নেতৃত্ব রাজনৈতিক কারণেই জটিলতা, বিভেদ, বৈরিতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ জিইয়ে রাখে। প্রতিবাদের নামে রক্তপাত ও হানাহানির ফলে জাতীয় সম্পত্তি রক্ষার বদলে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। রেল-কাউন্টারের টাকা লুঠ হয়। অনেক সময় পেছনে থাকে কোনো কোনো দল ও রাজ্য সরকারের নির্লিপ্ততা এমনকী প্রশ্রয়ও। সংবিধান তাদের গণ্ডিবদ্ধ করতে পারেনি।
সব শেষে বলা যায়, কর্তব্যগুলো নানা ধরনের এবং অস্পষ্টও—ড. জে. সি. জোহারীর : ‘it is not as it ought to have been exhaustive
তাছাড়া কর্তব্যগুলো ‘either vague or they are beyond the comprehension of an average man’—(ইন্ডিয়ান পলিটিক্স, পৃ. ১৫১)। তাঁর প্রশ্ন— ‘rich heritage of our composite culture’, ‘scientific temper’, ‘spirit of inquiry and reform’ এই কথাগুলোর অর্থ সাধারণ মানুষ বুঝবেন? সেইসব আদর্শ যা আমাদের মুক্তি-সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেগুলি কী, সেটা কয়জন জানেন? উচিত ছিল প্রাথমিককর্তব্যগুলোর উল্লেখ।
তবু বলি— এই সংযোজনের একটা মূল্য আছে। নাগরিকের কিছু কর্তব্য থাকে— যদি সেগুলো অন্তত কিছু মানুষও জানেন এবং পালন করার জন্য সচেষ্ট হন, তাহলে দেশ প্রগতির পথে অনেক এগিয়ে যেতে পারে। সেই কারণেই এগুলোর একটা শিক্ষাগত মূল্য (educative value) আছে। তবে ভালো হতে এগুলোকে আদালত গ্রাহ্য করা হলে, কর্তব্যে অবহেলার ব্যাপারটাকে শাস্তিযোগ্য করে তুললে।
অবশ্য নেতা-নেত্রীরা ‘দিতে হবে, দিতে হবে’শিখিয়েছেন। মানুষেরও কিছু যে দেওয়ার আছে— সেটা তারা জানেন না।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.