স্বাধীন ভারতবর্ষে এই প্রথম ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের কথা মাথায় রেখে একটি শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে। এর রূপায়ণের জন্য অবশ্যই প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন। তারও সংস্থানের জন্য দিকনির্দেশ করে বলা হয়েছে যে দেশের জিডিপি-র ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে যা এখন অর্ধেকের থেকেও কম।
মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষানীতি যা স্বাধীন ভারতেও অনেক দিন চলেছিল তার প্রয়ােজনীয়তা অনেক আগে ফুরােলেও কিন্তু কোঠারি কমিশনের পর শিক্ষানীতিতে কসমেটিক পরিবর্তন ছাড়া আর বিশেষ কিছু হয়নি। আমাদের শেষ ঘােষিত শিক্ষানীতি ছিল ১৯৮৬ সালে (National Policy of Education) / 017013 T.S.R. Dubramaniam Committee (May, 2016) এবং তার পর K. Kasturirangan Committee (May, 2019)। এই শেষােক্ত কমিটির রিপাের্ট বিস্তৃতভাবে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের মতাতম নেবার পর গত ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীমণ্ডলী তা গ্রহণ করেছে। একথা বললে ভুল হবে যে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কোনাে আলােচনা করা হয়নি। করা হয়েছে, মতামত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অবমূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের দেওয়া মত গৃহীত না হলেই বলা হয় যে আলােচনা হয়নি। শিক্ষা কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকায় থাকায় রাজ্যকে বাদ দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। আবার রাজ্যকেও মনে রাখতে হবে যে তারা স্বতন্ত্রভাবে ‘তালিবানি শিক্ষাকে’ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে প্রমােট করার অধিকার রাখে না। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বামপন্থী তথাকথিত শিক্ষাবিদের চাপ ছিল কসমেটিক পরিবর্তনের পক্ষে, সরকারকে ধন্যবাদ যে আগের সরকারের মতাে তারা এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি।
এই শিক্ষানীতির উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হলাে— স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের আলাদা আলাদা চাপ লাঘব। একটু ব্যাখ্যা করে বললে বােঝা যাবে। একটি শিশুশিক্ষার জগতে প্রথম তিন বছর প্রাক স্কুলশিক্ষায় থাকবে। তারপর দু’বছর গ্রেড ওয়ান ও গ্রেড টু-তে কোনাে বিশেষ সিলেবাসের বােঝা থাকবে না। খেলাধুলা, অক্ষর পরিচয়, সংখ্যার পরিচয়, ছড়া ও গানের মাধ্যমে জেনারেল হাইজিন ইত্যাদি। এই সময় থেকেই শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীর inclination লক্ষ্য করবেন এবং শিক্ষক-অভিভাবক মিটিঙে তা বিশদে আলােচনা করবেন। এর পরের তিন বছর গ্রেড থ্রি থেকে গ্রেড ফাইভ পর্যন্ত মাতৃভাষা ও স্থানীয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষায়ও শিক্ষাদানের সুযােগ থাকবে। এখানেও শিক্ষক-অভিভাবকের ছাত্রসম্বন্ধে, তার চিন্তা ও ধারণার মূল্যায়নে জোর দেওয়া হবে। এ ধরনের শিক্ষা আমেরিকাতে হয়। ইউরােপের কিছু জায়গাতেও হয়। এতে ছাত্র-ছাত্রীর মানসিক গঠন অনেক পােক্ত হয়। সর্বোপরি মুখস্ত করার চটজলদি প্রক্রিয়া ও নােট গলাধঃকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের এখান থেকেই শুরু হবে। এখান থেকেই মেকলের কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার গঙ্গাজলি যাত্রা শুরু। এর পরের তিন বছর গ্রেড সিক্স, সেভেন ও এইট। এখানে বিষয় সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং আগের মতােই আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষার সুযােগ থাকবে। এই পর্যন্ত সর্বশিক্ষা। এখানেই মানুষ গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ। যে জন্য যথার্থভাবে মন্ত্রকের নাম পালটে আমাদের ছাত্রাবস্থার নাম ‘শিক্ষা মন্ত্রক’ ফিরে এসেছে। কমিউনিস্ট আদর্শে মানুষ একটি রিসাের্স’যা একটি ‘কমােডিটি’ মাত্র। সেজন্য আগের শিক্ষাব্যবস্থায় স্টুডেন্টদের বাধ্য করা হতাে সেট প্যাটার্নের সিলেবাসে সেট বিষয় সমষ্টি পড়তে। Propaganda oriented cramming in brain- সেখান থেকে অনেক মুক্তমনে মানসিক বিকাশের সুযােগ স্টুডেন্টদের দেওয়া হলাে। এই জায়গাতে শিক্ষকদের যথার্থ নিবিড় ট্রেনিঙের প্রয়ােজন। কারণ শিক্ষাদানের ঘাত-প্রতিঘাত পরিবর্তিত হলাে। আগে তাদের কাজ ছিল ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন সাধন, আর এখন হলাে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক ও মস্তিষ্কের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করা। কাজটা শক্ত হলেও এর মাধ্যমেই পাওয়া যায় শিক্ষকের কাজের সার্থকতা।
এরপর নবম থেকে দ্বাদশ চারটি গ্রেড চার বছরের। এখানে একজন ছাত্রের বিকাশের জন্য চব্বিশটি বিষয়ের অপশন থাকছে। কোনাে গ্রুপ নেই। কেউ বায়ােলজির সঙ্গে ইতিহাস বা অঙ্কের সঙ্গে সংস্কৃত নিতে পারে। পরাধীন মানসিকতা থেকে স্বাধীন মানসিকতায় উত্তরণ। যে বিষয় যার ভালাে লাগে সে সেই বিষয় পড়বে। এখানে বিষয়ের মূল জায়গায় বিভিন্ন হাতে-কাজ শিক্ষাকেও রাখা হয়েছে। ইউরােপের একাধিক দেশে এতে উচ্চশিক্ষারও সুযােগ আছে। আমাদের দেশেও তা দেওয়া হলাে। ফলে কৃষক, কুমাের, কামার, মালী, শিল্পী প্রভৃতিরা মূল শিক্ষিত সমাজের অঙ্গ হবেন। কোনাে কাজ বা শিক্ষাই ছােটো নয়।
আমার মনে পড়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগে নিউজার্সি শহরে একটা আমন্ত্রণী বক্তৃতা দিতে গিয়ে একজন এমডি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি সােশ্যাল সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশানের পর ডাক্তারি পড়েছিলেন। এটা ওদেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। ডিব্ৰগলির নাম ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি পড়া সবাই জানেন। তিনি ফিজিক্সে নােবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। ডি ব্ৰগলি বিজ্ঞান পড়ার আগে ইতিহাসে গ্র্যাজুয়েশান করেছিলেন। এই চার বছরে বিষয়বৃদ্ধির জন্য স্টুডেন্টদের উপর যাতে চাপনা বাড়ে, তার জন্য এই চার বছরের পরীক্ষা আটটি। সেমিস্টারে ভেঙে দেওয়া হলাে। এর একটি বড়াে সুবিধা হচ্ছে স্কুল ড্রপ আউট কমানাের চেষ্টা। ৫+৩+৩+৪ স্কুলশিক্ষার প্রতিটি স্তরের শেষে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। এর কোনাে পর্যায়ে অর্থনৈতিক বা অন্য কারণে ড্রপ আউট হলে পরে অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সে আবার যে লেভেল অব্দি পড়েছে। তার পরের লেভেল থেকে পড়তে পারবে। এই ব্যবস্থা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে।
এরপর আসি উচ্চশিক্ষায়। স্নাতক স্তর ন্যূনতম তিন বছর। সেখানেও বিষয় বাছার সুযােগ স্টুডেন্টদের থাকবে। কোনাে বিশেষ গ্রুপ বা বিষয়ের clusture থাকবে না। তিন। বছর পড়ার পর স্নাতক ডিগ্রি পাওয়া যাবে। কিন্তু স্নাতকোত্তর পড়তে গেলে স্নাতক স্তরে আরও এক বছর অর্থাৎ মােট চার বছর পড়তে হবে। তারপর এক বা দু’বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স। এই প্রকারভেদ জেনারেল ও টেকনিক্যাল পড়াশােনার ক্ষেত্রে। তার পর স্টুডেন্টরা সরাসরি পিএইচডি করতে পারবে। এম.ফিল. ডিগ্রি আর রইল না। এর অনেকগুলি ভালাে দিক আছে। প্রথমে বলি, স্টুডেন্ট কোনাে বছরের শেষে পড়া ছেড়ে গেলে সেই বছর অবদি সার্টিফিকেট পাবে। পরে যখন খুশি আবার ফিরে এসে সেখান থেকেই শুরু করতে পারবে। ফলে, কোনাে বছর নষ্ট হবে না। এম.ফিল.বন্ধ করা ও কোর্স পিএইচডি করার ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার খর্ব না হলেও শিক্ষকদের ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা সীমিত হলাে। এটা একটা ভালাে দিক।
যদিও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংখ্যা এখন একাধিক, যেমন AICTE, UGC ইত্যাদি, এখন থেকে একটিই নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকবে। ফলে, দুর্নীতি ও বিতর্ক কমবে। কাজের সুবিধা হবে। দেশের উচ্চশিক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলিতে। কেন্দ্রীয়স্তরে গঠিত একটি নিয়ামক সংস্থার মাধ্যমে ছাত্রভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। র্যাঙ্ক অনুযায়ী অপশন দিয়ে ছাত্ররা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে। আমি অনেকদিন ধরে বিভিন্ন ফোরামে এই কথা বলে আসছি। আজ জাতীয় শিক্ষানীতিতে এর অন্তর্ভুক্তি আমাকে খুশি করেছে।
কলেজ ইউনিভার্সিটির মূল্যায়ন পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে। মূল্যায়নে A+ গ্রেড সবচেয়ে বেশি অটোনমি পাবে। A গ্রেড তারপর। B গ্রেডের ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য যা প্রয়ােজন তার নির্দিষ্ট উপদেশ থাকবে। মােটের উপর বলতে হয়, স্বাধীন ভারতবর্ষে এই প্রথম ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের কথা মাথায় রেখে একটি শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে। এর রূপায়ণের জন্য অবশ্যই প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন। তারও সংস্থানের জন্য দিকনির্দেশ করে বলা হয়েছে। যে দেশের জিডিপি-র ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে যা এখন অর্ধেকের থেকেও। কম। আগের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানাের সুযােগ ছিল না বা থাকলেও target oriented সংকুচিত চিন্তাধারা মাত্র। এই শিক্ষায় শিশুকাল থেকেই application oriented শিক্ষার ব্যবস্থা থাকায় তা স্বাধীন চিন্তার উপযােগী মস্তিষ্ক গঠনের সহায়ক হবে। সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার উন্নতিতে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি আলাের দিশারি হয়ে দেখা দেবে।
ড. নারায়ণ চক্রবর্তী
(লেখক মৌলানা আজাদ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও পশ্চিমবঙ্গের বায়ােটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের প্রাক্তন পরামর্শদাতা ও ডিরেক্টর)