দীর্ঘদিন অনলাইন শিক্ষার কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে সৃষ্টি হতে চলেছে। নানা সমস্যা। তাদের মধ্যে এমন উদ্ভূত সমস্যাগুলি হতে পারে নিম্নরূপ
(ক) একঘেয়েমি, (খ) উৎসাহবােধের অভাব, (গ) নিষ্ক্রিয়তা, (ঘ) মানসিক অবসাদ, (ঙ) অনীহা (পড়তে অনাগ্রহ), (চ) একাকিত্ব বােধ, (ছ) পড়া অপ্রয়ােজনীয় মনে হওয়া, (জ) মােবাইলের অনুচিত ব্যবহার, (ঝ) চোখের ক্লান্তি। ক্ষেত্র বিশেষে এমনতরাে ছােটোখাটো আরও কোন সমস্যা তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে শুধু শিক্ষার্থী নয় , শিক্ষকশিক্ষিকাদের ক্ষেত্রেও অনলাইনে দীর্ঘসময় শিক্ষাদানে সৃষ্টি হতে পারে নানা মানসিক অবস্থা—(ক) একঘেয়েমি/ক্লান্তি, (খ) শিথিলতা, (গ) আলস্য, (ঘ) অনাগ্রহ, (ঙ) গুরুত্বহীনতা, (চ) কর্তব্যে অবহেলা, (ছ) অবসাদ, (জ) অনলাইন বিষয়ক ব্যবহারিক কাজে অপটুতা ইত্যাদি। কেন এমন হচ্ছে! আসলে যেকোনাে বড়াে পরিবর্তনের সময়ই এরকম একটা অবস্থা হয়। অনেকাংশেই এটি পরিবর্তন কাল (Transition Period) জনিত সমস্যা, তাও আবার এমন করে হঠাৎ। সমষ্টিগত শিক্ষা থেকে আমরা অনলাইনের শিক্ষায় প্রবেশ করেছি। কেউ ভাবেনি দিনের পর দিন এরকম একা থেকে সামনে পাশে কাউকে না দেখে, হাসি কথা হই-হুল্লোড়, চেঁচামেচি, রাগ-অনুরাগ, ঝগড়া-কৌতুক সবকিছু বর্জিত হয়ে পুরাণ কথার যেন এক নিঝুম পুরীতে রাজপুত্র/রাজকন্যা হয়ে যন্ত্রের সাহায্যে আপন কাজ (পড়াশােনা) সম্পন্ন করতে হবে। নিরুপায়, কিন্তু মনতাে বােঝে না। সে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না বলেই এসব বিপত্তি-ভাব। সহপাঠী নেই, বন্ধু নেই, সহযােগী শুভার্থীও (শিক্ষক শিক্ষিকা) নেই। মনের কথা বলার জায়গা নেই, কারও কথা শােনারও সুযােগ নেই। কিন্তু মনের মধ্যে তাে কত কথা, ইচ্ছা, অনুভূতি চাহিদা নিত্যই তৈরি হতে থাকে। পরিবারে পরিবেশের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সব সুরাহার সুযােগ হয় না। তখন এসব চাপা পড়া অবদমিত ইচ্ছা, চাহিদা, অনুভূতি মনে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। মনােবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মানসিক দ্বন্দ্ব (Conflict) । এখান থেকেই তৈরি হয় খিটখিটে মেজাজ, অনীহা (আমার পড়তে ভাল লাগে না…..) অবসাদ, মনের অদ্ভুত সমস্ত আচরণ। এই সময় শিক্ষার্থীদের এমন একা হয়ে পড়ার ফলে আরও কিছু সুদূরপ্রসারী সমস্যা তৈরি হচ্ছে বা হতে পারে। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বই পড়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে নিজ স্বার্থ ছাড়া পরহিতে কাজ করার মানসিকতাই হয়তাে তৈরি হবে না। এমন হলে ‘সমাজ’ শব্দটার অর্থ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
এ প্রসঙ্গে সমস্যার আর একটা বড়াে দিক রয়েছে। আমাদের প্রায় ৬৯ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে থাকে। অনলাইনে ক্লাস প্রশ্নে তাদের অনেকের কাছেই হয়তাে মােবাইল নেই, কোথাও নেটওয়ার্ক নেই আবার তা থাকলেও মােবাইলে অনলাইনের নানা পদ্ধতিতে অভিভাবক অভ্যস্ত নন। তাদেরও একটা প্রশিক্ষণ হলে ভালাে হয়। কেননা শিশুদের অনলাইনে সহযােগিতা বাবা-মাকেই করতে হয়।
এমন আনাচে কানাচে বসে থাকা সমস্যার অভাব নেই। কিন্তু সমাধানের লক্ষ্য ও কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে অবশ্যই শিক্ষার্থী; তাদের মন, মনের সাবলীল গতি, পঠন পাঠনে আকর্ষণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর বড় দায়িত্বটা বর্তাবে শিক্ষক শিক্ষিকার উপরেই। একটা কথা এখানে নিঃসঙ্কোচে বলাই উচিত—শিক্ষক-শিক্ষিকা যদি সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তা সম্পন্ন (Innovative) না হন তাহলে তাঁর পক্ষে অনলাইনেতাে বটেই সাধারণ ক্লাস করানােও বেশ কঠিন। যা করা হবে তা হবে নিছক যান্ত্রিক। এখন প্রতিদিনের পাঠদানের মধ্যে চাই একটা পরিমিতি, অল্প পরিবেশন কিন্তু সার্থক। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য থেকে বেশ কিছুটা স্বচ্ছন্দে নড়াচড়ার মত ফাকা জায়গা রাখা। আর সেখানেই তৈরি করতে হবে অনলাইনে পাঠদানের আকর্ষণের বিষয়, আনন্দ, কৌতুহল, মজার নিত্যনতুন পসরা তৈরি করতে হবে সেখানে।
কিছু নমুনা
(১) সব বিষয়ের মধ্যেই তৈরি করা যেতে পারে নানা পর্যায়ে মজার মজার ধাঁধাঁ (Puzzle)। খুঁজলে পরে অগুন্তি সংখ্যায় সংগ্রহ করা যেতে পারে।
(২) অঙ্কের জাদু/অঙ্কের মজা।
(৩) ছবি দেখে গল্প তৈরি করা।
(৪) ছােটো ছােটো প্রকল্প কাজ। যেমন—তােমার অঞ্চলে বর্ষার পরিবেশে কী কী পরিবর্তন দেখছ বা বর্ষায় আশপাশে কী ধরনের কীটপতঙ্গ, ক্ষুদ্র প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে। লিখে এবং পারলে ছবি তুলে পাঠাও। বর্ষায় তােমার কী করতে, কী খেতে ভালাে লাগে, তেমন কিছু করলে সংক্ষিপ্ত একবিবরণ তৈরি করে পাঠাতে পার, ছবিও পাঠানাে যেতে পারে।
(৫) শনিবারটা নানা ক্রিয়াত্মক, সৃজনাত্মক বিষয়ের জন্য রাখলে ভালাে হয়। যেমন—শিশুসভা বাকিশাের সভা। গান, নাচ, কবিতা পাঠ (স্বরচিত হলে খুব ভালাে), বাদ্যযন্ত্র, গল্পবলা, এককাভিনয় ইত্যাদি।
(৬) ভালাে কোনাে দৃশ্যের ছবি তুলে পাঠাতে বলা। নিজের আঁকা ছবি হলেতাে অতি উত্তম।
(৭) চার পাঁচজন শিক্ষার্থীর গােষ্ঠী তৈরি করে দিয়ে (মাধ্যমিক স্তরে)
তাদের গােষ্ঠী ভিত্তিক কোন সমস্যা/কাজ দেওয়া, যেমন—করােনার মধ্যে তােমার অঞ্চলে মানুষের কী কী সমস্যা হচ্ছে। তারা পরস্পর ফোনে যােগাযােগ করে নানা সুত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিষয় তৈরি করবে।
(৮) তােমার দৃষ্টিতে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ খবর।
(9) কিছু হাতের কাজের নমুনা ভিডিয়াে করে পাঠানাে। কাগজ কাটা, কাগজের ফুল, নানা শিল্প কর্ম হতে পারে। শিক্ষার্থীরা তৈরি করে ছবি পাঠাবে।।
(১০) মাঝে মাঝে এসমস্ত বিষয়ের একটা প্রতিযােগিতা হওয়া উচিত। পুরস্কার অবশ্যই রাখতে হবে। ভাল কাজগুলাে সব শিক্ষার্থীদের জানালে সকলে উৎসাহিত হবে।।
(১১) খেলা—ঘরে বসে খেলা, খেলতে খেলতে পড়া, খেলার মাধ্যমে শরীর চর্চা,নতুন খেলা উদ্ভাবন করা, সংগ্রহ করা।
(১২) শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষ থেকে বিদ্যালয় পরিবেশের নানা আঙ্গিকের বর্তমান ছবি পাঠানাে যেতে পারে (এক একদিন এক একটা অংশ বা বিষয়)। তারা দেখবে এতদিনে তাদের বিদ্যালয় পরিবেশে কেমন পরিবর্তন এসেছে।
মাঝে মাঝে প্রাসঙ্গিক কোনাে বই পড়তে, গান শুনতে, ছবি আঁকতে আগ্রহ করা। চোখকে বিশ্রাম দেওয়ার পদ্ধতি অবশ্যই সকলের সামনে তুলে ধরা উচিত। আসন, প্রাণায়াম, শরীরচর্চার বিষয়টিকেও যথােচিত গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এত সমস্ত কিছু অবশ্যই একদিনে নয়। মােটামুটি একটা সমানান্তর রেখে নিয়মিত পাঠালে নিত্য নতুনের স্বাদ পাওয়া যাবে। একটা পেলে ততক্ষণে অন্যটা পাবার জন্য আগ্রহ তৈরি হবে। আসল কথা, সবাই যদি নানা সৃজনশীল কাজে, আপন কাজে ব্যস্ত থাকে, আনন্দ খুঁজে পায় তবে আর সে সমস্ত সমস্যাগুলাে কাছে ঘেঁষার সুযােগ পাবে না। শিক্ষক-শিক্ষাকাগণও সমানভাবে আনন্দ উপলব্ধি করবেন।
এসময় প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবার হয়ে উঠেছে স্ব-নিয়ন্ত্রিত এক একটি ক্ষুদ্র বিদ্যালয়। তাকে সঠিক পথে নিত্য সচল রাখাই শিক্ষক শিক্ষিকার এখন প্রধান কাজ। আর এসব কাজে সফলতার মূলসূত্র হলাে আনন্দ প্রাপ্তি। আনন্দ থেকেই আসে একাগ্রতা, পরবর্তীতে ধ্যান, মনােযােগিতা।ইষ্ট লাভে (লক্ষ্য প্রাপ্তি) কঠিন পথের যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। অতএব—“আপন কাজে বিভাের হয়ে চল ছুটে চল উল্লাসে।
বিমলকৃষ্ণ দাস